স্বামী বিবেকানন্দ (১২ জানুয়ারি, ১৮৬৩-৪ জুলাই, ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ)
ভারতবর্ষের জাতীয় মানসজীবনের সামাজিক ও আত্মিক সংকটকালে পরিত্রাতারূপে বীরেশ্বর ও মানবতাবাদী স্বামী বিবেকানন্দের আর্বিভাব হয়।বীরেশ্বর ও মানবতাবাদী স্বামী বিবেকানন্দ কেবল ভারতে নয়, পরবর্তীকালে নিজকর্মে সমগ্র বিশ্বে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন। শুধু তাই নয়, ভারতবাসী বিবেকানন্দের বীরত্বের জন্য তাকে "বীর সন্ন্যাসী' উপাধি দিয়ে ভূষিত করেছিল এবং তাঁর জন্মদিনটিকে আজ ও ভারতবাসী "জাতীয় যুব দিবস' হিসেবে পালন করে।
জন্ম ও পরিচয়
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি কলকাতার সিমুলিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত এক হিন্দু পরিবারে স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। বিবেকানন্দের পিতার নাম ছিল বিশ্বনাথ দত্ত এবং মাতার নাম ছিল ভুবনেশ্বরী দেবী। বিবেকানন্দের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার ডেরেটোনা গ্রামে। বিবেকানন্দকে সকলেই খুব স্নেহ করতেন তাই সকলে তাকে আদর করে "বিলে' নামে ডাকতেন।
বাল্যজীবন
বীরপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ বাল্যকাল থেকেই ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত, দুঃসাহসী এবং নির্ভীক। তাঁর বাল্যকালের নাম ছিল বিশ্বেশ্বর। বাল্যকালের বিশ্বেশ্বর কেবল যে লেখাপড়ায় পারদর্শী ছিলেন তা নয়, লেখাপড়া এবং খেলাধূলা উভয়েই তিনি সমান পারদর্শীতা লাভ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাল্যকাল থেকেই বিশ্বেশ্বরের হৃদয়ে রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যাদির প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ জন্মেছিল। তবে শুধু রামায়ণ ও মহাভারতের প্রতি নয়, অন্যান্য ধর্ম উপাখ্যানদির প্রতি ও তাঁর হৃদয়ে একটা আকর্ষণ বোধ জন্মায়।যার প্রভাব পরবর্তিতে আমরা বিবেকানন্দের মধ্যে লক্ষ্য করি।
শিক্ষাজীবন
বীরপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের ছাত্রজীবনের নাম ছিল "নরেন্দ্রনাথ'। নরেন্দ্রনাথ মাত্র ১৪বছর বয়সে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য জেনারেল এসেমব্লিস (বর্তমান স্কটিশ চার্চ) কলেজে প্রবেশ করেন। কিন্তু কেবল কলেজের পুঁথিগত জ্ঞানে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না কারণ সে সময় কলেজে থাকাকালীন নরেন্দ্রনাথের হৃদয়ে ঈশ্বর ও জগৎ সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন তাঁর হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
নরেন্দ্রনাথ ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পরিক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। সে সময় তাঁর ইচ্ছে ছিল তিনি আইন বিভাগ নিয়ে শিক্ষালাভ করবেন। কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা তাঁর পিতার মৃত্যুর কারণে পূর্ণতা লাভ করল না। পিতার মৃত্যুর পর নরেন্দ্রনাথ কেই সমস্ত সংসারের ভার নিজের কাঁধে নিতে হয়েছিল যার জন্য তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
ধর্মসংস্কার
অনেকেই বলেন,স্বামী বিবেকানন্দই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু ধর্মকে প্রচার করেছিলেন। তবে শুধু তাই নয়, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে যে বিশ্বধর্মের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে বিবেকানন্দই ছিলেন যিনি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিরূপে অংশগ্রহণ করেছেন। বিবেকানন্দ ছিলেন পরমহংসদেব রামকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য। তিনি গুরু রামকৃষ্ণের দেওয়া সঠিক শিক্ষা অবলম্বন করেছিলেন বলেই আজ তিনি সমগ্র বিশ্বে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিতি লাভ করেন। স্বয়ং গুরু রামকৃষ্ণদেবই তাকে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা দিয়েছেন। তাঁর দীক্ষার ফলেই বিবেকানন্দের হৃদয়ে ধর্ম নিয়ে যে সকল প্রশ্ন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সে সকল প্রশ্নের উত্তর ধীরে ধীরে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
বিবেকানন্দের রচিত বিখ্যাত কবিতাগুলির মধ্যে একটি কবিতার নাম ছিল "সখার প্রতি'। যার শেষ দুই পংক্তিতে তিনি ধর্মকে ব্যাখ্যা করেছেন--
"বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।'
অর্থাৎ মানুষের সেবার মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজমান। বিবেকানন্দ বলেছেন আমরা সকলেই ঈশ্বরের সৃষ্টি। বিবেকানন্দ বিশ্বাস করেন, যে ব্যক্তি সমাজ কল্যাণ সাধনে ও দারিদ্রের দুঃখ দূর করতে গিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয় তাকে কোনোদিন ঈশ্বর সাধনা করার প্রয়োজন নেই। কেবল হিন্দু ধর্ম নয়, পৃথিবীর সকল ধর্মই মানুষের সেবা কল্যাণে এই একই মত পোষণ করে। সুতরাং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম হচ্ছে মানুষের সেবা করা। বিবেকানন্দ বলেছেন ঈশ্বরের স্থান মানুষের অন্তরে সুতরাং মানুষের সেবা করে মানুষের অন্তরকে যদি তৃপ্ত করা যায় তাহলে স্বয়ং ঈশ্বর ও প্রকৃতরূপে তৃপ্ত হবেন। বিবেকানন্দের এই আলোচ্য দুটি পংক্তি ধর্মকে যেন এক নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে।
বিবেকানন্দ ছিলেন মানবতাবাদী। তাই তিনি তাঁর সমগ্র জীবন মানুষের সেবার মধ্যেই কাটিয়ে দিয়েছেন। বিবেকানন্দের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনসেবা ও শিক্ষাপ্রসার। তাই তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১মে কলকাতায় "রামকৃষ্ণ মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন যাতে দারিদ্র্যের ক্ষুধা নিবারণ করা যায় এবং অজ্ঞ দেশবাসীকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করা যায়। তিনি মানুষের মধ্যে তাঁর এই ধর্ম প্রচারের জন্য রামকৃষ্ণ মঠও একই সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জীবিতকালে কিছু গ্রন্থ ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, অনেকগুলি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রন্থ
১. রাজযোগ
২. কর্মযোগ
৩. ভক্তিযোগ
৪. জ্ঞানযোগ
৫. মদীয় আচার্যদেব
৬. ভারতে বিবেকানন্দ
৭. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য (১৯০২)
৮. পরিব্রাজক (১৯০৫)
৯. ভাববার কথা (১৯০৭)
কবিতা
১. নাচুক তাহাতে শ্যামা
২. জুলাইয়ের প্রতি
৩. সন্ন্যাসীর গীতি
৪. সখার প্রতি
এছাড়াও বিবেকানন্দের কিছু অমরবাণী রয়েছে যা আজ ও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তোলে। যেমন---
১. "বহুরূপে সম্মুখে তোমার,ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।'
২. "ওঠো,জাগো,লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।'
৩. "মন ও মস্তিষ্কের দ্বন্ধে সবসময় অনুসরণ করবে মনকে।'
৪. "এমন কাজ করে চলো যে তুমি হাসতে হাসতে মরবে আর জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে।'
৫. "আমি বিশ্বাস করি যে, কেউ কিছু পাওয়ার উপযুক্ত হলে জগতের কোনো শক্তিই তাকে বঞ্চিত করতে পারে না।'
৬. "ইচ্ছা শক্তিই জগৎ কে পপরিচালনা করে থাকে।'
৭. "কাজ করো নির্ভীকভাবে। এগিয়ে চলো সত্য আর ভালোবাসা নিয়ে।'
৮. "যা পারো নিজে করে যাও, কারো ওপর আশা বা ভরসা কোনাটাই করো না।'
৯. "মস্তিষ্ককে উচ্চমানের চিন্তা-ভাবনা দিয়ে পূর্ণ করো, দিবারাত্র এগুলোকে তোমার সামনে রেখে চলো, এগুলোর থেকে মহান কাজ বেরিয়ে আসবে।'
১০. "যে রকম বীজ আমরা বুনি, সে রকমই ফসল আমরা পাই। আমরাই আমাদের ভাগ্য তৈরি করি, তার জন্য কাউকে দোষারোপ করার কিছু নেই, কাউকে প্রশংসা করারও কিছু নেই।'
বিবেকানন্দ সঙ্গীতে ও যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর রচিত দুটি বিখ্যাত গান হল--
১. খণ্ডন-ভব-বন্ধন
২. নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি।
নারী শিক্ষা প্রসার
নারী শিক্ষা প্রসারে বিবেকানন্দের ভূমিকা এককথায় অনবদ্য। বিবেকানন্দের মতে, একটি জাতি তখনই উন্নত ও প্রগতিশীল হবে যখন সে জাতির নারীরা মর্যাদার উচ্চ স্থান লাভ করবে। বিবেকানন্দ বলেছেন পুরুষের যেমন অধিকার আছে স্ব-শিক্ষিত হওয়ার তেমনি নারীর ও সমান অধিকার আছে শিক্ষা লাভ করার। তিনি বলেছেন "নারী জাতি খেলনা নয়' তাই নারী জাতির অবমাননার প্রতি তিনি বিদ্রূপ করেছেন। বিবেকানন্দ ভারতীয় নারীর আদর্শরূপে সীতাকে প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শুধু তাই নয়, আমেরিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে তিনি যে সভায় উপস্থিত নর-নারীকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক বক্তৃতা প্রদান করেছেন তাতে আমেরিকার কিছুসংখ্যক নারীরা বিবেকানন্দের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বিবেকানন্দের কাছে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিবেকানন্দ যখন লণ্ডনে যান তখন লণ্ডনের ইংরেজ নর-নারীরা বিবেকানন্দের ধর্মালোচনা দেখে মুগ্ধ হন। সেই নর-নারীদের মধ্যে মিস মার্গারেট নোবেল নাম্নী নামে এক ইংরেজ মহিলা বিবেকানন্দের কাছে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে সেই ইংরেজ নারী ভারতে নিবেদিতা বলে পরিচয় লাভ করেন।
মৃত্যু
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই বীরপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড়ে ধ্যান মগ্ন অবস্থায় পরলোক গমন করেন।
প্রবন্ধ: মাম্পী রায়
তথ্যসূত্র-
১. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ড. দেবেশ কুমার আচার্য্য
২. বাণীবিচিত্রা, পীযূষ দে
৩. উইকিপিডিয়া
(প্রকাশিত: ২০.০৫.২০২১)
-
There are no reviews yet.