শ্রীরামপুর মিশন (১৮০০ সাল)
মিশন প্রতিষ্ঠা
শ্রীরামপুর মিশন বাংলা গদ্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অনবদ্য। ১৭৯৩ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য উইলিয়াম কেরী ও টমাস ভারতে এসেছিলেন। পরে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে কেরীকে সাহায্য করার জন্য ওয়ার্ড, বার্নসডন, মার্শম্যান, প্রভৃতিরা ভারতে এসেছিলেন। প্রথমত তাঁরা মূলত কলকাতাকে তাঁদের প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সেজন্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন (১০ই জানুয়ারী) ও শ্রীরামপুর মিশনের প্রেসের কাজ (মার্চ মাসে) আরম্ভ হয়। এই প্রেস থেকেই পরবর্তিকালে কৃত্তিবাসী রামায়ণ (১৮০১) এবং কাশীদাসী মহাভারত (১৮০২) প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল।
মিশনের উদ্দেশ্য
১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি উইলিয়াম কেরী শ্রীরামপুরে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করা। উইলিয়াম কেরী ও তার অন্যান্য কর্মীরা চেয়েছিলেন সকল ভারতবাসী খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবে এবং তারঁ এই আশাকে পূর্ণ করার জন্য অন্যান্য মিশনারীরা ও যোগ দিয়েছিলেন, যেমন-ওয়ার্ড, বার্নসডন, মার্শম্যান, প্রভৃতি। শ্রীরামপুর মিশন স্থাপিত হওয়ার পর কেরীর একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশীয় ভাষায় বাইবেলের বঙ্গানুবাদ করা। এজন্য কেরী তাঁর এই লক্ষ্য পূরণের জন্য অন্যান্য কর্মীদের ও একাজে নিযুক্ত করেন। তাদের মূল মানসিকতা কিংবা উদ্দেশ্য ছিল বাইবেলকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে হিন্দুদের সম্মুখে উপস্থাপিত করা, যাতে হিন্দুদের মনে তাদের হিন্দু ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা জন্মায় এবং তারা হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় নি। কেননা বাইবেল হিন্দুদের সম্মুখে উপস্থাপিত করলেও হিন্দুরা তা গ্রহণ করেন নি, কেননা হিন্দুধর্মের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় হিন্দুরা অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলেও কোন দিন নিজের ধর্ম থেকে সরে যায় নি। কিন্তু উইলিয়াম কেরী ও তার অন্যান্য কর্মীরা তা বুঝতে পারেন নি। কিন্তু বাংলা গদ্যে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অস্বীকার করা যায় না। শ্রীরামপুর মিশন শুধু বাইবেল অনুবাদ করে নি। এটি ছাড়া ও সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধান (ব্যোপদেবের মুগ্ধবোধ, কেরী সাহেবের সংস্কৃত গ্রামার, কোলব্রুক সম্পাদিত অমরকোষ প্রভৃতি) এবং এটি ছাড়া ও (কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশিদাসী মহাভারত) প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। তাছাড়া বাল্মিকীর সংস্কৃত রামায়ণ, নানা শাস্ত্র, "সমাচার দর্পন' নামে এবং "দিগদর্শন' নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তার সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান,সংবাদপত্র, সাময়িক পত্র,সমাজ সংস্কার প্রভৃতির ক্ষেত্রে ও শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারপর শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর কলেজ ও প্রতিষ্টিত হয়। দেশ ও ধর্ম সম্পর্কে সঠিক এবং উচ্চ শিক্ষাদান দেওয়াই ছিল শ্রীরামপুর কলেজের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ১৮২২-২৩ সালে কেরীর বড় ছেলে ফেলিক্সর মৃত্যুর পর শ্রীরামপুর মিশন অনেক বিপদের সম্মুখীন হয় তবে বিভিন্ন বাঁধা-বিপত্তির মধ্যে ও শ্রীরামপুর মিশন কিদফছু দিন চলেছিল। কিন্তু শেষে ১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর মিশন ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়।
শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রচার পুস্তিকা
পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ
শ্রীরামপুর মিশন সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে পাঠ্যপুস্তক, ব্যকরণ, রামায়ণ ও মহাভারত প্রকাশ করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যোপদেবের মুগ্ধবোধ, কেরী সাহেবের সংস্কৃত গ্রামার, কোলব্রুক সম্পাদিত অমরকোষ প্রভৃতি। এছাড়াও কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশিদাসী মহাভারত প্রকাশ করে বাঙালির অনেক উপকার করেছিলেন।
বাইবেলের অনুবাদ ও প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ
উইলিয়াম কেরীর প্রচেষ্টায় গ্রীক ভাষা থেকে অনূদিত হয়ে প্রতম "মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত' Gospel of St. Mathews ১৮০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত হয়। ১৮০৮ সালে সম্পূর্ণ বাইবেলের বাংলা অনুবাদ "ধর্মপুস্তক' নামে প্রকাশিত হয়। সমস্ত কাজে সহায়তা করেছিলেন রামরাম বসু। ১৮১৮ সালের আগেই মিশন থেকে প্রায় ৮০টি পুস্তক প্রকাশিত হয় এবং ৭ লক্ষ কপি বিতরণ করা হয়।
ইতিহাস সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানমূলক রচনা
জশুয়া মার্শম্যান একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। সংস্কৃত রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদে তিনি কেরীকে সাহায্য করেছিলেন। মার্শম্যান ইংরেজি ও বাংলা এই দুই ভাষাতেই "ভারতবর্ষের ইতিহাস' দু'খণ্ড (১৮৩১) এবং "বাঙ্গালার ইতিহাস' প্রকাশ করেছিলন। তাছাড়াও কিথ, লসন, পিয়ার্স, ওয়েঙ্গার, বাটন প্রমুখদের রচনা মিশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
তাঁর গদ্যরীতির নমুনা
"তখন ঈশ্বর বলিলেন দীপ্তি হউক স্বর্গের আকাশের মধ্যে দিবারাত্রি বিভিন্ন করিতেও তাহা হউক চিহ্ন ও কান ও দিবস ও বৎসর নিরূপণেরকারণ। তাহারাও দীপ্তি হউক স্বর্গের আকাশে উজ্জ্বল করিতে পৃথিবীর উপর। তাহাতে সেই মত হইল।'
শ্রীরামপুর মিশনের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য
আদর্শ গদ্যরীতি তাঁরা তৈরি করতে না পারলে বাংলা গদ্যের বিকাশে তাদের অবদান অস্বীকার যাবে না। কেরী মূলত বাইবেলের আক্ষরিক অনুবাদ করেছিলেন। ফলত যথার্থ বাংলা গদ্যের বিকাশ হয় নি। উইলিয়াম কেরী বাংলা, সংস্কৃত ও মারাঠী ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু তারপরেও বাংলা ভাষায় সাবলীল হতে পারেন নি। তার কারণ মূলত তিনি সরাসরি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। নিকৃষ্ট তৎসম শব্দের বাহুল্য, জটিল ও আড়ষ্ট বাক্য গঠন, যতির যথাযথ ব্যবহার করতে না পারা, পদান্বয়ে ত্রুটি তাঁর গদ্যের প্রধান দুর্বলতা ছিল। অনেকগুলি সংস্করণ বেড় হলেও ভাষার কোনো উন্নতিসাধন হয় নি।
বাংলা সাহিত্যের বিকাশে পরোক্ষে মিশনারীদের অবদান
- মিশনের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ধর্ম প্রচার তাই বিশুদ্ধ গদ্যরীতির প্রতি তাদের লক্ষ্য ছিল না।
- পুরাতন বাংলা কাব্য, মূল সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ, রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ এবং ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত হওয়ার দেশীয় মানুষ অনেক লাভবান হয়েছিলেন।
- মুদ্রণ যন্ত্রের প্রতিষ্ঠা তাদের একটি স্মরণীয় কাজ। এই যন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের প্রাচীন সাহিত্য মুদ্রিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
- বাঙালি আত্মসচেতন হতে এই মিশনের পরোক্ষ যথেষ্ট অবদান ছিল।
প্রবন্ধ: বেদপ্রিয়া দাস পুরকায়স্থ
তথ্যসূত্র:
বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ড. দেবেশ কুমার আচার্য্য
(প্রকাশিত: ১৬.০৫.২০২১)
There are no reviews yet.