রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম: ২১ ডিসেম্বর,১৮২৭ - মৃত্যু: ১৩ মে, ১৮৮৭)
জন্ম এবং প্রাথমিক জীবন
ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ছিলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ১৮২৭ সালে মাতুলালয়ে, হুগলী জেলার বাকুলিয়া নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামনারায়ণ এবং মাতার নাম হরসুন্দরী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বর্তমান হুগলি জেলার গুপিপাড়া অঞ্চলের সন্নিকটে রামেশ্বরপুর গ্রামে। বাল্যকালে তার পিতা মারা যাওয়ার ফলে তিনি মাতুলালয়ে লালিত-পালিত হন। তিনি একজন স্বদেশপ্রেমী কবি ছিলেন। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্ব শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হল ‛পদ্মিনী উপাখ্যান' (১৮৫৮)।
শিক্ষাজীবন
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বাল্যকালে বাকুলিয়ার স্থানীয় পাঠশালা ও মিশনারী স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর হুগলি মহসিন কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। ইংরেজি ,সংস্কৃত এবং প্রাচীন ওড়িয়া কাব্য ও সাহিত্যে তার জ্ঞান ছিল।
কর্মজীবন
১৮৬০ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ৬ মাস শিক্ষকতার কাজ করেন। তারপর কয়েকদিন আয়কর অ্যাসেসর এবং ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। তারপর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে সুনামের সাথে অনেকদিন চাকরি করার পর ১৮৮৪ সালের ১১ এপ্রিল অবসর গ্রহণ করেন।
সংবাদপত্র
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাহায্যে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তিনি সাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এডুকেশন গেজেট পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। সেই সময়ের এডুকেশন গেজেটে তার গদ্য এবং পদ্য দুই রকম রচনাই প্রকাশিত হত।
১৮৫২ সালে প্রকাশিত "মাসিক সংবাদসাগর' ও ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'বার্তাবহ' পত্রিকা দুটিতে তিনি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি সংবাদ রসসাগর (১৮৫০-১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ) পত্রিকা তিনি নিজে সম্পাদনা করেন। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় "উৎকল দর্পণ' নামে উড়িয়া ভাষায়ও একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এই সংবাদপত্রে তিনি উড়িষ্যার পুরাতত্ত্ব ও উড়িয়া ভাষা সম্বন্ধে অনেকগুলি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
রচনাসমগ্র
তিনি মূলত স্বদেশপ্রেমিক কবিরূপে বিখ্যাত। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্মিনী উপাখ্যান, কর্মদেবী এবং শূরসুন্দরী। প্রথম জীবনে তিনি র. ল. ব. ছদ্মনামে ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় কিছু বাজে কবিতা লিখে প্রকাশ করেন। তিনি পুরাতন গতানুগতিক ছন্দ পয়ার-ত্রিপদী-মালঝাঁপ- একাবলী প্রভৃতি প্রয়োগ করলেও তার কাব্যে পাশ্চাত্য কাব্য রীতির ছাপ পাওয়া যায়। রঙ্গলাল বাংলা সাহিত্যে বীররসাশ্রয়ী দেশাত্মবোধক আধুনিক আখ্যানকাব্যের পথিকৃৎ। সুকুমার সেন তার সম্বন্ধে যথার্থই বলেছেন —
“ইংরেজি কাহিনী-কাব্যের রোমান্স রসের যোগান দিয়া রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নব যুগের দিকে বাঙ্গালা সাহিত্যের মুখ ফিরাইলেন, অবান্তর কাল্পনিক পরিবেশে স্থূল প্রণয়লীলা স্থানে তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশপ্রেমকে কাব্যের বিষয়রূপে গ্রহণ করিলেন।”
বাংলা সাহিত্যে রঙ্গলাল এর যা কিছু খ্যাতি আছে তা শুধুমাত্র পদ্মিনী উপাখ্যান এর জন্য। কর্ণেল টডের "Annals and Antiquities of Rajasthan' বইয়ের অবলম্বনে তিনি এই ঐতিহাসিক আখ্যান কাব্য রচনা করেন। এই কাহিনীর মূল বিষয় মেবারের রানা ভীমসিংহ এবং তৎকালীন দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির মধ্যে যুদ্ধ। আলাউদ্দিন মেবারের রানী পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাওয়ার জন্য মেবার আক্রমণ করলে স্বদেশপ্রেমী রাজপুত বীরদের তার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের বর্ণনা এবং রানী পদ্মাবতীর সতী ধর্ম রক্ষার্থে চিতানলে আত্মদান করার কাহিনী পদ্মিনী উপাখ্যান এর বিষয়বস্তু। পদ্মিনী উপাখ্যানের -
"স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।
দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?”
-গানটি একসময় স্বদেশীদের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় আখ্যানকাব্য ‛কর্মদেবী' । চারটি স্বর্গে বিন্যস্ত এই কাব্যটির বিষয়বস্তুও রাজপুত কাহিনি থেকে নেওয়া। এই কাব্যটিতে কবি উনিশ শতকের পুরুষত্বহীন বাঙালির জাতীয়তাবোধকে জাগানোর চেষ্টা করেছেন। ‛কর্মদেবী’ কাব্যের সম্বন্ধে ভূদেব চৌধুরী বলেছেন,
“জাতিপ্রীতি, আত্মসচেতনতা ও আত্মসমালোচনা, নারী ব্যক্তিত্বের প্রতি মহিমাময় মূল্যবোধ– এই সবকিছু মিলিয়ে উনিশ শতকের বাঙালি নাগরিক জীবনধর্মের অচ্ছেদ্য অংশীদার হয়ে উঠেছেন রঙ্গলাল। আর সেখানেই তিনি জাতিত্বধর্মী বাংলা কাব্যের, বাংলার ‛National Poetry’-র সচেতন পথিকৃৎ।” ( বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা )
তিনি টমাস গারনেলের “The Battle of the Frogs and Mice" কাব্যের অনুবাদে "ভেকমূষিকের যুদ্ধ" (১৮৫৮) নামে একটি ব্যঙ্গ রসাত্মক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৭২ সালে তিনি কালিদাসের "কুমারসম্ভব' ও ঋতুসংহারের পদ্যানুবাদ করেছিলেন কিন্তু তা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেনি। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সংস্কৃত হিতোপদেশপূর্ণ ২০টি শ্লোকের অনুবাদ করে পয়ার ত্রিপদী ছন্দে "নীতিকুসুমাঞ্জলি’ নামক নীতিকথামূলক কবিতা রচনা করেন। রঙ্গলাল ওড়িয়া ভাষাতে পন্ডিত ছিলেন। তিনি পুরুষোত্তম দাস এর প্রাচীন উড়িষ্যা কাব্যের অনুসরণে "কাঞ্চী কাবেরী' (১৮৭৯) নামক ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্টিক আখ্যান কাব্য রচনা করেন। সাতটি স্বর্গে বিন্যস্ত এই আখ্যান কাব্যই তার সর্বশেষ আখ্যানকাব্য। এছাড়া তিনি দীন কৃষ্ণদাসের "রসকল্লোল' থেকে অনুবাদ করে ‛বর্ষাযাপন’ কবিতা রচনা করেন। ‛কলিকাতা কল্পলতা’ গ্রন্থটিই সম্ভবত বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম কলকাতার মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। রঙ্গলাল ১৮৮২ সালে কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের "কবিকঙ্কন চন্ডী' সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি ওমর খয়্যামের কতগুলি রুবাই বাংলা পয়ারে অনুবাদ করেছিলেন।
সাহিত্যকর্ম
কাব্যগ্রন্থ
রঙ্গলাল গ্রন্থাবলী (১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ, ১২৬৯ বঙ্গাব্দ)
পদ্মিনী উপাখ্যান (১৮৫৮)
কর্মদেবী (১৮৬২)
শূরসুন্দরী (১৮৬৮)
কাঞ্চীকাবেরী (১৮৭৯)
অনুবাদ
মেঘদূতম্
ঋতুসংহার (১৮৭২)
ভেক-মূষিকের যুদ্ধ (১৮৫৮)
কুমারসম্ভব (১৮৭২)
নীতি কুসুমাঞ্জলি (১৮৭২)
গদ্য
কলিকাতা কল্পলতা (রচনাকাল, আনুমানিক ১৮৫০-৭০ খ্রিষ্টাব্দ, প্রকাশিত ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে)
মৃত্যু
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৭ সালে ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রবন্ধ: রাজর্ষি মোহান্ত
তথ্যসূত্র:
তথ্যসূত্র:
বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, ড.অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ড. দেবেশ কুমার আচার্য
উইকিপিডিয়া
(প্রকাশিত: ১৮.০৫.২০২১)
There are no reviews yet.