রাজশেখর বসু (পরশুরাম, ১৮৮০-১৯৬০)
রাজশেখর বসু ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা। হাস্যরসের নিপুণ শিল্পী রাজশেখর বসু। পরশুরাম ছদ্মনামে বাংলা ছোটগল্পে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম হাস্যরসিক ও কথাসাহিত্যিক।
জন্ম:
রাজশেখর বসু ১৮৮০সালে ১৬ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চন্দ্রশেখর বসু দার্শনিক পন্ডিত ছিলেন। তিনি দ্বারভাঙ্গা রাজ এস্টেটের ম্যানেজার। মায়ের নাম লক্ষ্মীমণি দেবী। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল নদীয়া জেলার বীরনগর (উলা) গ্রামে। দ্বারভাঙ্গায় রাজশেখরের শৈশব জীবন কেটেছিল।
শিক্ষাজীবন:
রাজশেখর বসু ১৮৯৫ সালে দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে এন্ট্রাস, ১৮৯৭ সালে পাটনা কলেজ থেকে এফ. এ পাশ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৯ সালে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন। তখন এম এস সি কোর্স চালু না হওয়ায় ১৯০০ সালে রসায়নে এম.এ পরীক্ষা দেন এবং প্রথম হন।
কর্মজীবন:
১৯০২ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি. এল পাশ করে মাএ তিনদিন তিনি আইন ব্যবসা করেছিলেন। আইন ব্যবসার তুলনায় বিজ্ঞান চর্চায় তাঁর অধিক আগ্রহ থাকায় তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯০১ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত "বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস কোম্পানি'তে ১৯০৩ সালে যোগদান করেন। দক্ষতা ও সৃজনশীলতার গুণে ১৯০৪ সালে তিনি এই কোম্পানির পরিচালক পদে উন্নীত হন। কোম্পানিতে গবেষণার মাধ্যমে তিনি কেমিস্ট্রি ও ফিজিওলোজির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে এক নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। ১৯৩২ সালে অবসর গ্রহণ করলে ও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি উপদেষ্টা এবং পরিচালক পদে বেঙ্গল কেমিক্যালের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯০৬ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলে তিন তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।
সাহিত্যকর্ম:
বাংলা সাহিত্যে রসরচনার জন্য খ্যাতিমান ছিলেন রাজশেখর বসু। তাঁর সাহিত্যিক কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০ এর দশকে। বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গ কৌতুকে পরশুরাম উজ্জ্বল শিল্পী।পরশুরাম ছদ্মনামে ১৯২২ সালে একটি মাসিক পত্রিকায় "শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' নামে ব্যঙ্গ রচনাটি প্রকাশিত হয়। তিনি অনেকগুলো রসরচনামূলক গল্পগ্রন্থ রচনা প্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম বই "গড্ডলিকা'। "শনিবারের চিঠি' পত্রিকাতেও তিনি নিয়মিত লিখেছেন। গল্পরচনা ছাড়াও স্বনামে প্রকাশিত হয় কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মিকী রামায়ণ (সারানুবাদ), কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ), শ্রীমদভগবদগীতা ইত্যাদি ধ্রুপদী ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় রাজশেখর বসুর বাংলা অভিধান গ্রন্থ "চলন্তিকা'। এগুলি ছাড়াও লঘুগুরু, বিচিন্তা, ভারতের খনিজ, কুটির শিল্প প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন।
পরশুরাম রচিত গ্রন্থাবলী:
পরশুরামের গল্প গ্রন্থগুলি হল: গড্ডলিকা, কজ্জলী, হনুমানের স্বপ্ন, গল্পকল্প, ধুস্তরী মায়া, কৃষ্ণকলি, নীলতারা, আনন্দী বাঈ, এবং চমৎকুমারী।
এই নয়টি গল্পগ্রন্থ এবং গল্পের সংখ্যা সাতানব্বই। বিষয় অনুসারে এই গল্পগুলিকে কয়টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন-
(ক) সাধু, গুরু, ভবিষ্যৎ বক্তা সম্পর্কিত:
"শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' (গড্ডলিকা), "বিরিঞ্চিবাবা' (কজ্জলী), "গুরু বিদায়' (হনুমানের স্বপ্ন), প্রভৃতি।
(খ) প্রেম-প্রীতি-দাম্পত্যজীবন ও নর নারীর বিচিত্র সম্পর্ক বিষয়ক:
"ভূশণ্ডীর মাঠে' (গড্ডলিকা), "চিকিৎসা সংকট' (গড্ডলিকা), "লম্বকর্ণ' (গড্ডলিকা), "স্বয়ম্বরা' (কজ্জলী), "পঞ্চপ্রিয় পাঞ্চালী' (কৃষ্ণকলি)' রাজমহিষী' (আনন্দীবাঈ) "উৎকন্ঠাস্তম্ভ' (চমৎকুমারী) ইত্যাদি।
(গ) ভূত ও অতিপ্রাকৃত বিষয়ক: "ভূশুণ্ডীর মাঠে' (গড্ডলিকা), "মহেশের মহাযাত্রা' (হনুমানের স্বপ্ন), "বদন চৌধুরীর শোকসভা' (ধুস্তরী মায়া),' জটাধর বক্সী' (কৃষ্ণকলি) ইত্যাদি। (ঘ) উদ্ভট ও আজগুবি বিষয়ক: "উলট পুরাণ'(কজ্জলী), "পরশ-পাথর' (গল্পকথা), "যদু ডাক্তারের পেসেন্ট' (ধুস্তরী মায়া), "অদলবদল' (আনন্দীবাঈ) ইত্যাদি।
(ঙ) রূপান্তর বৈশিষ্ট্য সূচক: (মানুষে-পশুতে, পুরুষে-নারীতে) "লম্বকর্ণ' (গড্ডলিকা), "দক্ষিণ রায়' (কজ্জলী), "নিকষিত হেম' (কৃষ্ণকলি) "যযাতির জরা' (আনন্দীবাঈ)
(চ) পশু-পাখি-সংক্রান্ত: "গুরুবিদায়' (হনুমানের স্বপ্ন), "লক্ষ্মীর বাহন' (ধুস্তরী মায়া), "ষষ্ঠীর কৃপা' (ধুস্তরী মায়া), "নিরামিশাষী বাঘ' ( কৃষ্ণকলি), "শিবলাল' (নীলতারা), "রাজমহিষী' (আনন্দীবাঈ)।
(ছ) জড়পদার্থ কেন্দ্রিক: "পরশপাথর' (গল্পকথা)
(জ) পুরাণ বিষয়ক: "জবালি' (কজ্জলি), "প্রেমচক্র' (হনুমানের স্বপ্ন), "পুনর্মিলন' (হনুমানের স্বপ্ন), "তিন বিধাতা' (গল্পকথা), "ভারতের ঝুমঝুমি' (ধুস্তরী মায়া), "স্মৃতিকথা' (নীলতারা), "ডম্বরু পন্ডিত' (আনন্দীবাঈ) ইত্যাদি।
(ঝ) রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি বিষয়ক: "রামরাজ্য' (গল্পকথা), "গন্ধমাদন বৈঠক' (ধুস্তরী মায়া), "মাঙ্গলিক' (নীলতারা), "উৎকোচতত্ত্ব' (চমৎকুমারী)।
(ঞ) কল্প-বিজ্ঞান প্রসঙ্গ: "মাঙ্গলিক' (নীলতারা), "গগনচটি' (আনন্দীবাঈ) ইত্যাদি।
(ট) মনুষ্যত্ববোধ ও আদর্শমূলক: "মহেশের মহাযাত্রা' (হনুমানের স্বপ্ন), "অটলবাবুর অন্তিমচিন্তা' (গল্পকথা), "ভবতোষ ঠাকুর' (কজ্জলী, "ধনুমামার হাসি' (নীলতারা), "নির্মোকনৃত্য' (আনন্দীবাঈ) ইত্যাদি।
(ঠ) সাহিত্যদর্শ ও সাহিত্যিক সংক্রান্ত: "কচি সংসদ' (কজ্জলী), "প্রেমচক্র' (হনুমানের স্বপ্ন), "রটেশ্বরের অবদান' (আনন্দীবাঈ) ইত্যাদি।
সম্মান গ্রহণ:
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪০ সালে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ১৯৫৫ সালে কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্পগ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রবীন্দ্র পুরস্কার ভূষিত করে। ১৯৫৮ সালে আনন্দীবাঈ গল্প বইটির জন্য ভারতের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গঠিত বানান- সংস্কার সমিতি ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিভাষা সংসদের সভাপতিত্ব করেন রাজশেখর বসু ১৯৪৮ সালে। ১৯৫৭-৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপুর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি প্রদান করেন। ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ উপাধি প্রদান করে। ১৯৫৫ সালে সরোজিনী পদে ভূষিত হন। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় রাজশেখর বসুর দুটি ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেগুলো হল পরশপাথর এবং বিরিঞ্চিবাবা অবলম্বনে নির্মিত মহাপুরুষ।
মৃত্যু:
রাজশেখর বসু মৃণালিনী দেবীর এক কন্যা ছিল। তাঁর মেয়ের জামাই খুব অল্প বয়সে অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। শোকে কাতর হয়ে মেয়ে ও একই দিনে মারা যায়।তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ১৯৪২ সালে লোকান্তরিত হন। পরবর্তী ১৮ বছর স্ত্রীবিহীন একাকী জীবনে রচিত হয় রাজশেখর বসুর অমূল্য সাহিত্যকর্ম। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ দুর্দশার কথা তাঁর লেখনিতে পাওয়া যায় নি। ১৯৫৯ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে পড়লে ও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬০ সালে ২৭শে এপ্রিল দ্বিতীয় বার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রবন্ধ: শতাব্দী নাথ
তথ্যসূত্র:
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দেবেশ কুমার আচার্য
উইকিপিডিয়া
(প্রকাশিত: ৩১.০৫.২০২১)
There are no reviews yet.