রাসসুন্দরী দেবী ( ১৮০৯ (১২১৬ চৈত্র) - ১৮৯৯ (১৩০৬)
পিতা: পদ্মলোচন রায়
স্বামী: সীতানাথ সরকার
রাসসুন্দরী দেবীর দশটি পুত্র, দুইটি কন্যার মাতা হয়েছিলেন। অনেকেরই অকালমৃত্যু ঘটেছিল। যাদের নাম পাওয়া গেছে:
পুত্র: বিপিনবিহারী, পুলিনবিহারী, প্যারীলাল, দ্বারকানাথ, রাধানাথ, কিশোরীলাল, প্রতাপচন্দ্র, মুকুন্দলাল, চন্দ্রনাথ
কন্যা: রামসুন্দরী, শ্যামসুন্দরী
রাসসুন্দরী দেবী একজন বাঙালি লেখক যিনি প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখক হিসাবে চিহ্নিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নারী লেখকদের মধ্যে একজন। তিনি প্রথম ভারতীয় নারী হিসাবে আত্মজীবনী লিখেছিলেন। রাসসুন্দরী দেবী তাঁর আত্মজীবনী "আমার জীবন' রাসসুন্দরী দাসী নামে প্রকাশ করেছিলেন।
জন্ম ও পরিবার:
রাসসুন্দরী দেবীর জন্ম ১২১৬ সালে চৈত্র মাসে ( ১৮০৯ সালে ) পাবনা জেলার নিকটে পোতাজিয়া গ্রামে। তাঁর যখন চার বছর বয়স তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়েছিল । তিনি তাঁহার পিতার বিষয়ে কিছু জানতেন না, প্রথম তাঁহার খুড়া রায় মহাশয় এর মুখে তাঁর পিতার নাম শুনেছিলেন । তাঁহার পিতার নাম পদ্মলোচন রায়। রাসসুন্দরীরা তিন ভাইবোন ছিলেন। তাঁর দুই বছরের বড় এক ভাই ও আরেক ভাই তাঁর থেকে দুই বছরের ছোট ছিলেন। তাঁর নাতনী সরবালা সরকার "আমার ঠাকুরমা' নামে একটি বই লিখেছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
রাসসুন্দরীর কন্যা- কালীন তাঁর শৈশব শিক্ষা আরম্ভ হয় । তখন তাঁর বয়স ছিল আট। রাসসুন্দরীদের বাড়িতেই একটি বাঙ্গালা স্কুল ছিল। সেখানেই একজন মেম সাহেব ছাত্রদের পড়াতেন। রাসসুন্দরীকে সেই মেম সাহেবের কাছে বসিয়ে রাখা হতো। অন্য বাচ্চারা যখন পড়াশোনা করত, তার সবকিছু তিনি নীরবে অবলোকন করতেন। এর ফলে কিছুটা হলেও বর্ণপরিচয় তাঁর হয়ে যায়। তখন পারসী পড়ার প্রাদুর্ভাবও ছিল। তিনি মনে মনে এই ভাষাও কিছুটা আয়ত্ত করেন। বারবাড়িতে আগুন লাগার ফলে স্কুলটি পুড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দশ বছর বয়সেই বন্ধ হয়ে যায় তাঁর বিদ্যাশিক্ষার জীবন। এই অক্ষরজ্ঞান থেকেই তিনি পরবর্তীকালে "চৈতন্যভাগবত' পুঁথি চিনতে পেরেছিলেন। তাঁর বড় ছেলের লেখা একটি তালপাতা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। রান্নার কাজের ফাঁকে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে তালপাতার সঙ্গে "চৈতন্যভাগবতের' পাতা মিলিয়ে কঠিন অনুশীলনের দ্বারা পাঠোদ্ধার করতে লাগলেন। কিন্তু তিনি লিখতে জানতেন না। পরবর্তীতে স্বামী অসুস্থ হলে তিনি তাঁর পঞ্চম পুত্র দ্বারকানাথের বিষয় কর্মের স্থান কাঁঠালপোতা , সেখানে থাকলেন। সেই অবকাশে তিনি লিখতে শিখেছিলেন।
সাংসারিক জীবন:
রাসসুন্দরীর যখন ১২ বছর বয়স তখন তাঁহার বিবাহ হয়েছিল। রামদিয়া গ্রামের সীতানাথ সরকার ছিলেন তাঁর স্বামী। তাঁর যখন ১৮ বছর বয়স, তখন তাঁর একটি পুত্র সন্তান হয়, তাহার নাম বিপিনবিহারী। যখন ২১ বছর বয়স, তখন আরো একটি পুত্র সন্তান হয়, তাহার নাম পুলিনবিহারী । ২৩ বছর বয়সে একটি কন্যা সন্তান হয়, তাহার নাম রামসুন্দরী। ২৫ বছরের সময় আরো একটি পুত্র সন্তান হয়, তাহার নাম প্যারীলাল। তার ২৮ বছরের সময় আরো একটি পুত্র সন্তান হয়, তাহার নাম রাধানাথ। যখন তিনি ৩০ বছরের, তখন তাঁর আরো একটি পুত্র সন্তান হয়, তাহার নাম কিশোরীলাল। তাহার পরে একটি পুত্র সন্তান ছয় মাস গর্ভবাস করিয়া গত হয়। পরে যখন তিনি ৩৭ বছরের, তখন তার আরেকটি পুত্র সন্তান হয়, তাহার নাম প্রতাপচন্দ্র। তাহার পর যখন ৩৯ বছর, তখন একটি কন্যা সন্তান হয় তার নাম শ্যামসুন্দরী। পরে যখন তাঁর ৪১ বছর বয়স, তখন তাহার সর্বকনিষ্ঠ পুত্রটির জন্ম হয় তার নাম মুকুন্দলাল। তাঁর পঞ্চম পুত্রের নাম ছিল দ্বারকানাথ। ১৮ বছরে তাঁর প্রথম সন্তানটি হয়, আর ৪১ বছরে সর্বকনিষ্ঠ সন্তানটি হয়েছিল। রাসসুন্দরীর দশটি পুত্র, দুইটি কন্যা, এই বারোটি সন্তান হয়েছিল। তাহার মধ্যে প্রথম পুত্র পুলিনবিহারীর অন্নপ্রাশনের সময় মৃত্যু হয়েছিল। পরে প্যারীলাল নামক আরও একটি পুত্র একুশ বছরে বহরমপুর জেলাতে মৃত্যু হয়। রাধানাথ নামে একটি পুত্রের ১৩ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। আরো একটি পুত্রের তিন বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল, তাহার নাম চন্দ্রনাথ । কনিষ্ঠ পুত্রটির চার বছরে মৃত্যু হয়। বড় কন্যাটির ১৭ বছর বয়সে সূতিকা ঘরে মৃত্যু হয়। তাঁর আরেকটি পুত্র গর্ভাবাসে ছয় মাস থেকে মৃত্যু হয়েছিল । অবশিষ্ট তাঁর চারটি পুত্র, একটি কন্যা ছিল। ১২৭৫ সালে ২৯ মাঘী শিব চতুর্দশীর দিনে, আড়াই প্রহর বেলার সময় তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল।
লিখিত বই:
১৮৭৬ সালে (১২৮৩ বঙ্গাব্দে ) রাসসুন্দরীর লেখা আত্মজীবনী "আমার জীবন' প্রকাশিত হয় । তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৭ বছর। বইটি দুটি অংশে রয়েছে - প্রথমটির মধ্যে ১৬ টি ছোট রচনাবলী রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে তাঁর জীবনের নানা ইতিবৃত্ত এবং দ্বিতীয় অংশ ১৩০৩ সালে প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ৮৮ বছর। এরমধ্যে ১৫ টি রচনাবলী রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ভগবৎ বন্দনার ইতিবৃত্ত।
মৃত্যু:
১৮৯৯ সালে (১৩০৬ বঙ্গাব্দে) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রবন্ধ: সুইটি নাথ (প্রকাশ: ১০.০৫.২০২১)
তথ্যসূত্র :
১) চৌধুরী শীতল : রাসসুন্দরী দাসী "আমার জীবন'
২) আহমেদ ফরিদ, বাঙালিয়ানা : রাসসুন্দরী দাসী এবং আমার জীবন, ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিল