চর্যাপদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
পৃথিবীর যেকোন ভাষা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আদি পূর্বে তার কাব্যধারাটিই প্রাধান্য লাভ করেছিল। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক যুক্তি নির্দেশ করা যেতে পারে। সাহিত্যের আদি পর্বে লিপি আবিষ্কৃত হয়নি এবং পরবর্তীতে যখন এর আবিষ্কার হয় তখন তার লেখার কৃৎকৌশল কম লোকেরাই জানতে পেরেছেন। দ্বিতীয় মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহার তখন কারোরই জানা সম্ভবপর ছিল না, যার দরুণ মুদ্রিত গ্রন্থ বলে কোন বস্তু তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে সাহিত্য বিষয়ক বস্তু মুখ্যত স্মৃতি ও শ্রুতিবাহিত হয়ে বিস্তার লাভ করেছিল। যাদের লিপি সম্পর্কিত কিছু তথ্য জানা ছিল বা লিপি বিষয়ে জ্ঞান ছিল তা পুঁথিতে প্রণয়ন করতেন। তবে স্মৃতি ও শ্রুতিই ছিল রচনা সম্প্রসারণের মুখ্য মাধ্যম। স্বভাবতই সুর, তাল, লয়, ছন্দ এবং সঠিক গতি সমন্বিত শ্রুতিসুভগ পদ স্মৃতিধার্য হয় সহজে। ফলে আমরা বুঝতে পারি যে কোনো ভাষা সাহিত্যের আদি পর্বের কাব্যধারাটি প্রবল এবং মুখ্যত রূপ ধারণ করে।
স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে বাংলা কাব্যধারার আদি নিদর্শন কোনটি। সে নিয়ে সাহিত্যের মধ্যে ইতিহাসের অনুসন্ধান শুরু হয়। ১৩০৫ সনের "সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায়' ইতিহাস রচনার প্রণালী প্রবন্ধে রজনীকান্ত গুপ্ত লিখেছিলেন -
"দরিদ্র মুকুন্দরামের সংগীতের সহিত তদানীন্তন বঙ্গীয় সমাজের ইতিবৃত্ত জড়িত রহিয়াছে। আদি কবি কৃত্তিবাসের গ্রন্থের বিশ্লেষণ করিলেও সেইসময়ের বাঙ্গালী চরিত্রের আভাস পাওয়া যাইতে পারে।'
১৩০৫ সালের কার্তিক সংখ্যার সাহিত্য পত্রিকায় লেখকের নাম বিহীন রচনা "সাহিত্যপঞ্জি' প্রকাশিত হয়েছিল - পুরনো বাংলা সাহিত্যের ভাষা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সেখানে ছিল। ঊনিশ শতকের পুরনো বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন সহজলভ্য ছিল না। পরবর্তীতে পুঁথি আবিষ্কৃত হলে নানা ধরনের প্রযুক্তিগত পদ্ধতিতে পুঁথিটিকে প্রকাশের যোগ্য করে তোলা হতো। তারপর গ্রন্থাকারে পুঁথিটি মুদ্রিত হলে কাব্যটি সাধারণ পাঠকের বিষয় হয়ে উঠতো।
চর্যাপদের আবিষ্কার প্রসঙ্গ
১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্হাগার থেকে বেশ কিছু বৌদ্ধগান ও দোহা পান এবং সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া আদি নিদর্শন 'চর্যাপদ' আবিষ্কার করেন। এই যুগান্তকারী নিদর্শন আবিষ্কারের পর বোঝা যায় বাঙালির জাতিসত্তার ঐতিহ্য যে সহস্র বছর পুরনো তত্ত্ব তি বিশ্বসাহিত্য দরবারে তথ্য-প্রমাণসহ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা জানি ভাষা ছাড়া জাতিসত্তা গড়ে উঠে না, সেই ভাষা কোথা থেকে এলো তার প্রাচীনত্ব কতখানি তা ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান প্রসঙ্গ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর "হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধগান ও দোহা' গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন-
"ঊনিশ শতকের শেষার্ধে বিদ্যাসাগর রচিত বাংলা গ্রন্থগুলির পঠন-পাঠনের জোর দেওয়া হয়।চারিদিকে বাংলা বিদ্যালয় স্থাপিত হতে থাকে, সাধারণ মানুষ বিদ্যাসাগরের "বর্ণপরিচয়', "বোধোদয়', "চরিতাবলী', "কথামালা' পড়ে বাংলা শিখতে ও লিখতে শুরু করেছিল। বাংলা ভাষা সাহিত্য আছে বা বাংলা সাহিত্যের একটি ইতিহাস আছে, সে কথা অনেকের জানা ছিল না। এরপরেও লোকের ধারণা ছিল বাংলা একটি নতুন ভাষা, এতে সমস্ত রকম ভাব প্রকাশ করা যায় না...'
১৮৮৬ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বেঙ্গল লাইব্রেরীর গ্রন্হগারিক পদে যোগ দেওয়ার সময় অনেক পুঁথি সংগ্রহে আগ্রহী হন। যার দরুন সোসাইটির দায়িত্ব পেয়ে ১৮৯৭ এবং ১৮৯৮ সালে দুবার নেপালে যান। প্রথম দুবার নেপাল গিয়ে কয়েকটি সংস্কৃতি পেলেও ১৯০৭ সালে তৃতীয় বারের জন্য নেপাল গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি পুঁথি আবিষ্কার করে। সেগুলি হল- ১) চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়, ২) সরোরুহ বজ্রের অথবা সরোজ বজ্রের দোহাকোষ এবং অদ্বয় বজ্রের সংস্কৃত টীকা ৩) কৃষ্ণচার্য্যপাদের দোহাকোষ এবং মেখলা ৪) ডাকার্ণব। পরবর্তীতে চারটি পুঁথিকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে "হাজার বছরের পুরনো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা' নামে প্রকাশ করেন।
চর্যাপদ আবিষ্কারের পূর্বে সাহিত্যের ইতিহাসের গবেষকরা মনে করতেন ময়নামতীর গান, গোরক্ষ বিজয়, শূন্যপুরাণ, ডাক ও খনার বচন এগুলোই ছিল প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন। কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয়ের চর্যাপদ আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি নতুন দিক উন্মোচন করল। যদিও চর্যাপদের নাম নিয়ে পণ্ডিত মহলে মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে গ্রন্থটির নাম চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়, কারও মতে চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়, আবার কেউ কেউ মনে করেন গ্রন্থটির প্রাচীন নাম "চর্যাগীতিকোষ'। শাস্ত্রী মহাশয় মনে করেছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত পুঁথিটি চর্যাগীতি সংগ্রহের মূল পুঁথি এবং সংগৃহীত গানের নাম চর্যাপদ। গ্রন্থটির নাম চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়। চর্যাপদের টীকাকারের নাম মুনিদত্ত এবং ১৯৫৬ সালের ড• প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তিবিক্ষুর যুগ্মসম্পাদনায় বিশ্বভারতী থেকে এর তিব্বতী অনুবাদের পুঁথি প্রকাশিত হয়। অনুবাদ গ্রন্থটি থেকে জানা যায় যে শাস্ত্রী মহাশয়ের পুঁথিটি খণ্ডিত ২৩, ২৪, ২৫ এবং ৪৮ সংখ্যক গীতিগুলোর তিনটি এবং একটি নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে টিকাগুলি লুপ্ত। চর্যাপদটি আসলে কিছু কবিতার সংকলন। এতে মোট ৫০টি পদ ছিল। কিন্তু কয়েকটি পদ নষ্ট হওয়ার কারণে সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ পাওয়া গেছে। "চর্যাগীতিকোষবৃত্তি' যেহেতু ১০০টি পদে সম্পূর্ণ ছিল তার থেকে মুনিদত্ত ৫০টি টীকা লিখেছিলেন, তাই চর্যার অনেক টীকা "নির্মলগিরা' নামক টীকায় বাদ পড়ে গেছে। দশ এবং এগারো সংখ্যক পদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীদের একটি চর্যা মুনিদত্ত নির্বাচন করেননি। তাই নির্বাচিত চর্যার সংখ্যা ৫০টি এর পরিবর্তে ৫১ টি ও হতে পারে।
চর্যার দর্শন-তত্ত্ব-ধর্ম
তত্ত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে চর্যাগীতিগুলিতে দুটি দিক প্রাধান্যতা লাভ করে- একটি দর্শন তত্ত্বের দিক এবং আরেকটি সাধনতত্ত্বের দিক। কিন্তু দর্শনতত্ত্বের দিক থেকেও সাধনতত্ত্বের দিকটি প্রধান হয়ে উঠেছে। চর্যাগীতিতে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ধর্মসাধনার প্রণালি প্রাধান্য পেয়েছে। সহজানপন্হী বৌদ্ধধর্ম সাধকদের সাধনার প্রক্রিয়াই চর্যার বিষয়বস্তু। তিব্বতি ভাষায় এই বৌদ্ধ সাধককে বলা হয় সিদ্ধাচার্য। তার ধর্মসাধনায় সহজ মার্গের পথিক। তান্ত্রিক হটযোগ বা দেহসাধনার দ্বারাই সিদ্ধাচার্যরা জন্ম-মৃত্যু ও জাগতিক সুখ দ:খের অতীত নির্বিকল্প সুখ উপভোগ করতে চান। দেহসাধন, ত্রি-নাড়ীতত্ত্ব ও মহাসুখ লাভই চর্যার বিষয়বস্তু। সহজীয়া সাধকরা তন্ত্র মন্ত্র ও আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধী। তাদের মধ্যে দেহ সাধনার মধ্য দিয়েই আরাধ্য দেবতাকে লাভ করা যায়। সেজন্য তারা পূজা অর্চনা এবং সংস্কারগত বাধা পথের কোনো ধার ধারেন না। তারা বলেন -
"উজুরে উজু ছাড়ি মা লেহুরে বঙ্ক।
নি আহি বহি মা জাহুরে লঙ্ক।।'
অর্থাৎ সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথে যেওনা। নিকটেই বহি রয়েছে তার জন্য লঙ্কায় অর্থ দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধকদের মধ্যে মানুষের দেহে অজস্র শিরা-উপশিরা বর্তমান। তাদের মধ্যে প্রধান তিনটি ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না প্রথম দুটি গতি নিম্নমুখী আর সুষুম্নার গতি নাভিদেশ থেকে মস্তিষ্কের ঊর্ধ্ব দিকে। সুষুম্না হচ্ছে অবধূতিকা বা অবধূতী- তার আরেক নাম সহজসুন্দরী। তাকে শুণ্ডিনী, চণ্ডালী, ডুম্বী ও নৈরামণি বলা হয়েছে। চর্যার সাধকরা দেহ সাধনার মহাসুখ অনুভব করতেন। দেহের তিনটি নাড়ী ছাড়া সাধকরা দেহের মধ্যে চারটি চক্র বা পদ্মের কথা বলেছেন। প্রথম চক্র নাভিতে, নাম- "নির্মাণ চক্র', দ্বিতীয় চক্র হৃদয়ে, নাম- "ধর্মচক্র', তৃতীয় চক্র কন্ঠে, নাম- "সম্ভোগচক্র' এবং চতুর্থ চক্র মস্তকে অবস্থিত, নাম- "সহজচক্র' বা "মহাসুখচক্র'। এই সহজ চক্রেই বোধিচিত্তের অবস্থান। সেই বোধিচিত্ত যখন নির্মাণ চক্রে উৎপন্ন হয় তখন সাধকের আনন্দ অনুভূতি জাগে। ধর্মচক্রে বোধিচিত্তের অবস্থানে পরমানন্দ সম্ভোগচক্রে অবস্থান করে সহজানন্দ। চর্যাগীতিতে এই জগতকে মিথ্যা মায়াময় বলা হয়েছে। চর্যার সাধনা গুরুমুখী। সাধনার পর বড়ই দুর্গম ও রহস্যাবৃত। সেই দুর্গম যাত্রায় গুরুই একমাত্র পথ প্রদর্শক। তারা বিশ্বাস করেন দেহের চেয়ে শুভ তীর্থ আর নেই। দেহের মধ্যেই বুদ্ধ বাস করেন।
চর্যা : সাধ্য ও সাধন তত্ত্ব
চর্যাপদের একটি বিশেষ সম্প্রদায় হল সহজিয়া, যারা সহজ পথে সাধনা করে। সহজ শব্দের অর্থ যা মানুষের স্বভাব পথের অনুকূল আর যা প্রতিকূল তা-ই বক্র। সহজিয়াপন্থীদের লক্ষ্য হলো মনুষ্য স্বভাবকে কোনো ভাবে উপেক্ষা না করে বরং স্বভাবের মধ্য দিয়ে আত্মোপলব্ধি চেষ্টা করা। সহজিয়াপন্থীদের বিশ্বাস সাধনার লক্ষ্য যিনি, তিনি জ্ঞানসরূপ, তাঁর অবস্থান দেহের মধ্যে দেহের বাইরে নয়। সুতরাং তারা মনে করেন, দেহকে বাদ দিয়ে কোন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। চর্যাগীতিগুলিতে যে ধর্মসাধনার কথা আছে তা হলো "মহাসুখতত্ত্ব'। বৌদ্ধসাধকদের বিশ্বাস ছিল যে বারবার ভবঘুরে মরতে হয় এবং তার ফলে পৃথিবীতে মনুষ্য জন্ম নিয়ে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় সাধনার দিয়ে বিচার করলে বৌদ্ধ সহজিয়া পন্থীদের সাধনার মূল বিষয় হচ্ছে তান্ত্রিকতার তন্ত্রসাধনার বাইরের দিক গুলি ঘোর বিরোধিতা করতেন সহজিয়া সাধকরা সাধনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধি লাভ করা যায় তা ছিল তাদের মূল মন্ত্র তাদের এই মতামতের উপর ভিত্তি করে যে ধর্ম গড়ে ওঠে তা হলো সহজিয়া ধর্ম এবং এই ধর্মঘট নিয়ে যে সাহিত্য গড়ে ওঠে তা হলো সহজিয়া সাহিত্য নামে পরিচিত সহজবোধ্য শিয়াদের মতবাদ তারা মনে করেন বজ্রযানী বন্ধুদের মধ্যে তন্ত্র মন্ত্র পূজার ব্রতচারী তাদের প্রবণতা দেখা দিলে তাদের একটি অংশ উপলব্ধি করেছে শাস্ত্র আচার পালন নিরর্থক তারা মনে করেন প্রত্যেক মানুষের মন মানুষের মধ্যে বিরাজমান এবং সহজসাধ্য নয় তাকে উপলব্ধি করতে পারলে মোক্ষলাভ করা যায়।
"সহজানন্দ রূপ বা মহাসুখরূপ পরম সত্যকে দেহের মধ্যে উপলব্ধি করতে গিয়ে বৌদ্ধ সহজিয়ারা দেহের মধ্যে কতগুলি পদ্ম বা চক্র কল্পনা করেছেন। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের ত্রিকায় এর সঙ্গে এটি সহজকায় যোগ করে চার চক্রে, চার পদ্ম স্থাপন করেছেন।'
হিন্দু ধর্মে যে শ্রেষ্ঠ চক্র কল্পনা করা হয়েছে, বৌদ্ধ ধর্মে সেটিই হয়েছে চার চক্র বা পদ্ম। হিন্দু ধর্মে ষষ্ঠ চক্রগুলি হলো- গুহ্যদ্বার, নাভি, বক্ষ, কণ্ঠ, দুটি ভ্রূ-র মধ্যস্হল এবং মস্তিষ্ক। বৌদ্ধধর্মে সেটিকে চারচক্র বলা হয়।
১) নাভিতে নির্মাণ চক্র
২) হৃদয়ে ধর্মচক্র
৩) কণ্ঠে সম্ভোগচক্র
৪) মস্তিষ্কে - উষ্ণীষচক্র, সহজ চক্র।
তন্ত্রে বলা হয়েছে মানব শরীরে দুটি নাড়ী- শরীরের বাম দিকে থেকে যে নাড়ী প্রবাহিত হয় তাকে বলে ইড়া এবং ডান দিকে থেকে যে নাড়ী প্রবাহিত হয় তাকে বলে পিঙ্গলা। বৌদ্ধতন্ত্রে এগুলি হল যথাক্রমে শূন্যতা এবং করুণা। আবার, মেরুদন্ডের মাঝখানে দিয়ে যে নাড়ী প্রবাহিত হয়েছে তাকে বলা হয় সুষুম্না। কিন্তু বৌদ্ধতন্ত্রে তার নাম "অবধূতিকা'।
এই প্রসঙ্গে বীণাপাদ- এর একটি পদের উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে অবধূতীকে মাঝখানের দণ্ড করে দেহকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করেছেন এবং এই বীণা বাজিয়েই তিনি সহজের সাধনায় মগ্ন হয়েছেন -
"সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী।
অণাহা দাণ্ডী বাকি কিঅ অবধূতী।'
মহাসুখ লাভের ক্ষেত্রে সহজিয়া সাধকরা দেহে তিনটি নাড়ী এবং চারটি চক্রের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু অন্যদিকে বাইরের আরম্ভর, অনুষ্ঠান, শাস্ত্রপাঠ, তন্ত্র-মন্ত্র সবকিছু পরিত্যাগ করতে বলেছেন। সহজিয়া বৌদ্ধ তান্ত্রিক বা সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদের মধ্যে তাদের তন্ত্র সাধনার মন্ত্র গোপনে বেঁধে রাখতেন। যারা তন্ত্র সাধনা করেন, কেবল তারাই সেই মন্ত্র বুঝতে পারতেন। যোগ সাধনা কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করতে পারলে যে অমরত্ব লাভ করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধাচার্য বিরুবা একটি অদ্ভুত চর্যাপদ রচনা করেন, যার সাধারণ অর্থ ও ভাবগত অর্থ উভয়েই ভীষণ জটিল ও অর্থবহ।
"এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ।।
...
এক সে ঘরলী সরুই নাল।
ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল।।'
সহজিয়া বৌদ্ধ সাধন তত্ত্ব মতে মানব দেহে মেরুদন্ডের নিম্নদেশে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে রয়েছে একটি মূলাধার চক্র। মূলাধার চক্রটি একটি গ্রন্থি। বহির্মুখী চিত্তবৃত্তি অর্থাৎ প্রাণ এবং অপ্রাণবায়ুকে বিপরীত পথে চালিত করে মূলাধার চক্রে স্হিত কমকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে অবধূতী নানা মার্গ, নানা চক্র বা পদ্ম পার হয়ে মস্তিষ্কে শিব শক্তি বা পুরুষ প্রকৃতির মিলন এবং একইভাবে নির্বাণ লাভের কথা বলা হয়েছে।
তন্ত্রে ইড়া ও পিঙ্গলা বৌদ্ধ পরিভাষায় প্রজ্ঞা ও উপায়রূপে কথিত হয়েছে। চর্যার কবিতাগুলিতে এই শব্দযুগলকে ধমন - চমন, ললনা-রসনা, নাদ-বিন্দু, অলি-কলি ইত্যাদি বিচিত্র নামে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের লক্ষ্য নির্বাণ বা বোধিসত্ত্বা অবস্থা অর্জন। আর সেই লক্ষ্যে শূন্যতা বা করুণার অদ্বয় সংকল্প স্থাপন করতে হবে দেহ সাধনার এই জটিল ক্রিয়াচারের মাধ্যমে।
চর্যাপদের সমাজ জীবন
সাহিত্য হচ্ছে জীবনবেদ। চর্যার বিষয়বস্তু মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। কিন্তু ধর্মাশ্রিত বলে চর্যার সাহিত্যিক উৎকর্ষতার বিন্দুমাত্র কমেনি। চর্যার নর-নারীর বিচিত্র কাহিনী, বাংলাদেশের গাছপালা, নদ-নদী, খাল-বিল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব শিল্পমূল্য লাভ করেছে। খরস্রোতা নদীর বর্ণাঢ্য চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে চর্যাকাররা লোভ মায়া-মমতা জড়িত অশান্ত ও অস্থির ক্ষণস্থায়ী মানব জীবনকেই ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন। শব্দে ছন্দে অলংকারে সে বর্ণনা চিত্র রূপময়। কবি চাটিল পা বলেছেন-
"ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দু আন্তে চিখিল মাঝেঁ ন থাহী।।
ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই।
পারগামী লোঅ নিভর তয়ী।।'
অর্থাৎ ভবনদী গভীর ও প্রবল বেগে প্রবাহিত। সেই নদীর দুই তীর কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। ধর্মের জন্য চাটিল সেই নদীর উপর সাঁকো তৈরি করলেন। পরপারে যাওয়ার ইচ্ছুক যাত্রীরা সেই সেঁতুর উপর দিয়ে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারবে।
হরিণ শিকারের কাহিনীতে পশু জীবনের অব্যক্ত মর্ম যন্ত্রণার মধ্যে মুক্তি পিপাসু মায়াবদ্ধ মানবাত্মার ক্রন্দন ধ্বনিত হয়েছে -
"আপনার মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ না ছাড়হ ভুসুক আহেরী।।'
চর্যার সুষুম্না হচ্ছে সহজ সুন্দরী। তাকে যোগিনী, ডোম্বী ও শবরী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। সুষুম্নার প্রসঙ্গে চর্যাকাররা রোমান্টিক প্রণয় ও ভোগের সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন। শবর পার পদে পাই -
"উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই শবরী বালী।
মোরঙ্গি পিচ্ছল পরহীন শবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।'
অর্থাৎ উঁচু উঁচু পর্বতের বাস করে শবরী বালিকা। তাঁর মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা। নানা তরুবর মুকুলিত হলো- তার ডালপালা আকাশ ছুঁয়ে গেল। শবর শবরীর জন্য পাগল কামনার রঙে তাদের হৃদয় জীবন রঙীন ও উত্তাল। অনুরূপ দেহানুরাগের অনুভূতি গুণ্ডরী পার একটি পদে পাওয়া যায় -
"জোইনি তঁই বিনু ক্ষনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কোমল রস পীবমি।।'
অর্থাৎ যোগিনী তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্তও বাঁচবো না। তোমার মুখ চুম্বন করে আমি কমল রস পান করব।
চর্যাগীতিতে যে সমস্ত উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটেছে বেশি। নদী নৌকা, নদীর উপর সাঁকো, দাঁড়টানা, গুনটানা, পালতোলা, সেঁউতি, খুণ্টী, উজান বাওয়া প্রভৃতি নদী ও নৌকা সংক্রান্ত অনেক বিষয়ের উল্লেখ চর্যাগীতিতে পাওয়া যায়। নদী সংক্রান্ত অনেক বিষয়ের উল্লেখ চর্যাগীতি পাওয়া যায়। কাহ্ন পার একটি চর্যায় জাল ফেলে মাছ ধরার কথাও আছে। ডোম, শবর ও চন্ডাল প্রভৃতি মানুষের নগরের বাইরে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করত। চর্যাকারেরা জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ডোম নারী ও চণ্ডাল নারী বিবাহের কথা চর্যায় পাওয়া যায়।
চর্যায় যে জনসমাজের কথা আছে তা মূলত অনার্য জনগোষ্ঠী। ডোমেদের প্রধান বৃত্তি ছিল ঝুড়ি, চাঙ্গারি তৈরি করা ও বিক্রি করা। এছাড়া মাদুর বোনা, তাঁতে কাপড় বোনা, মাছ ধরার কথাও রয়েছে। চর্যার যুগে পারিবারিক জীবন ছিল একান্নবর্তী। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ ও পুত্রবধূ সকলকে নিয়ে ছিল বিরাট পরিবার। উচ্চ শ্রেণির লোকদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারের কোনো অবকাশ না থাকলেও সমাজের নিম্ন শ্রেণির লোকেদের মধ্যে স্বেচ্ছাচার ছিল বলে মনে হয়।
পটহ, মাদল, দুন্দুভি প্রভৃতি নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বেশ ঘটা তখন বিয়ে হতো। সেকালে বাঙালিরা অবসর সময়ে খেলাধুলা করত। খেলাধূলার মধ্যে দাব খুবই জনপ্রিয় ছিল। গয়নার মধ্যে নুপূর, কঙ্কন, মুক্তাহার, কাণেট ও কর্ণকুণ্ডলের উল্লেখ আছে। মুখ দেখা ও চুল বাঁধার জন্য আয়না ব্যবহৃত হতো। তাম্বুল বিলাসীরা কর্পূর দিয়ে পান খেতেন-
"হি অহি মহাসুহে কাপুর তাম্বুল খাঅ।'
বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে কাড়া-নাকাড়া, একতারা, কাঁসি, বীণা, বাঁশি ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। গৃহস্হ ঘরের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে হাঁড়- পেটা, ঘড়া ও গারুর উল্লেখ রয়েছে। খাদ্য ও পানীয়ের মধ্যে ভাত, দুধ, লাউ, মাছ, মাংস, মধু ও তেঁতুল প্রভৃতির উল্লেখ আছে। তাছাড়া সোনা ও রুপারও উল্লেখ পাওয়া যায় চর্যাপদে। চর্যাকাররা ধর্মসাধক হলেও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগতকে অস্বীকার করেননি। রূপ জগতের মধ্যে থেকেই তারা অরূপ লোকের সন্ধান করেছেন।
প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক পরিবেশ
বাংলা ভাষায় বাঙালির সাহিত্য রচনায় সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পরিচয় বিবৃত হয়েছে চর্যাপদে। পণ্ডিতেরা মনে করেছিলেন চর্যার সুপ্রাচীন কোনো কোনো পদ দশম শতাব্দীর মধ্যভাগেই রচিত হয়। কিন্তু মধ্যভাগে এটি সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়েছে যে চর্যাপদাবলীর রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে একাদশ কিংবা দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে। কিন্তু এই ইতিহাসের ইতিহাস আছে, চর্যার জন্মপূর্বে সেই প্রাচীন যুগে বাঙালির ক্রমবিকশিত জীবন চেতনায় বাংলা সাহিত্যের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন : "বাংলাদেশের বাংলা ভাষার মধ্যে দেশের জলবায়ু ও তার ফলস্বরূপ দেশের উপযোগী বিশেষ জীবনযাত্রার পদ্ধতিকে অবলম্বন করিয়া এবং মুখ্যত প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের ভাবধারায় পুষ্ট হইয়া গত সহস্ত্র বৎসর ধরিয়া যে বাস্তব মানসিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে তাহাই বাঙালি সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি বাংলা ভাষা সৃষ্টিকাল হইতে বাংলা ভাষায় রচিত যে সকল কাব্য কবিতার অন্য সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে তাহাই বাংলা সাহিত্য।'
সেই সময় পর্বে শৈব বৌদ্ধ সহজ সাধকেরা দেহতত্ত্বের সাধনা করতেন সেই সাধনার সংকেত নিহিত আছে চর্যাগীতিতে। চর্যার নীচ জাতির বৃত্তি ছিল ডালা, চাঙারী তৈরি করা, কাঠ কাটা বা নৌকা বানানো ও সাঁকো তৈরি করা, শিকার করা, তুলো ধূনা, ছদ্মবেশী নট্যের নৃত্যগীত ইত্যাদি। তৎকালীন মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবধারাগুলি চর্যাকাররা তাদের রচনায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
চর্যাগীতির মধ্যে দিয়ে সেকালের সাধারণ বা দরিদ্র জীবনের খন্ড চিত্র পাওয়া যায়। তখনও দরিদ্র বাঙালির "হাঁড়িত ভাত নাহি' অথচ অতিথির অভাব ছিল না। বিবাহে যৌতুকের প্রাধান্য ছিল এবং বর বিয়ে করতে যেত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে। যে অংশ তখন বঙ্গ নামে প্রসিদ্ধ ছিল সেই নিম্নবর্গের দরিদ্রতা নিচু জাতি বসবাস ছিল। তাই সেই দেশের মেয়ে বিয়ে করা যেমন নিন্দনীয় ছিল তেমনি বিয়ে হলে জাতিচ্যুত করা হতো। ভুসুক পাদ একটি পদে লিখেছিলেন -
"আজি ভুসুক বঙালী হইলি।
ঞ ঘরণী চণ্ডালি লেলী।।'
একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে অনেকগুলি পুরনো ধার্মিক উৎসব লোপ পেয়ে আসছিল। তার মধ্যে একটি হলো 'শত্রুধ্বজত্থান'।বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুন্নত পল্লী অঞ্চলে কোথাও কোথাও পথে-ঘাটে, ক্ষেত-খামারে, বনে - জঙ্গলে এখনো নানারকম এ ধরনের অপৌরাণিক দেব-দেবীর পূজা প্রচারিত আছে। ক্ষেত্রপাল, নেকড়াই চন্ডী, ঝগড়াই চন্ডী, দিদিঠাকুর, সন্ন্যাসী ঠাকুর ইত্যাদি দেবতা সেসময় পূজিত হতেন।
ধর্ম ছিলেন সেকালের ডোম জাতির দেবতা। তাই ডোমেরাই ধর্মপূজার প্রধান অধিকারী ছিল। ধর্ম ঠাকুরের আদি পূজায় শূকর, পাঠা বলি দেওয়া হতো। ধর্মের গাজনে ভক্তরা মুখোশ পরে মৃতদেহ, মরার মালা ইত্যাদি নিয়ে নৃত্যগীত করত। তাই এই নাচকে বলা হয় পাতা নাচ অর্থাৎ পাত্র নাচ। সেখানে নিত্য গীত ছিল দেবপূজার অঙ্গ। বিষ্ণু ও শিবের দেউলে দেবদাসী নাচগান হতো। ধর্মপূজার মধ্যে জাগরী অর্থাৎ সর্প দেবী মনসা পূজার বিধান আছে। এমন একাদশ শতাব্দীর আগে বৌদ্ধ মহাজন মতে তান্ত্রিক সাধনায় প্রবেশ করেছিলেন, জাঙ্গুলী অথবা আর্য জাঙ্গুলী রূপে।
প্রাচীনকালে নৃত্যগীত চর্চায় কবি পণ্ডিতেরাও বিমুখ ছিলেন না। যারা নাটক বৃত্তি করতেন তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা ছিল। স্বয়ং জয়দেব সংগীত কলায় পারদর্শী ছিলেন। প্রাচীনকালে পুরুষরা গান করত এবং মেয়েরা নাচতেো। চর্যাগীতিতে পাওয়া যায়-
"নাচন্তী বাজিল গান্তী দেবী।
বুদ্ধ নাটক বিষমা হই।।'
ষোড়শ শতাব্দী কোনো কোনো কাব্যে সমসাময়িক বাঙালির ভোজন বিলাসীতার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। পূর্ববর্তী কালের এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবুও একটু আধটু যা জানা যায়, তাতে মনে হয় যে বাঙালি তখন থেকে ভোজন রসিক ছিল। ভাত, দুধ, দই, ঘি, ক্ষীর, ছানা অবস্হাপূর্ণ বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল। খাঁজা, মোয়া, পিঠা, ফেনী, কদমা, ক্ষিরিশ, মন্তু, শালুক ইত্যাদি এখনো বাঙালির রসনা তৃপ্তি করে আছে। পাতলা দই-কে বলা হত "দ্রগড়'। অপ্রচলিত হয়েছিল "শিখরিণী' (ঘি, দৈ, গুড়, আদা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি) হাদুস ভাদুস ও ওলভ (যব বা ছোলার সিস বা গাছশুদ্ধ ঝলসানো) ও ভড়িত (শিক কাবাব) আর চাটনীর নাম ছিল গুড়শিতনা। যারা পিঠে তৈরি করে তাদেরকে বলা হত ছন্দবার। প্রাকৃত পৈঙ্গল নামে একটি ভাষায় শ্লোক পাওয়া গেছে তাতে বাঙালির ভোজন রসিকতা পাওয়া যায়।
"ওগগর ভওা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সযুত্তা
মইলি মচ্ছা নালীচ গচ্ছা দ্বিজ্জই কন্তা খা(ই) পুনবন্তা।'
অর্থাৎ, অগড়া ভাত, রম্ভা পাত, গাইয়ের ঘি, দুধ, মোরোলা মাছ, নালিতা শাক স্ত্রী দিচ্ছেন আর স্বামী খাচ্ছেন। সিহুলী অর্থাৎ শুটকি মাছ নিম্নশ্রেণির মানুষের, দরিদ্র আদিবাসীদের খুব প্রিয় খাদ্য ছিল। রান্নার পাত্রের বিভিন্ন নাম ছিল যেমন জাড়ি, ভাণ্ডি বা হাঁড়ি ইত্যাদি। তখনকার সময়ে মেয়েদের বেশভূষার উল্লেখ সমসাময়িক সাহিত্য থেকে কিছু পাওয়া যায়। সাধারণ ভদ্রমহিলা ও নিম্নবর্গের স্ত্রী লোকেরা এক বস্ত্র পড়ে থাকত এবং মাথায় ঘোমটা থাকতো। বিবাহিত মেয়েদের মাথায় সিঁদুর দেওয়ার প্রচলন ছিল। তখনকার মেয়েরা হাতে শাঁখা পড়ত এবং উপরের হাতে থাকত "বাহখড়'। গলার সাতস্বর বা দেবচ্ছন্দ হার, মাথায় হংস পাদিকা আর কানে শোনার তরঙ্গ অথবা কচি কলাপাতা তালপাতার তালিপত্র ব্যবহার করত। শুষ্ক কার্পাস বস্ত্র মেয়েদের মধ্যেই পড়তো। চতুর্দশ শতাব্দীকে "মেঘ উদুম্বর', "গঙ্গাসাগর', "লক্ষীবিলাস', "সিলহটি' ইত্যাদি বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। কপালে কাজলের টিপ, হাতে পদ্ম পাতার বালা বা তাগা, কানে কচি রিঠা ফুলের দুল পল্লী বঁধুরা পরিধান করত। জীবনের এই সহজ-সরল শান্ত আদর্শ আমাদের মনকে এখনো টানে, যদিও আমরা আজ সেখান থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি। তাই মধ্যযুগের সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসাবে "চর্যাপদ' শ্রেষ্টত্বের সঙ্গে সাহিত্য মহলে বিরাজমান।
তথ্যসূত্র
১) চর্যাপদ, অতীন্দ্র মজুমদার, নয়া প্রকাশ, কলিকাতা - ৬
২) চর্যাগীতি পরিক্রমা, ড• নির্মল দাস, কলকাতা - ৭০০০৭৩
৩) চর্যগীতি-রূপে রূপান্তরে,ড• স্বপন কুমার দে, কলকাতা - ৬৩
৪) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, শ্রীমন্ত কুমার জানা
৫) https://kisholoy.org/patrika/25/651
৬) https://www.blogghuri.info/2020/04/blog-post_49.html?m=1
প্রবন্ধ: অপরাজিতা ভট্টাচার্য
(প্রকাশিত ২৩.০৬.২০২১)
1 review
Sagor Mondal
15 Jan 2024
অসাধারণ