E-Learning Info
Go to content

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩ - ১৯১৫)

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক। বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। তিনি একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, বেহালাবাদক ও সুরকার ছিলেন।
জন্ম ও পরিবার:
উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ (১৮৬৩ সালের ১০ই মে) বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে। তাঁর পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন এবং আরবি ফারসি ও সংস্কৃতে সুপন্ডিত। কালিনাথ রায় শ্যামসুন্দর মুন্সী নামেও পরিচিত ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয়, তার আসল নাম কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তার পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন এবং তার নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পিতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা।
শিক্ষাজীবন:
সুপন্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্টপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়ণের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সাহিত্যজীবন:
একুশ বছর বয়সে বি.এ পাশ করে ছবি আঁকা শুরু করেন। এইসময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটদের জন্য লিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময়কালে "সাথী', "সখা ও সাথী', "মুকুল' ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত "বালক' নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তার লেখা প্রকাশ হতে শুরু করে। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় "সখা' পত্রিকায় তার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, রূপকথা, উপকথা, পৌরাণিক কাহিনি ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি রচনাসহ শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৮৮৬ সালে ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথমপক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়। উপেন্দ্রকিশোরের তিন ছেলে - সুকুমার, সুবিনয়, সুবিমল ও তিন কন্যা - সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় ১৯১৩ সালে বিখ্যাত শিশুতোষ মাসিক পত্রিকা 'সন্দেশ' প্রকাশিত হয়। দেশবিদেশের গল্প হাস্যকৌতুক জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা ইত্যাদি লেখার মাধ্যমে 'সন্দেশ'-কে  তিনি তরুণ হৃদয়ের যোগ্য একটি পত্রিকা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর শিশুকিশোরদের জন্য বহু সংখ্যক সাহিত্য পুস্তক রচনা  করেছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:
ছেলেদের রামায়ণ (১৮৯৬)
সেকালের কথা (১৯০৩)
ছেলেদের মহাভারত(১৯০৮)
মহাভারতের গল্প (১৯০৯)
টুনটুনির বই(১৯১০)
ছোট্ট রামায়ণ(১৯১১)
গুপি গাইন বাঘা বাইন(১৯১৫)
এই গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হল টুনটুনির বই। এই বইটিতে আছে বিচিত্র স্বাদের ২৭টি গল্প। গল্পগুলির মূল আকর্ষণ হল তার সরল সাবলীল ভাষা। এ প্রসঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের কন্যা পুণ্যলতা চক্রবর্তীর একটি উক্তি বলা যেতে পারে-
"ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা  বড় ভালোবাসতেন। শিশুদের সঙ্গে শিশুর মতোই তিনি হাসি খেলা নাচ গানে মেতে উঠতেন। শিশুদের মন বুঝতেন বলেই বুঝি এমন সুন্দর সহজ মিষ্টি হতো তার লেখা' -পুণ্যলতা চক্রবর্তী।
ছাপাখানা ও চিত্রশিল্প:
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে তার প্রথম বই 'ছেলেদের রামায়ণ' প্রকাশিত হয়। এই বইটি সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হলেও মুদ্রণ সম্বন্ধে অতৃপ্ত উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন। এবং ৭নং শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে "ইউ রায় অ্যান্ড সন্স' নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। এখানে একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার ষ্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। ছাপাখানার ব্যবসার পাশাপাশি সেই ১৮৯৭ থেকেই ব্রিটেনের গ্রাফিক আর্টের বিখ্যাত জার্নাল পেনরোজ অ্যানুয়ালে একের পর এক প্রবন্ধে প্রকাশিত হতে শুরু করল হাফটোন মুদ্রণ পদ্ধতি নিয়ে তাঁর মৌলিক গবেষণার ফলাফল। ১৯১১ সালের মধ্যে ন টা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তাঁর এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে।
প্রবন্ধগুলি হল:
১) ফোকাসিং দ্য স্ক্রিন (১৮৯৭)
২) দা থিওরি অব হাফটোন ডট(১৮৯৮)
৩) দা হাফটোন থিওরি গ্র‍্যাফিক্যালি এক্সপ্লেইনড(১৮৯৯)
৪) অটোম্যাটিক অ্যাডজাস্টমেন্ট অব দা হাফটোন স্ক্রিন(১৯০১)
৫) ডিফ্র‍্যাকশান ইন হাফটোন(১৯০২-০৩)
৬) মোর অ্যাবাউট হাফটোন থিওরি(১৯০৩-০৪)
৭) দা সিক্সটি ডিগ্রি ক্রস লাইন স্ক্রিন (১৯০৫-০৬)
৮) মালটিপল স্টপস্ (১৯১১-১২)
হাফটোন প্রযুক্তিতে উপেন্দ্রকিশোরের অবদান যথেষ্ট। আবিষ্কার করেন হাফটোন ক্যামেরার জন্য অটোমেটিক স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর, যার সাহায্যে হাফটোন ক্যামেরার ফোকাসিং -এর জন্যে পর্দার সঠিক অবস্থানটা যান্ত্রিক নির্ভুলতায় নির্ধারিত হয়ে যেত। ১৯০২ সালে তৈরি করেছেন রে'জ টিন্ট প্রসেস। ১৯০৩ সাল থেকে এই পদ্ধতিকে অবলম্বন করে ম্যাগাজিনে হাফটোন রঙিন ছবি ছাপাইয়ের কাজ শুরু হয়।
উপেন্দ্রকিশোর চিত্রশিল্পীও ছিলেন। ছবি আঁকতেন ইউরোপীয় ঘরানায় তেলরং, জলরং বা কালিকলমে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় -এর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের নদী কবিতার সংযোজিত তাঁর অঙ্কন বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। 'বলরামের দেহত্যাগ' তাঁর অঙ্কিত একটি বিখ্যাত চিত্র। চিত্রশিল্পে তাঁর যে অবদানটা উল্লেখের দাবি রাখে তা হল লেখার অলংকরণ। নিজের লেখাতে তো বটেই সেইসঙ্গে সীতা দেবী শান্তা দেবী ও রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে অমর হয়ে রয়েছে তাঁর অনুপম অলংকরণ। ১৯১২ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি প্রকাশিত হয় তখন গগন ঠাকুরের অসামান্য ছবিগুলোর হাফটোন ব্লকও তৈরি হয় উপেন্দ্রকিশোরের ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকেই।
সঙ্গীতশিল্পী:
বাল্যকাল থেকেই উপেন্দ্রকিশোর সঙ্গীতচর্চার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবসমূহে সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর বেহালার বাজনা ছিল বড় আকর্ষণ। পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ব্রাহ্মধর্ম অবলম্বন করবার পর তিনি বেশ কিছু অসাধারণ ব্রাহ্মসঙ্গীত লিখেছিলেন-
১) কে ঘুচায় হায় প্রাণের কালিমারাশি
২) জয় দিন দয়াময় নিখিল ভুবনপতি
৩) বল দেখি ভাই এমন করে ভুবন কে বা গড়িল
৪) যাব পুরবাসী ভাগবত প্রেম পিয়াসি
তাঁর বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক বই:-
১) শিক্ষক ব্যতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা (১৮৮৮)
২) বেহালা শিক্ষার বই(১৯০৪)
৩) ভারতীয় সংগীত।
মৃত্যু:
উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে এভাবে নানামুখী যোগ্যতার সমাবেশ ঘটলেও তিনি প্রধানত নির্মল আনন্দরসিক শিশুসাহিত্যিক রূপেই অধিক পরিচিত। ১৯১৫ সালের ২০ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন।
প্রবন্ধ: জয়িতা এস্‌ (প্রকাশ: ০৮.০৫.২০২১)
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
          বাংলা পিডিয়া
There are no reviews yet.
0
0
0
0
0

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content