E-Learning Info
Go to content
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য:লোকোপকরণ
আদি-মধ্যযুগে রচিত বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য এক মূল্যবান সম্পদ। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এ কাব্য সম্পর্কে লিখেছেন-
“এই অপূর্ব গ্রন্থ হইতে-চণ্ডীদাসের এই লুপ্ত গ্রন্থ হইতে, বাঙ্গালা ভাষার ও বাঙ্গালা সাহিত্যের সম্পর্কে নানা সমস্যার সমাধান হইবে। বাঙ্গালা লিপির ইতিহাস, বাঙ্গালা উচ্চারণের ইতিহাস, বানানের ইতিহাস, বাঙ্গালা ভাষার ইতিহাস, বাঙ্গালা ছন্দের ইতিহাস, বাঙ্গালা পদসাহিত্যের ইতিহাস, ইত্যাদি নানা ইতিহাসের নানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইবে।”  
অর্থাৎ, এ কাব্যে বর্ণিত বাংলাভাষার বিভিন্ন দিক তথা উচ্চারণের দিক, বানানের দিক, ছন্দের দিক, পদসাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদির মতো বাঙালির ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির নানা উপকরণের পরিচয় মেলে কাব্যে বর্ণিত ১৩ খণ্ডের ৪১৮টি পদজুড়ে। তবে, এক্ষেত্রে আমরা কাব্যে উল্লেখিত ১৩টি খণ্ড থেকে কেবলমাত্র দুটি তাম্বূল ও বংশী খণ্ডে বর্ণিত বিচিত্রপ্রকার লোকোপকরণের দিকটি তুলে ধরছি।
বিশ্বাস ও সংস্কার
লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল বিশ্বাস ও সংস্কার। যা সনতারিখের উল্লেখ ছাড়াই পরম্পরা অনুয়াযী ব্যবহৃত হয়ে আসছে পৃথিবীর প্রতিটি জনজাতি ও ভাষাভাষীদের মধ্যে। বাদ  পরে থাকেনি পরিশীলিত সাহিত্যের অঙ্গনেও। এর প্রমাণ বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। এ কাব্যের বাকি খণ্ডগুলির মতো বংশী খণ্ডেও দেখা যায়, বড়াই-রাধা-কৃষ্ণের কথোপকথনে নানাপ্রকার বিশ্বাস ও সংস্কার হতে। এগুলি ব্যবহার হয়েছে তখন, যখন চরিত্রেরা বিপদ তথা অমঙ্গল থেকে নিজেদেরকে সুরক্ষা করতে পারছেন না। তাঁরা বিশ্বাস করছেন তাঁদের জীবনে বিপদের জন্য বিশ্বাস ও সংস্কার দায়ি। বংশী খণ্ডে রাধাকে দেখা যায়, তাঁর জীবনে বিপদের জন্য তিনি বিশ্বাস ও সংস্কারকে যেন দায়ি করছেন। এর পরিচয় মেলে  বংশী খণ্ডের ৩৩৬ সংখ্যক পদে ব্যবহৃত কয়েকটি বিশ্বাসের মধ্যদিয়ে। এসূত্রে তা তুলে ধরা যেতে পারে-
১.  কোণ আসুভ খনে পাঅ বাঢ়ায়িলোঁ।
হাঁছী জিঠী আয়র ঊঝঁট না মানিলো।।
অর্থা, রাধা বলছে হাঁচি, টিকটিকি ও হোচঁটের বাঁধা না মেনে কোন অশুভ মুহূর্তে যাত্রা করলাম।  
২. সুখান ডালত বসি কাক কাঢ়ে রাএ।
অর্থা, শুকনো ডালে বসে কাক ডাকতে ছিল।
৩. শুন কলসী লই সখি আগে জাএ।
শূন্য কলসি নিয়ে সখিরা আগে যাচ্ছে।
৪. বাঞঁর শিআল মোর ডাহিনে জাএ।
বামদিকের শিয়াল ডান দিকে যাচ্ছিল।
প্রবাদ
বাস্তব জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করবার জন্যে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের দ্বারা প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাদ আকারের দিক থেকে লোকসংস্কৃতির বাকি উপকরণের তুলনায় ক্ষুদ্র। মূলত তা একটি বাক্যে ও গদ্যে রচিত। যার মধ্যে লোকায়তজীবনের নানা ঘটনার পাশাপাশি নারীভাষার লক্ষণগুলি লুকিয়ে থাকে। ফলস্বরূপ, মধ্যযুগের বিভিন্নকাব্যের মতো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যেও প্রবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন-বংশী খণ্ডে শোনা যায়-
. মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী
. দৈব নিবন্ধন খণ্ডন না জাএ
. আখায়িল ঘা অত বিষ জালিল কাহ্নাঞিঁ
লোকগালিগালাজ
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে বংশী খণ্ডের ৩৩৫ পদে রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ের মধ্যে বাঁশি নিয়ে লড়াই শুরু হলে রাধার প্রতি কৃষ্ণকে বিভিন্নপ্রকার গালি ব্যক্ত করতে দেখা যায়, এভাবে-
নটকী গোআলী ছিনারী পামরী সত্যে ভাষ নাহিঁ তোরে
তোঞঁ নিলী বাঁশী
মন্ত্রের ব্যবহার
বড়াই রাধাকে কৃষ্ণের মোহনবাঁশি চুরি করবার পরামর্শ দিলে, রাধা বড়াইর কাছে চান, কীভাবে সে বাঁশি চুরি করবে। এর উত্তরে বড়াই জানান, নিন্দাউলি মন্ত্রের দ্বারা। ৩২৮ সংখ্যক পদে শোনা যায়-
নিন্দাউলী মন্ত্রে থাক নিন্দাইব আহ্মি
তঁবে তার বাঁশী লআঁ ঘর জাইহ তুহ্মি।।
লোকবাদ্যযন্ত্র
নানা ধরনের দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায় বংশী খণ্ডে। ৩১০ সংখ্যক পদে দেখা যায়, ষোলশত গোপী নিয়ে কৃষ্ণ যমুনার ঘাটে গিয়ে রসিকতার সময় মৃদঙ্গ জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজাতে এভাবে-
খনে করতাল খনে বাজাএ মৃদঙ্গ
তা দেখি রাধিকার সখিগণে রঙ্গ
আর যত বাদ্য গণ আছের কাহ্নাঞিঁ
পতিদিনে নানা ছন্দে বাএ সেহি ঠাই।।
লোকখাদ্য
বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী নানাধরনের খাবার যেমন-শাক, নিমেরঝোল ও ভাত ইত্যাদির পরিচয় পাওয়া যায় আলোচ্য কাব্যের বিভিন্ন অংশে। বংশী খণ্ডের ৩২৩ সংখ্যক পদে রাধার উক্তিতে দেখা যায়-
আম্বল ব্যঞ্জনে মো বেশোআর দিলোঁ
যাকে দিলোঁ কানাসোআঁ পা।।
আ সুনিআঁ ঘৃতে মো পরলা বুলিআঁ
ভাজিলোঁ এ কাঁচা গুআ।।
ছোলঙ্গ চিপিআঁ নিমঝোলে খেপিলো
বিনি জলেঁ চড়াইলোঁ চাঊল।।
লোকপশু
আদি-মধ্য যুগীয় সমাজে হিংস্র পশুদের কেন্দ্রকরে লোকদের মনে ভয় ছিল। তাঁরা হিংস্র পশুদের ভয়ে এক স্থান থেকে ভিন্ন অঞ্চলে যেতে ভয় পেতেন। এর পরিচয় মেলে এ কাব্যের বড়াইর মধ্যে। বড়াইকে দেখা যায়,  ঘড়িয়াল, কুম্ভির, বাঘ ও ভালুক প্রভৃতি হিংস্রপশুদের ভয়ে তিনি যমুনা নদী অতিক্রম করতে ভয় পাচ্ছেন-
যমুনা নদীতে মো কেমনে হৈবোঁ পার
ঘড়িআল কুম্ভীর তাহাত আপার।।
সেহি বৃন্দাবন মাহা ঘোর ভয়ঙ্কর
বাঘ ভালুক তাএ বসে বিথর।।
লৌকিকদেবী
লৌকিকদেবীর প্রতি বিশ্বাস আদি-মধ্য বাঙালি তথা বাংলার লোকায়ত সমাজে যে ছিল, তার প্রমাণ মেলে কাব্যের ভণিতা অংশে বাসলী দেবীর উল্লেখের মধ্যদিয়ে। এ সূত্রে ৩১৫ ও ৩২৯ সংখ্যক পদের ভণিতার দিকটি উল্লেখ করা হল-
বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে
বাসলীচরণ শিরে বন্দিআঁ গাইল বড়ু চন্ডীদাসে
গ্রন্থঋণ
১. অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য-বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমগ্র, দে’জ, কলকাতা, সপ্তদশ সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১৮
প্রবন্ধ: ড.মানচিত্র পাল
অতিথি সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়, হোজাই, আসাম
(প্রকাশিত: ১২.০৬.২০২৩)

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content