সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
যত দূরেই যাই
আমি যত দূরেই যাই
আমার সঙ্গে যায়ঢেউয়ের মালা-গাঁথা
এক নদীর নাম—
আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
নিকোনো উঠোনে
সারি সারি
লক্ষ্মীর পা
আমি যত দূরেই যাই।।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত
শান-বাঁধানো ফুটপাতে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়েতারপর খুলে—
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে–
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।
গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলেএকটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।
লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মতো আকাশটা মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধরে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল
ঠিক সেই সময়চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ ! পোড়ার মুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি!
তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়ি পাকানো সেই গাছ
তখনও হাসছে।।
একটি কবিতার জন্যে
একটি কবিতা লেখা হবে। তার জন্যেআগুনের নীল শিখার মতন আকাশ
রাগে রী-রী করে, সমুদ্রে ডানা ঝাড়ে
দুরন্ত ঝড়, মেঘের ধূম্র জটা
খুলে খুলে পড়ে, বজ্রের হাঁক ডাকে
অরণ্যে সাড়া, শিকড়ে শিকড়ে
পতনের ভয় মাথা খুঁড়ে মরে
বিদ্যুৎ ফিরে তাকায়
সে আলোয় সারা তল্লাট জুড়ে
রক্তের লাল দর্পণে মুখ দেখে
ভস্মলোচন।একটি কবিতা লেখা হয় তার জন্যে।
একটি কবিতা লেখা হবে। তার জন্যে
গর্জনে তার
নখদর্পণে আঁকা
নতুন পৃথিবী, অজস্র সুখ, সীমাহীন ভালোবাসা।
একটি কবিতা লেখা হবে। তার জন্যে
দেয়ালে দেয়ালে এঁটে দেয় কারা
অনাগত এক দিনের ফতোয়া
মৃত্যু ভয়কে ফাঁসিতে লটকে দিয়েমিছিলে এগোয়
আকাশ বাতাস মুখরিত গানেগর্জনে তার
নখদর্পণে আঁকা
নতুন পৃথিবী, অজস্র সুখ, সীমাহীন ভালোবাসা।
একটি কবিতা লেখা হয় তার জন্যে।
বধূ
গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এলপুরনো সুর ফেরিওলার ডাকে,
দূরে বেতার বিছায় কোন্ মায়া
গ্যাসের আলো-জ্বালা এ দিনশেষে ।
কাছেই পথে জলের কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলেছি মৃদু চালে
হঠাৎ গ্রাম হৃদয়ে দিল হানা
পড়ল মনে, খাসা জীবন সেথা।
সারা দুপুর দীঘির কালো জলে
গভীর বন দুধারে ফেলে ছায়া।
ছিপে সে-ছায়া মাথায় কর যদি
পেতেও পার কাৎলা মাছ, প্রিয় ।
কিংবা দোঁহে উদার বাঁধা ঘাটে
অঙ্গে দেব গেরুয়া বাস টেনে
দেখবে কেউ নখ বা কেউ জটা
কানাকড়িও কুঁড়েয় যাবে ফেলে।
পাষাণ-কায়া, হায় রে, রাজধানী
মাশুল বিনা স্বদেশে দাও ছেড়ে;
তেজারতির মতন কিছু পুঁজি
সঙ্গে দাও, পাবে দ্বিগুণ ফিরে।
ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে
দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন
আসছে লাঠি উঁচিয়ে পেশোয়ারি
ব্যাকুল খিল সজোরে দিই মেলে।
ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম
উধাও; লোকলোচন উঁকি মারে—
সবার মাঝে একলা ফিরি আমি
লেকের কোলে মরণ যেন ভালো।
বুঝেছি কাঁদা হেথায় বৃথা; তাই
কাছেই পথে জলের কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে
গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল।।
মে দিনের কবিতা
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে ।
প্রণয়ের যৌতুক দাও প্রতিবন্ধে,
মারণের পণ নখদন্তে;
বন্ধন ঘুচে যাবে জাগবার ছন্দে,
উজ্জ্বল দিন দিক্-অন্তে।
শতাব্দীলাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।।
প্রস্তাব : ১৯৪০
প্রভু, যদি বল অমুক রাজার সাথে লড়াইকোনো দ্বিরুক্তি করব না; নেবো তীর ধনুক ।
এমনি বেকার; মৃত্যুকে ভয় করি থোড়াই;
দেহ না চললে, চলবে তোমার কড়া চাবুক
হা-ঘরে আমরা; মুক্ত আকাশ ঘর, বাহির।
হে প্রভু; তুমিই শেখালে পৃথিবী মায়া কেবল—
তাই তো আজকে নিয়েছি মন্ত্র উপবাসীর;
ফলে নেই লোভ; তোমার গোলায় তুলি ফসল।
হে সওদাগর, সেপাই, সান্ত্রি সব তোমার।দয়া করে শুধু মহামানবের বুলি ছড়াও –
তারপরে, প্রভু, বিধির করুণা আছে অপার;
জনগণমতে বিধিনিষেধের বেড়ি পরাও।
অস্ত্র মেলেনি এতদিন; তাই ভেঁজেছি তান।অভ্যাস ছিল তীর-ধনুকের ছেলেবেলায় ৷
শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান—
বলব, ‘বৎস! সভ্যতা যেন থাকে বজায়!'
চোখ খুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাবো কান।।