পাঠ বিশ্লেষণ
চর্যাপদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
পৃথিবীর যেকোন ভাষা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আদি পূর্বে তার কাব্যধারাটিই প্রাধান্য লাভ করেছিল। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক যুক্তি নির্দেশ করা যেতে পারে। সাহিত্যের আদি পর্বে লিপি আবিষ্কৃত হয়নি এবং পরবর্তীতে যখন এর আবিষ্কার হয় তখন তার লেখার কৃৎকৌশল কম লোকেরাই জানতে পেরেছেন। দ্বিতীয় মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহার তখন কারোরই জানা সম্ভবপর ছিল না, যার দরুণ মুদ্রিত গ্রন্থ বলে কোন বস্তু তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে সাহিত্য বিষয়ক বস্তু মুখ্যত স্মৃতি ও শ্রুতিবাহিত হয়ে বিস্তার লাভ করেছিল। যাদের লিপি সম্পর্কিত কিছু তথ্য জানা ছিল বা লিপি বিষয়ে জ্ঞান ছিল তা পুঁথিতে প্রণয়ন করতেন। তবে স্মৃতি ও শ্রুতিই ছিল রচনা সম্প্রসারণের মুখ্য মাধ্যম। স্বভাবতই সুর, তাল, লয়, ছন্দ এবং সঠিক গতি সমন্বিত শ্রুতিসুভগ পদ স্মৃতিধার্য হয় সহজে। ফলে আমরা বুঝতে পারি যে কোনো ভাষা সাহিত্যের আদি পর্বের কাব্যধারাটি প্রবল এবং মুখ্যত রূপ ধারণ করে।
স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে বাংলা কাব্যধারার আদি নিদর্শন কোনটি। সে নিয়ে সাহিত্যের মধ্যে ইতিহাসের অনুসন্ধান শুরু হয়। ১৩০৫ সনের "সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায়' ইতিহাস রচনার প্রণালী প্রবন্ধে রজনীকান্ত গুপ্ত লিখেছিলেন -
"দরিদ্র মুকুন্দরামের সংগীতের সহিত তদানীন্তন বঙ্গীয় সমাজের ইতিবৃত্ত জড়িত রহিয়াছে। আদি কবি কৃত্তিবাসের গ্রন্থের বিশ্লেষণ করিলেও সেইসময়ের বাঙ্গালী চরিত্রের আভাস পাওয়া যাইতে পারে।'
মেঘনাদবধ কাব্যে দেবী
অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা, সনেট রচনার জনক, সাহিত্যিক মহাকাব্যের পথপ্রদর্শক এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মাইকেল মধুসুদন দত্তের অমর সৃষ্ট কাব্য ‘মেঘনাদবধ’। কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা কবির দ্বিতীয় কাব্য। প্রকাশকাল ১৮৬১ খ্রি.। মোট সর্গ সংখ্যা নয়টি। কাব্যের মূল আখ্যায়িকা নেওয়া হয়েছে ‘রামায়ণ’ থেকে। সেইসঙ্গে প্রাচ্য বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ থেকে শুরু করে কাশিরাম দাসের ‘মহাভারত’, কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ এবং পাশ্চাত্য ‘ইলিয়াড’, "ডিভাইন কমেডিয়া’, জেরুজালেম ডে লিভার্ড’, প্যারাডাইস লস্ট’ প্রভৃতি কাব্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। ফলে, তাঁর কাব্যে প্রবেশ ঘটেছে বিচিত্রপ্রকার উপাদান। যার থেকে বাদ পড়েনি নানাপ্রকার দেবীরা। তবে, আমাদের এই নিবন্ধের মূল আলোচনার বিষয় ‘মেঘনাদবধ’কাব্যে ব্যবহৃত লৌকিক, বৈদিক ও পৌরাণিক দেবীদের থেকে নির্বাচিত পাঁচটি দেবীর আখ্যানের গতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকার দিকটি সীমিত পরিসরে উন্মোচন করা। এক্ষেত্রে কাব্যে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, কবি দেবীদের অলৌ্কিক মহিমার কথা জেনেও রক্তমাংসের মানুষের মত করে উপস্থাপন করেছেন।মানুষের দোষ-গুণের মত দেবীদের দোষ-গুণ গুলিও ব্যক্ত করেছেন। তবে, তিনি দেবীদের অপব্যবহার করেননি। দেবীদের কাছে মানুষ যে অসহায় এই দিকটিই যেন তাঁর মনকে বেশি করে নাড়া দিয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে তিনি গ্রীকপুরাণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বলে জানা যায়। ১
সরস্বতী বা ভারতী
কাব্যের সূচনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কবি গতানুগতিকতার পথে যাননি। কেননা, তিনি কাব্য শুরু করেছেন প্রাচ্য কাব্য, নাটক-এর মত নান্দী, স্তুতি বা মঙ্গলাচরণ না করে, সরস্বতী বা ভারতী দেবী বন্দনার মধ্য দিয়ে, এভাবে-
‘বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি
আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি!’২
বারুণী
সমুদ্রের মন্থনের ফলে ক্ষীরদসাগর থেকে উত্থিত দেবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বারুণী। তিনি বরুনাণী, জলদেবী এবং বরুণদেবের স্ত্রী নামে পরিচিতা। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে প্রথম সর্গে বিভিন্ন দেবীদের মত বারূণী দেবীর পরিচয় পাওয়া যায়। চরিত্রটি সৃষ্টির মূলে মধুসূদন মিল্টনের স্যাব্রিনা চরত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে যোগীন্দ্রনাথ বসু বলেছেন –
“মেঘনাদবধের এই বারুণী-চরিত্র হিন্দুপুরাণানুমোদিত নহে, হোমরের থেটিস (Thetis) হইতে মিল্টন পর্যন্ত তাঁহার কোমাস (comus) কাব্যের স্যাব্রিনার (Sabrina) আদর্শ গ্রহণ করিয়াছিলেন। মাইকেলের বারুণী-চরিত্র এই স্যাব্রিনা হইতে কল্পিত।…” ৩
কাব্যের প্রথমেই দেখা যায়, যুদ্ধে বীরবাহুর মৃত্যু হলে চিত্রাঙ্গদা বীরবাহুর মৃত্যুর জন্য রাবণকে দায়ী করেন। একদিকে পুত্রের মৃত্যুর শোক, অপরদিকে চিত্রাঙ্গদার নির্মম প্রতিবাদ ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের ফলে রাবণ নিজেই যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত হন এবং তাঁর সৈন্যদের পদভরে সমগ্র লঙ্কা এমনকি, স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল পর্যন্ত কম্পিত হতে শুরু করে। এর কারণ জানার জন্য বারুণীদেবী তাঁর সখী মুরলাকে লক্ষ্মী দেবীর কাছে পাঠালে লক্ষ্মী দেবী জানান, চারদিক থেকে লঙ্কার বিপদ আসন্ন। আখ্যানে শোনা যায়-
কহিলা বারুণী পুন;
“সত্য, লো স্বজনি,
বৈদেহীর হেতু রাম রাবণে বিগ্রহ।
রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী মমপ্রিয়তমা সখী।
যাও শীঘ্র তুমি তাঁহার সদনে,
শুনিতে লালসা মোর রণের বারতা।”৪
সুতরাং, দেবীরা যে মানুষের কার্যকলাপ বিষয়ে একেবারে উদাসীন নন, সেই দিকটিই যেন প্রকাশ পেয়েছে বারুণীদেবীর উদ্যোগে মুরলার মাধ্যমে লক্ষ্মীদেবীর কাছ থেকে লঙ্কার খবর সংগ্রহের মাধ্যমে।
লক্ষ্মী
লক্ষ্মী হল ধনসম্পদ, সৌভাগ্য, সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যের দেবী। সেইসঙ্গে তিনি বিষ্ণুর পত্নী ও বিষ্ণুর শক্তির উৎসও বটে। তাঁর রূপ কাঞ্চনবর্ণা ও উজ্জ্বল। এঁর জন্ম হয় মহর্ষি ভৃগুর উরসে ও তার স্ত্রী দক্ষ-কন্যা খ্যাতির গর্ভে। ৫
কাব্যের প্রথম সর্গে লক্ষ্মীদেবীর পরিচয় পাওয়া যায়।লক্ষ্মীদেবীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি লঙ্কার বিপদের কথা।তিনি মুরলাকে বলেছেন-
“হায় লো স্বজনি,
দিন দিন হীন- বীর্য্য রাবণ দুর্ম্মতি,
যাদঃ-পতি-রোধঃযথা চলোর্ম্মি-আঘাতে!
শুনি চমকিবে তুমি।…”
“হায়, সখী,বীরশূন লঙ্কাপুরী!” ৬
রাবণের অত্যাচারে লঙ্কার বিপদ জেনে তিনি লঙ্কা ছাড়তে ইচ্ছুক।কিন্তু রাবণের ভক্তির কাছে তিনি যেন পরাজিত। তাঁর মুখে শোনা যায় –
“যতদিন বাঁচে
রাবণ,থাকিব আমি বাঁধা তার ঘরে ।” ৭
এরপর, মুরলা লক্ষ্মীদেবীর কাছে মেঘনাদের যুদ্ধে অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে, লক্ষ্মীদেবী এর উত্তরে জানিয়েছেন –
“প্রমোদ-উদ্যানে বুঝি ভ্রমিছে আমোদে,
যুবরাজ, নাহি জানি হত আজি রণে
বীরবাহু;…” ৮
মেঘনাদের এই সংবাদটুকু জানিয়েই লক্ষ্মীদেবীর ভূমিকা শেষ হয়ে যায়নি। এরপর দেখা যায়, প্রভাষার ছদ্মেবেশে মেঘনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলছেন-
“মেঘনাধাত্রী নামে প্রভাষা রাক্ষসী।
তার রূপ ধরি রমা,মাধব-রমণী, . . .
ইন্দ্রজিৎ ,প্রণমিয়া ,ধাত্রীর চরণে,
কহিলা-
‘কি হেতু ,মাতঃ,গতি তব আজি
এভবনে ?কহ দাস লঙ্কার কুশুল।. . .
হায়!পুত্র,কি আর কহিব
কনক লঙ্কার দশা!ঘোরতর রণে,
হত প্রিয় ভাই তব বীরবাহু বলী! . . .” ৯
মায়াদেবী
মায়াদেবী নিয়ে আলোচনার আগে রতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। রতি হল কন্দর্পের স্ত্রী এবং দক্ষের কন্যা। প্রজাপতি দক্ষ নিজের কন্যা রতিকে দেখিয়ে কন্দর্পকে বলেছিলেন, এ তাঁর দেহজাত কন্যা এবং গুণে কন্দর্পের অনুরূপ। একথা বলে, দক্ষ নিজের শরীর থেকে স্বেদজলস্মভূতা কন্যাকে রতি নাম দিয়ে কন্দর্পের হাতে সমর্পণ করেন।এই কামপত্নীকে দেখে দেবতারা এর প্রতি অনুরক্ত হন।মহাদেবের কোপে কন্দর্প ভস্মীভূত হলে রতি কন্দর্পকে পুনর্জীবিত করবার জন্য মর্ত্যলোকে মায়াবতীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। ১০
এই মায়াদেবীর পরিচয় পাওয়া যায় ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের আখ্যানে। কাব্যের কাহিনি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে মায়াদেবী। তাঁর ভালো রূপের পাশাপাশি কখনো কখনো হিংস্ররূপেরও সাক্ষাত পাওয়া গেছে। মায়াবল দ্বারা তিনি যেভাবে লক্ষ্মণকে সহযোগিতা করেছেন নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইন্দ্রজিতকে নাশ করার জন্য তা তাঁর মুখেই শুনে নেওয়া যাক-
“হে,লক্ষ্মণ,আজ সমস্ত দেবদেবী তোমার উপর সন্তুষ্ট হইয়াছেন।শিবের আদেশে আমি ইন্দ্রপ্রদত্ত অস্ত্র লইয়া তোমাকে তাহা দিতে আসিয়াছি।এই অস্ত্র লইয়া বিভীষণসহ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করিয়া ইন্দ্রজিতকে বিনাশ কর।আমি মায়াবলে তোমাদিগকে অদৃশ্য করিয়া রাখিব।. . .” ১১
এরপর দেখা যায়, মায়াদেবী লক্ষ্মীদেবীর স্বর্ণগৃহে আসেন। এসে লক্ষ্মীদেবীকে তাঁর আসার কারণ জানান এবং সবশেষে লক্ষ্মণদের সাহায্যের কথা জানান-
“সম্বর,নীলাম্বুসুতে ,তেজঃতব আজি;
পশিবে এ স্বর্ণপুরে দাবাক্রিতি রথী
সৌমিত্র;নাশিবে শূর,শিবের আদেশে ,
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে দম্ভী মেঘনাদে।
…
সুপ্রসন্ন হ ও ,দেবি,করি এ মিনতি,
রাঘবের রতি তুমি!তার ,বরদানে ,
ধর্ম্মপথ – গামী রামে,মাধবরমণি!” ১২
মায়াদেবীর আশীর্বাদ নিয়ে রাম-লক্ষ্মণ যখন যাচ্ছেন তখন পথে সেতু দেখে তাঁরা অবাক ও বিস্ময় হলে মায়াদেবী সেই সেতুর যে বর্ণনা করলেন তাতে উঠে এল অনেক অজানা তথ্য। এপ্রসঙ্গে তা উল্লেখযোগ্য-
“কামরূপী সেতু,
সীতানাথ ; . . .কিন্তু যবে আসে পুণ্য-প্রাণী,
প্রশস্ত, সুন্দর, স্বর্গে স্বর্ণপথ যথা!
ওই যে আত মা দেখিছ, নৃমণি, ত্যজি দেহঅ অগণ্য ভবধামে, আসিছে সকলে
প্রেতপুরে, কর্মফল ভুঞ্জনিতে এ দেশে।
ধর্ম্মপথগামী যারা যায় সেতুপথে
উত্তর; পশ্চিম, পূর্ব্বদ্বারে; পাপী যারা
সাঁতারিয়া নদী পার হয় দিবানিশি
মহাক্লেশে; যমদূত পীড়য়ে পুলিনে,
জলে জ্বলে পাপ-প্রাণ তপ্ত তৈলে যেন!
চল মোর সাথে তুমি; হেরিবে সত্বরে
নরচক্ষুঃ কভু নাহি হেরিয়াছে যাহা।” ১৩
মায়াদেবীর এই সহযোগিতার বিষটি রামও ভুলতে পারেননি। তাই তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলছেন-
“কত যে অদ্ভুত কান্ড দেখিনু পুরে,
তোমার প্রসাদে,মাতঃ, কে পারে বর্ণিতে?”
এ কথার উত্তরে মায়াদেবী জানান-
“অসীম এ পুরী,
রাঘব,কিঞ্চিৎ মাত্র দেখানু তোমারে।” ১৪
চন্ডী
চন্ডীদেবীর পরিচয় পাওয়া যায় মার্কেন্ডেয় পুরাণে। মার্কেন্ডেয় পুরাণে তাঁকে ভগবতী, পরমেশ্বরী, অম্বিকা, দুর্গা, গৌরী, কাত্যায়নী, শিবদূতী, শাকম্ভরী, ভীমা, কৌশিকী, কালী বা চামুন্ডা ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু কখনো তাঁকে হিমালয় কন্যা উমা বলে অভিহিত করা হয়নি। তবে, সেখানে তাঁকে তিনবার পার্বতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে পর্বত কন্যা পার্বতীর পরিবর্তে পর্বতবাসিনি পার্বতী রূপে। সুতরাং এর থেকে খুব সহজেই বোঝা যায় যে, দেবীরূপে চন্ডীর ধারা ভারতবর্ষের প্রাচীন দেবী পার্বতী-উমার ধারা থেকে পৃথক। তবে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিন কালের তিনটি প্রধান ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর মহিমা প্রচারিত হয়েছে। ঘটনাগুলি হল-দেবীর সাহায্যে বিষ্ণুর দ্বারা মধুকৈটভ অসুর বিনাশ, স্বয়ং দেবীর দ্বারা মহিষাসুর নিধন এবং দেবীর দ্বারা শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদের বধ। ১৫ আসলে তিনি ছিলেন প্রাচীন বাংলাদেশের অনার্য দেবী। তাঁর আবির্ভাব ঘটে প্রাচীন বাংলার তন্ত্র সাধনায়। ১৬
আলোচ্য কাব্যে দেবী চন্ডীর সাক্ষাত মেলে। কাব্যের পঞ্চম সর্গে কবি অত্যন্ত সুকৌশলে চন্ডীকে উপস্থাপন করেছেন। লক্ষণের তুলনায় মেঘনাদকে বড় করে দেখাবার জন্য লক্ষণের দ্বারা চন্ডী পূজা এবং শেষে দেবী চন্ডীর বর প্রাদানের বিষয়টি দেখিয়েছেন। আখ্যানে চন্ডীর পরিচয় মেলে এভাবে-
“লঙ্কার উত্তরদ্বারে বনরাজী মাঝে
শোভে সর;কূলে তার চন্ডীর দেউল . . .’ ১৭
চন্ডীর অবস্থানের দিকটির বর্ণ্না বিভীষণ চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন।তিনি বলেছেন –
“আছে সে কাননে চণ্ডীর দেউল, -
আপনি রাক্ষস- নাথ পূজেন সতীরে
সে উদ্যানে আর কেহ নাহি যায় কভু
ভয়ে,ভয়ঙ্কর স্থল!” ১৮
সবশেষে বলা যায়,মেঘনাদবধ কাব্যে দেবীরা আখ্যানে গতি নিয়ন্ত্রণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। মধুকবি অত্যন্ত সচেতনভাবে দেবী চরিত্রগুলি ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মাধ্যমে যেন পুণ্যের জয়, পাপের পরাজয় ঘোষিত করতে চেয়েছেন। সেইসঙ্গে দেবীদের সহনশীল রূপের পাশাপাশি ভয়ংকর রূপটিকেও তিনি তুলে ধরেছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পুরাণের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। তবে, কবি দেবীদের উপস্থিতির মধ্যদিয়ে এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, মানুষের শক্তি সীমিত। সেই শক্তির দ্বারা তার পক্ষে সমস্ত কাজ করা সম্ভব নয়। কাজেই প্রয়োজন, দেবীদের দৈবশক্তি।
তথ্যসূত্র:
১। অধ্যাক শ্রীসুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত)- মেঘনাদবধ কাব্য, মডার্ণ বুক এজেন্সি লিঃ, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃ-২৩
২। দীননাথ সান্ন্যাল সম্পাদিত- মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, বামা পুস্তকালয়, কলকাতা, ২০০৭, পৃ-১
৩। অধ্যাপক শ্রীসুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত)- মেঘনাদবধ কাব্য, মডার্ণ বুক এজেন্সি লিঃ, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃ-৫১
৪। দীননাথ সান্ন্যাল সম্পাদিত-মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, বামা পুস্তকালয়, কলকাতা, ২০০৭, পৃ-৫
৫। শ্রী নির্মলেন্দু মুখোপাধ্যায়- ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, মডার্ণ বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ-২৮২
৬। পুস্তকালয়, কলকাতা, ২০০৭, পৃ-১ ২। দীননাথ সান্ন্যাল সম্পাদিত-মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, বামা পুস্তকালয়, পৃ-৮
৭। তদেব, পৃ-১৮
৮। তদেব, পৃ- ৯
৯। তদেব, পৃ-৯
১০। তদেব
১১। তদেব, পৃ-৩১৭
১২। তদেব, পৃ-৫০
১৩। তদেব, পৃ-৭০
১৪। তদেব, পৃ-৭৪
১৫। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত- ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, ভাদ্র ১৩৬৭, পৃ-৫০
১৬। চন্ডী উইকিপিডিয়া
১৭। দীননাথ সান্ন্যাল সম্পাদিত-মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, বামা পুস্তকালয়, কলকাতা,২০০৭, পৃ-৪০
১৮। তদেব, পৃ- ৪০
ড. মানচিত্র পাল
অতিথি সহকারী অধ্যাপক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়, হোজাই, আসাম
There are no reviews yet.