শেখর দেবরায়ের লোকঐতিহ্য আশ্রিত দু’টি নাটক
শেখর দেবরায়ের লোকঐতিহ্য আশ্রিত দু’টি নাটক
অসম তথা বরাক উপত্যকার
নাট্যকার শেখর দেবরায়ের সুগভীর মৌলিক ভাবনার অপূর্ব ফসল লোকঐতিহ্য আশ্রিত নাটক ‘মনসাকথা’ ও ‘রইদ রাজার কিচ্ছা’ নাটকদ্বয়। নাটকদুটিগ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়
মলয় দেব-এর সম্পাদনায়। প্রকাশ কাল ডিসেম্বর ২০২২।
প্রকাশক গুটেনবার্গ। কলকাতা। প্রচ্ছদ শিল্পী সুকান্ত ঘোষ। উৎসর্গ করা হয়েছে বরাক উপত্যকায় পাশ্চাত্য নাটকের অনুবাদের সূচনকারী ক্ষীরোদচন্দ্র দেব ও উপেন্দ্র কুমার কর-কে। গ্রন্থটির
মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৪। সূচিপত্রে রয়েছে ভূমিকা, মনসাকথা, রইদ রাজার কিচ্ছা, পরিশিষ্ট-ক সমাজবিজ্ঞানের নিরিখে একটি লোককথা (দিব্যজ্যোতি মজুমদার), পরিশিষ্ট-খ মনসামঙ্গলকাব্য : নাগ ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে (অমলেন্দু
ভট্টাচার্য)। ভূমিকাটি
খুবই সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ। লিখেছেন সম্পাদক নিজেই। ভূমিকায় ওঠে এসেছে লোকনাট্য, আধুনিক
নাটক ও
যাত্রাগানের প্রসঙ্গ।
পাশাপাশি
মধ্যযুগের বিভিন্ন কাব্যের নাট্যরূপের
দিকটিও তুলে ধরেছেন সম্পাদক। অর্থাৎ, ভূমিকাটি পড়ে বহু মূল্যবান তথ্যের যেমন পরিচয় পাওয়া যায় তেমনি নাটক দুটির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন দিকের পরিচয় মেলে। সঙ্গে ভূমিকার শেষে উল্লেখপঞ্জিটাও ভূমিকার
গৌরব বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছে।
এরপর রয়েছে ‘আমার কথা’। এ অংশে নাট্যকার ‘মনসাকথা’
নাটকটির অনুপ্রেরণার কথা জানিয়েছেন। প্রেরণা পেয়েছেন নাট্যকার শিক্ষক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য ও
অমলেন্দু ভট্টাচার্য-র কাছ থেকে।
জানিয়েছেন, অমলেন্দু
ভট্টাচার্য-র ‘মনসামঙ্গল
কাব্য : পুনর্বিচার’ প্রবন্ধটি ‘মনসাকথা’
নাটকটির উৎস।
সঙ্গে নাটকটি পাণ্ডুলিপি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হবার তথ্যটুকুও জানিয়েছেন।
নাটকটি শুরু হয়েছে মঙ্গলকাব্যের রীতি অনুযায়ী বন্দনা গান দিয়ে। গানটিতে পৌরাণিক
দেবদেবীর মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দিকটির পরিচয় মেলে। পাশাপাশি শিব বন্দনা ও
ভাটিয়ালি গানও স্থান পেয়েছে। গায়েন, চান্দ, লেংগা, সনকা, মনসা ও বেহুলা ইত্যাদি চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত
নাটকটির সমাপ্তি ঘটেছে বামহাতে চাঁদসদাগরের মনসার পূজা করার মধ্যদিয়ে গায়েন-এর সংলাপ দিয়ে।
দ্বিতীয় নাটক ‘রইদ রাজার কিচ্ছা’। নাটকটির শুরুতে
‘আমার কথা’ অংশ থেকে জানা যায়, বরাক উপত্যকার ‘রইদ রাজার কিচ্ছা’ ব্রতকথা তথা কিচ্ছাকে কেন্দ্রকরে নাটকটি রচিত হয়েছে। এবিষয়ে নাট্যকার জানিয়েছেন-
“…ধানের বীজ বপনের পর অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে কৃষিজীবী পরিবারের বধূ ও কুমারী মেয়েরা ‘রইদ রাজার’ ব্রত করেন। এই
ব্রত পালনের সময় কিচ্ছাটি বলা হয়। তাদের বিশ্বাস-এই ব্রত করলে রোদ-মেঘের সমন্বয়ে
ধানের চারা হবে পুষ্ট; চারা পুষ্ট হলে ফসলও পাওয়া যাবে বেশি।…”
ব্রতকথাটি নাট্যকার শুনেছিলেন লোকসংস্কৃতির একনিষ্ঠ গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য-এর মা এবং বরাক উপত্যকার প্রথম মৌলিক সামাজিক উপন্যাস ‘নারীশক্তি’
বা ‘অশ্রুমালিনী’-র রচয়িতা
সুরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তীর মেয়ে নীহারনলিনী ভট্টাচার্য-এর মুখে। শোনবার প্রায় ৩১বছর পর
নাটকটি রচিত হয়। নাটকটিকে নাট্যকার কিচ্ছা বলার ঢঙে উপস্থাপন করেছেন বরাক উপত্যকার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন
উপকরণ। যেমন-রাধারমণের গান, বিয়ের গান, ধামাইল গান,
ভট্টসংগীত, লোকখেলা ডাংগুটি,
লোকজযান নৌকা, লোকনৃত্য ধামাইল, লোকমন্ত্র ইত্যাদি।
তবে, সবচেয়ে প্রাধান্য
পেয়েছে মেঘ-রোদ মোটিফ দুটি।
নাটকের চরিত্রগুলির নামকরণেও
নাট্যকার সুগভীর ভাবনার পরিচয় দিয়েছেন।
চরিত্রগুলি হল-রবি, সুধা, দাদু, সখী,
কৃষ্ণ, দৈবজ্ঞ, রাজা ও রাজকন্যা প্রভৃতি।
দৈবজ্ঞের মুখে ব্যবহৃত মন্ত্রটিও বেশ আকর্ষণীয়। যেমন-
“বরুণদেবের দোহাই
মেঘের দেশের কুশল চাই।…
অং-বং-মং-ফুঃ-ফুঃ-ফুঃ
বরুণ দেবের দোহাই
এই সত্য যদি নড়ে
স্বগ্গের দেবতার আসন টলে।”
এরপর পরিশিষ্ট অংশে ব্যবহৃত প্রবন্ধদুটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।
পরিশিষ্ট-ক-তে রাখা হয়েছে শ্রদ্ধেয় দিব্যজ্যোতি মজুমদার-এর প্রবন্ধ ‘সমাজবিজ্ঞানের নিরিখে একটি লোককথা’। প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে আলোচ্য ‘রইদ রাজা কিচ্ছা’ ব্রত কথাটি অবলম্বনে। প্রবন্ধটিতে প্রাবন্ধিক ব্রতকথার স্বরূপ তথা বৈশিষ্ট্য ও
সামাজিক দিকটি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। পরিশিষ্ট-খ-তে জায়গা পেয়েছে লোকসংস্কৃতি গবেষক
অমলেন্দু ভট্টাচার্য-এর প্রবন্ধ ‘মনসামঙ্গল কাব্য : নাগ ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে’। প্রবন্ধটিতে প্রাবন্ধিক প্রচলিত
ধারনা মনসামঙ্গল কাব্য যে, সর্পদেবীর মহিমাপ্রচার কাব্য এ ভাবনা থেকে বেরিয়ে
এসে, দেখিয়েছেন; মনসামঙ্গল কাব্যের অন্তর্গত চাঁদসদাগর ও
মনসার লড়াই আসলে নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক অধিকারের
লড়াই। প্রবন্ধের শেষদিকে প্রাবন্ধিক গুরুত্বপূর্ণ
উল্লেখপঞ্জি
যুক্তকরে
দিয়েছেন। যা তরুণ গবেষকদেরকে গবেষণার ক্ষেত্রে সহযোগিতা
করবে।
প্রবন্ধ: ড.মানচিত্র পাল
অতিথি সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়, হোজাই, আসাম
(প্রকাশিত: ১২.০৬.২০২৩)