স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২)
উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলা সাহিত্যে যে সকল প্রতিভাময়ী লেখিকার আবির্ভাব হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম নক্ষত্র স্বর্ণকুমারী দেবী। স্বর্ণকুমারী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। তিনিই ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক।
জন্ম ও পরিবার:
স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৫৫ সালের ২৮শে আগষ্ট কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। তিনি তার অনুজ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। তার তিন দিদির নাম: সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী। তার ছোটবেলার নাম ছিল বর্ণকুমারী।
শিক্ষাজীবন:
স্বর্ণকুমারী দেবীর বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয় অন্তঃপুরে তিন বছর বয়স থেকে। তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, তাঁদের শিক্ষয়িত্রী শ্লেটে লিখে দিতেন এবং সেখান থেকে তারা লিখতেন। পরবর্তীতে তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অযোধ্যানাথ পাকড়াশি নামে এক দক্ষ শিক্ষককে নিয়োগ করেন। পরবর্তীকালে স্বর্ণকুমারী দেবী নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত হয়ে উঠেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজ প্রভৃতি সব বিষয়েই তাঁর জ্ঞান ছিল অসামান্য।
বিবাহিত জীবন:
তিনি ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ১৭ই নভেম্বর নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে মাত্র বারো বছর বয়সে বিবাহ বদ্ধনে আবদ্ধ হন।পরবর্তীকালে জানকীনাথ ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করে "রাজা' উপাধি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানবাদী এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবীর তিন সন্তান: হিরন্ময়ী দেবী, জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল ও সরলা দেবী।
সাহিত্যিক জীবন:
সাহিত্যের বহু শাখাতে স্বর্ণকুমারী দেবীর ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণা। সংগীত, নাটক ও সাহিত্যে ঠাকুরবাড়ির পুরুষ সদস্যদের সৃষ্টিশীলতা তাঁকে স্পর্শ করেছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী একাধিক উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান-পরিভাষা রচনার বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছিলেন। বিয়ের আগে থেকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়। বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে তিনি পুনরায় সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হন। তাঁর নিজস্ব জীবনের বিকাশে স্বামীর সহায়তার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন:
"আমার প্রিয়তম স্বামীর সাহায্য ও উৎসাহ ব্যতিরেকে আমার পক্ষে এতদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হইতো না। আজ বহির্জগত আমাকে যেভাবে দেখিতে পাইতেছে, তিনিই আমাকে সেইভাবে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন এবং তাঁহার প্রেমপূর্ণ উপদেশে বা ঝটিকা বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রেও যেমন সন্তরণনিপুণ ব্যক্তি সহজে ও অবলীলাক্রমে সন্তরণ করিয়া যায়, সাহিত্যজীবনের ঝটিকাময় ও উত্তাল তরঙ্গের মধ্য দিয়া আমিও সেইরূপ অবলীলাক্রমে চলিয়া আসিয়াছি।'
যদিও তিনি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত তবুও নাটক, প্রহসন, গীতিকবিতা, গান, প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তার অসামান্য প্রতিভার পরিচয় মেলে।
উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। টডের ইতিহাস থেকে উপাদান সংগ্রহ করলেও অনেক ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস "দীপনির্বাণ'। পৃথ্বীরাজ মহম্মদ ঘোরীর সংঘর্ষ কাহিনি নিয়ে এই ঐতিহাসিক উপন্যাসটি রচিত। টডের গ্রন্থ থেকে তিনি এই উপন্যাসের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন, এই উপন্যাসে স্বদেশানুরাগের গভীর পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস তাঁর ফুলমণি ও করুণার বৃতান্ত প্রকাশ করে বাংলা ভাষায় প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক।
স্বর্ণকুমারী দেবীর অনেক বই "দীপ নির্বাণ রচয়িত্রী' ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়।
উনবিংশ শতাব্দীর মহিলা গীতিকবিদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি যে কাব্যগ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য "গাথা' শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ। "গাথা' কাব্যগ্রন্থটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, কাব্যগ্রন্থের উপহার পৃষ্ঠায় লেখা ছিল-
"ছোট ভাইটি আমার,
যতনে গাথা হার কাহারে পরাব আর?
স্নেহের রবিটি, তোরে আয়রে পরাই,
যেন রে খেলার ভুলে ছিঁড়িয়ে ফেলোনা খুলে,
দুরন্ত ভাইটি তুই-তাইতে ডরাই।'
স্বর্ণকুমারী দেবী দেশাত্মবোধক কবিতা রচনা করেছিলেন, যারমধ্যে গীতিকাব্যের সুর বর্তমান। সমর সঙ্গীত, রণসঙ্গীত সার্থক দেশাত্মবোধক কবিতা। স্বর্ণকুমারী দেবী চারটি প্রণয় কাহিনিমূলক গাথাকাব্য রচনা করেন- "সাধের-ভাসান', "সাশ্রু সম্প্রদান, "খড়্গ-পরিণয়' ও "অভাগিনী'।
"অভাগিনী' একটি রোমান্টিক প্রেমের কাব্য। বিপিন এ কাব্যের নায়ক, স্ত্রী দামিনীকে সে খুব ভালোবাসতো। তার ইচ্ছে ছিল স্ত্রীকে স্বর্ণালঙ্কারে ভরিয়ে দিতে এই লক্ষ্যপূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজনে সে চলে গেল প্রবাসে। দামিনী স্বামী বিরহে দিন কাটাতে থাকে। তারপর এক চিঠিতে জানতে পেলো বিপিনের আসার খবর, আনন্দে তার বুক ভরে গেল।এরপর সে খবর পেলো বিপিনের নৌকা সমুদ্রে ডুবে গিয়েছে। এই খবর শুনে স্ত্রী দামিনী জ্ঞান হারালো। এরপর বিপিন যখন এলো তখন তার অন্তিম অবস্থা, বিপিনের কোলে মাথা রেখে সে অন্তিম নিদ্রায় শায়িত হল। ভাবে ও ভাষায় স্বর্ণকুমারীর এই গাথাকাব্যটি শিল্পোৎকর্ষের পরিচয় বহন করে।
স্বর্ণকুমারী গীতিনাট্য, নাটক ও প্রহসন লিখেছেন। কৌতুক নাট্যগুলি হল: "লজ্জাশীল', "বৈজ্ঞানিক বর', 'লোহার সিন্দুক', "ষষ্ঠীর বাছা', "গানের সভা', "তত্ত্বজ্ঞানী' ও "শিক্ষা বিভ্রাট'। এই কৌতুকরসের নাটকগুলি রচনার ক্ষেত্রে স্বর্ণকুমারী দেবী বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
স্বর্ণকুমারী দেবীর ছোটগল্পগুলিও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ মালতী ও গল্পগুচ্ছ। "নবকাহিনী' তাঁর অপর গল্পগ্রন্থ। স্বর্ণকুমারীর ছোটগল্পগুলির বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে সার্থক চরিত্র চিত্রণে ও ঘটনা বিন্যাসে এবং বর্ণনাভঙ্গির দিক থেকে সার্থক। ছোটগল্পে সমাজে যারা অবহেলিত অবজ্ঞাত তাদের বেদনা সার্থক রূপ পেয়েছে এবং নারী চরিত্রগুলিও স্বমহিমায় ফুটে উঠেছে।
স্বর্ণকুমারীর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি যে বিজ্ঞানের অনুরাগী পাঠক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তারকা জ্যোতি নীহারিকা সূর্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধে।
রাজনৈতিক জীবন:
রাজনীতির আঙিনায় স্বর্ণকুমারী দেবীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী নিজেকে শুধুমাত্র সাহিত্যচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ভারতের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হবার প্রয়াস ছিল তাঁর। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে পন্ডিত রামাবাই, রামাবাই রানাড ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সখিসমিতি:
উনিশতম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আবার মাদাম ব্লাভাটস্কির দলভঙ্গের পরে "সখিসমিতি' নামে স্বর্ণকুমারী মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। সখিসমিতি স্থাপিত হয়েছিল ১২৯৩ সালের বৈশাখ মাসে। এর উদ্দেশ্য ছিল-
"মেয়েতে মেয়েতে আলাপ পরিচয়, দেখাশোনা, মেলামেশা স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার ও উন্নতির চেষ্টা, বিধবা রমণীকে সাহায্য করা, অনাথকে আশ্রয়দান ইত্যাদি।'
তাঁর অনেক জনহিতকর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল "মহিলা শিল্পমেলা', বঙ্গদেশ, বোম্বাই, আগ্রা, জয়পুর, কানপুর থেকেও এই শিল্পমেলায় বহু শিল্পজাত দ্রব্য আসতো।এই শিল্পমেলা প্রসঙ্গে তাঁর বিধবা শিল্পাশ্রম গঠন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
রচনাবলী
উপন্যাস
১) দীপনির্বাণ (১৮৭৬)
২) মিবার-রাজ (১৮৭৭)
৩) ছিন্নমুকুল (১৮৭৯)
৪) মালতী (১৮৭৯)
৫) হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭)
৬) বিদ্রোহ (১৮৯০)
৭) স্নেহলতা (১৮৯২)
৮) কাহাকে (১৮৯৮)
৯) ফুলের মালা (১৮৯৫)
১০) বিচিত্রা (১৯২০)
১১) স্বপ্নবাণী (১৯২১)
১২) মিলনরাতি (১৯২৫)
১৩) সাব্বিরের দিন রাত (১৯১২)
গল্পগ্রন্থ
১) নবকাহিনি (১৮৯২)
২) গল্পস্বল্প (১৮৯৩)
নাটক প্রহসন
১) বসন্ত উৎসব (১৮৭৯)
২) বিবাহ উৎসব (১৮৯২)
৩) কৌতুকনাট্য ও বিবিধ কথা (১৯০১)
৪) দেবকৌতুক (১৯০৬)
৫) কনে বদল (১৯০৬)
৬) পাকচক্র (১৯১১)
৭) নিবেদিতা (১৯১৭)
৮) যুগান্ত (১৯১৮)
শিশুপাঠ্য ও অন্যান্য রচনা
১) সচিত্র বর্ণবোধ (১৯০২)
২) বাল্যবিনোদ (১৯০২)
৩) আদর্শনীতি (১৯০৪)
৪) প্রথম পাঠ্য ব্যাকরণ (১৯১০)
৫) বিদায় গ্রহণ (১৯১৫)
কাব্য কবিতা
১) গাথা (১৮৮০)
২) হাসি ও অশ্রু (১৮৯৫)
৩) কবিতা ও গান (১৮৯৫)
বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন
১) পৃথিবী (১৮৮২)
সম্মাননা:
১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন।
জীবনাবসান:
স্বর্ণকুমারী দেবী উনবিংশ শতাব্দীর সমাজসচেতনতার ক্ষেত্রে একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব।তিনি ১৯৩২ খ্রীঃ ৩রা জুলাই মারা যান।
জয়িতা এস্
তথ্যসূত্র:-
১) উইকিপিডিয়া : স্বর্ণকুমারী দেবী
২) বাংলা পিডিয়া
৩) https://www.wikiwand.com
৪) https://www.targetsscbangla.com
(প্রকাশ: ১৫.০৬.২০২১)
There are no reviews yet.