শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতা
দুঃখী স্ত্রীলোকের কাছে
গাঁয়ের একজন দুঃখী স্ত্রীলোকের কাছে
আমার দু-আনা পয়সা পাওয়া ছিলএকদিন হেমন্তের সকালবেলা সুবলের মার উঠোনে দাঁড়িয়ে
আমি ওকে দান নয়, ধার দিয়েছিলাম
একটি চকচকে চৌকো আদলের পাকিস্তানি দু-আনি
একাদশ বর্ষীয় বালকের মহানুভবতার ইতিহাস নেই
তারপর অনেকদিন পরেও সুবলের মা
ধারে পাওয়া পয়সা শোধ করেনিসুবলের মা ও আমার দেশের নাম এখন বাংলাদেশ
ওর উঠোনে এখন আব্দুল মিঞার মুরগি চরে
আমাদের পুকুরে পা ধোয় সাহেব বাড়ির ছোটো বউ
একদিন স্নান সেরে কলস ভরে জল তুলতে গিয়েঅবাক হয়ে চেয়ে রয়েছিল সুবলের মা
ওর নিষ্পাপ ছায়ায় জলে কোনো দুঃখ ফুটে উঠেনি।
কোমরে ঘুনসি পরা সুবল এখন কত বড়ো হয়েছে
ওর মা কি এখনো একাদশ বর্ষীয় বালকের পয়সা ধার করে
পান চিবোয়
উদ্বাস্তু ক্যাম্পের মারীর হাত থেকে
ও কি সত্যিই ওর ছেলেকে রক্ষা করতে পেরেছিল
আমার বাস্তুহারা জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর পাই না
সুবলের মা এখন কোথায়
একদিন না একদিন আমাদের দেখা হবে
নয়া উপনিবেশ কিংবা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে
আমার জাতিস্মর অনুসন্ধানের কাছে
সুবলের মা সম্রাজ্ঞীর মতো এসে ধরা দেবে
আমি তখন দুঃখী স্ত্রীলোকটিকে চেঁচিয়ে বলব
আমার চৌকো দু-আনি সুদসমেত ফেরত দাও।
একটি গ্রামীণ পদ্য
আমাদের গ্রাম থেকে শহর ছিল পঁচিশ মাইল দূরে
আমরা স্বপ্নে ছাড়া ট্রেন ও মোটরগাড়ি দেখিনি বহুদিন
তিন বাঁক উজানের একজন হোমিওপ্যাথ
সাত ইঞ্চি শিশিতে করে শাদা জলের ওষুধ দিতেন
আমাদের আমাদের কোনো ডাকঘর বা ইস্কুল ছিল না
ইতিহাসের পাতায় যাকে সভ্যতা বলে
তা অনেকদিন আমাদের জানা হয়নি
তবু এবং আশ্চর্য
মায়ের উপুড়-করা স্নেহের মতো আমাদের মাথার উপর আজন্ম আকাশ ছিল
দিগন্ত -ছোঁয়া মাঠের মধ্যে সবুজ ও সোনালি ছিল আমাদের প্রিয় রং
আমরা কাকের ডাক শুনতে শুনতে টিয়াপাখির নাম মুখস্থ করতাম
এতসব অসুবিধার মধ্যেও আমাদের ত্রিসীমানায়
একটি নদী ছিল
এবং আপনারা বিশ্বাস না-করলে সত্যিই দুঃখ হবে
নদীটির নাম ছিল, বিবিয়ানা
আকাশ এবং নদীকে সাক্ষী রেখে রিফিউজি লতার মতো একটি মেয়ে
অনাদরে বেড়ে উঠছিল আমাদের প্রতিবেশী বাড়িতে
আমরা ‘সুন্দর’ শব্দটিকে অভিজ্ঞতার মধ্যে টেনে আনছিলাম প্রতিদিন
আমাদের ঘ্রাণশক্তি সাবালক হওয়ার মুহূর্তে টের পেয়েছিলাম
মেয়েটির শরীরে ছিল কচি ডুমুর পাতার গন্ধ
আমাদের নদীর নামটি যেমন উল্টোপাল্টা
সে জন্যেই বোধহয় মেয়েটিকে কেউ ‘রঞ্জনা’ বলে ডাকত না
এবং উপসংহারে আমার একটিই বলার মতো কথা বাকি আছে
আমাদের গ্রামের নামটি ছিল খুবই অকাব্যিক, অনর্থক ও বিচ্ছিরি
এমনকি লিখতে লজ্জা করে!
মনসামঙ্গল
সপ্তডিঙা মধুকর চারিদিকে জল
শ্রাবণের অবিশ্রাম মনসামঙ্গল
পচা পাটে এঁদো ডোবা বিষধর ফণা
ছেঁড়া কাঁথা-কানি আর বেহুলা-যন্ত্রণা
হু হু করা কালসন্ধ্যা ভেসে আসা গানে
সায়ের ঝিয়ারি যায় অনন্ত ভাসানে
কোথায় নিছনি কোথা চম্পকনগর
সাতনরী শিকা ঝোলে ঘরের ভিতর
কুপিলেম্পে রাতকানা নিরক্ষরা বুড়ি
লখার মরণে কান্দে আছুড়ি-পিছুড়ি
জাল-টানা ছেলে আজ রাতে গেছে জলে
রেখো মা মনসা তার সর্বাঙ্গ কুশলে।
গাঙের গর্ভিণী সেই গন্ধ ভেসে আসে
শ্রাবণীর দিগম্বরা দখিনা বাতাসে
এখনো বুকের দ্বিজ বংশীদাস কহে
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কালীদহে...
ডহরের ঘোর-লাগা গহনের টানে
সায়ের ঝিয়ারি যায় অনন্ত ভাসানে।
একান্ত ব্যক্তিগত
এক দঙ্গল নাতি নাতনির ভিড় বাঁচিয়ে আমার ঠাকুমা
বাড়তি আদর দিয়ে আমাকে দুধের সর খাওয়াতেন
চোখ বুঝে হাঁ করে কান্না জুড়লে মুখে উড়ে পড়ত
নারকেলের নাড়ু
তাতে লেগে থাকত বৃদ্ধার আঙুলের গন্ধ
একান্নবর্তী পরিবারের অভিমানিনী মা আমার
মাঝে মাঝে গালে পিঠে শাসনের স্বাক্ষর এঁকে দিলে
ঠাকুমা আমার হয়ে বাড়ি মাথায় করে বলতেন
বালাই, ষাট
এখন কেউ ‘ও আমার দেশের মাটি'—গাইলে
উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে জ্যেঠামশায়ের প্রবাসে যাওয়ার নৌকো
তার মাল্লার নাম ছিল না।
ভবিষ্যৎবাদীর অমোঘ কণ্ঠস্বরে ও বলত
‘তুমি হবে বুড়ো কর্তার মতো’
অর্থাৎ অদৃষ্ট ঠাকুরদার মতো আবক্ষদাড়ি, দশাসই চেহারা
ও শিষ্যপ্রিয় সন্ত
আমার স্নেহময়ী ঠাকুমাকে ছেড়ে ঠাকুরদা প্রৌঢ় বয়সে
সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেলেন সেটা আমার কাছে রহস্য
বাবা আমাকে বুকে শুইয়ে শিখিয়েছিলেন অঙ্ক, অঙ্কের খেলা
প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের গল্প
মায়ের দুঃখ, কেন বাবা আমাকে তাঁর সহিষ্ণুতা শেখালেন না
এখন দেশের মাটি বলতে ভেসে ওঠে জ্যেঠামশায়ের অন্তিমশয্যা
ঠাকুরমার শ্মশান, বড় বাড়ির বেলগাছ
ঠাকুরদা আমার স্মৃতির দুই যুগ আগে ছেড়েছিলেন সংসার
তিনিও কিংবদন্তীর মতো মাঝে মাঝে উড়ে আসেন
আমার বাবার ডাক নাম ক্রমশ অচল হয়ে যাচ্ছে
বড়ো পিসিমার পর তাঁরও অবলম্বনহীন শৈশব
রথের ভেতর এক প্রলম্বিত আমি
আমার অতি বৃদ্ধাতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের আদিপুরুষ
আমার ঠাকুরমার ধূসর স্মৃতি
সব কিছু ছাপিয়ে
আমার যৌবন এক প্রগাঢ় বিষাদময়তার দিকে ছুটে চলেছে।
যখন ব্যক্তিগত কারণে চিন্তাগ্রস্ত
তোমাতে নই আমাতে নই, বিষয়ে আছি লিপ্ত
লাগামছেঁড়া তিনটে ঘোড়া ভীষণ রকম ক্ষিপ্ত।
বিজন মাঠ বধ্যভূমি
ধরতে গেলাম, তখন তুমি
সরে দাঁড়াও অশ্ববাহন, এবং বলদৃপ্ত
রক্তে নাচাও মাতাল ঘোড়া তিনটে সমান ক্ষিপ্ত।
তোমাতে নই, আমাতে নই, সময়ে আছি লিপ্ত
গুটি কয়েক ইচ্ছে ছিল; উড়ায়ে পরিতৃপ্ত
হয়েছ নাকি! সময় যায় আকণ্ঠ শীত মত্ততায়
ধরতে গেলে হাত পোড়ালে এমন ভীষণ দীপ্ত
অশ্ববাহন মন্দগতি হলে না পরিতৃপ্ত।
তোমাতে নই, আমাতে নই, অসুখে আমি লিপ্ত
লাগামছেঁড়া তিনটে ঘোড়া জরার অধিক ক্ষিপ্ত।
অশ্ববাহন, অশ্ববাহন
হাত বাড়ালে কেবল দাহন
মধ্যভূমি পেরিয়ে এলে, তবুও এত দৃপ্ত!
বিষয়ে আছি, সময়ে আছি, অসুখে অনুলিপ্ত ।