কর্তাভজা সম্প্রদায়
কর্তাকে ভজনা করেন যাঁরা তাঁরাই কর্তাভজা। এই কর্তা কে? কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বই-পুথিঁ থেকে এটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। এ সম্প্রদায়ের বিজ্ঞলোকেরা বলেন- "একমাত্র বিশ্বকর্তা ভজনা করাই আমাদের ধর্ম'। "আবার যিনি সকলের মূল, তিনি সর্বকর্তা, তার ভজনের নামই কর্তাভজা। এই উপাসনা করলে সকলের উপাসনাই করা হল। "অন্যত্র "রামশরণ উঠিয়া দাঁড়াইবা মাত্র ফকির তাকে "কর্তাবাবা' বলে সম্বোধন করিলেন। রামশরণ তখন ফকিরকে আলিঙ্গন করিবামাত্র দুই দেহ এক হয়ে গেল।'
আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদ থেকে বিকশিত একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় এই কর্তাভজা। এই সম্প্রদায়ের মূল গুরু আউলচাঁদ। গৃহী মানুষকে বৈরাগ্য ধর্ম শেখাতে শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হন আউলচাঁদ ফকির হয়ে। এখানে তাই কোনো জাতিভেদ নেই। আউলচাঁদ মুসলমান না হিন্দু ছিলেন তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। তাঁর আউল নাম থেকে মনে করা হয় তিনি মুসলমান ছিলেন, কারণ আউল "বাউল' মতবাদের একটি শাখা। তবে তিনি নিজের এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। তাঁর প্রথম জীবন সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। প্রচলিত লোককাহিনি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার উলাগ্রামে পানক্ষেতে একটি নবজাত শিশু পাওয়া যায়। ক্ষেতের মালিক মহাদেব বারুই তাঁকে লালনপালন করেন। বড় হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং ফকির হিসেবে ঘুরে বেড়ান। এসময় তাকে সবাই আউলচাঁদ হিসেবে জানত। আউল মহাপ্রভুকে বলতেন কর্তা, ঈশ্বর বা খোদা নয়। সঙ্গীত ছিল সাধনার প্রধান মাধ্যম। তিনি তাঁর অনুসরীদের বলতেন ঈশ্বর বা খোদা জ্ঞানে কর্তার উপাসনা করতে। তৎকালীন লোকেরা তাই সম্প্রদায়কে বলত কর্তাভজা। তাঁর অনুসরীদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু ও তারা তাঁকে চৈতন্যদেবের অবতার মনে করে পূজা করত।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, আউলচাঁদ প্রথমে হটু ঘোষকে দীক্ষিত করেন। পরে ঘোষপাড়ার রামশরণ পালকে এবং আরও একুশ জনকে। এই বাইশ জনের মধ্যে হিন্দুও মুসলমান উভয়ই ছিল। এদের মধ্যে রামশরণ পালই পরে "কর্তাবাবা' হিসাবে পরিচিত হন।
কর্তাভজা সম্প্রদায় কোন জাতিভেদ মানে না। তবে সামাজিক জীবনে তাদের মধ্যে জাতিভেদ আছে। দুলাল চাঁদ তার "ভাবের গীত'-এ জাতিভেদকে অস্বীকার করেছেন। এঁরা গুরুবাদী। গুরুকে এরা বলেন "মহাশয়' এবং শিষ্যকে "বরাতি'।
কর্তাভজাদের মধ্যে "দায়িক মজলিস' বলে একটি প্রথা আছে। এটি খ্রিস্টানদের confession এর মতো। এছাড়া Ten Commandments এর মতো দশটি নিয়ম আছে।শুক্রবার মুসলমানদের কাছে মিলনের দিন। কর্তাভজারা এটিকে সৃষ্টির দিন হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
বর্তমানে ঘোষপাড়ার দোলখেলা "সতীমায়ের মেলা' নামে পরিচিত। ভক্তরা ঘোষপাড়া অর্থে তাঁদের "মায়ের বাড়িতে' আসেন এবং তীর্থক্ষেত্রের সর্বাধিক পূন্যস্থান হিসেবে প্রধানত দুটি স্থানকে দর্শন, পুজার্পন করে থাকেন- এক, সতীমায়ের সমাধি মন্দির ও দুই, তাঁর সিদ্ধিলাভের স্থান-ডালিমতলা। এই দুই স্থানের কাছেই একটি পুকুর আছে।সেটিকে "হিমসাগর' বলে। এখানে স্নান গঙ্গাস্নানের মতোই পুন্যকর্ম।
ঘোষপাড়ার প্রধান উৎসব হল-
১. দোল পূর্ণিমা
২.বৈশাখী পূর্ণিমার রথযাত্রা
৩. আষাড়ের রথযাত্রার পর চতুর্থীতে রামশরণ পালের তিনদিন ব্যাপী স্মরণ মহোৎসব
৪. সতীমায়ের মহোৎসব এবং
৫. কোজাগরী লক্ষ্মীপুজার উৎসব।
কর্তাভজা ধর্মকে "সত্যধর্ম' বলা হয়।
প্রবন্ধ: টিনা চন্দ
তথ্যসূত্র:
১.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
(প্রকাশিত: ২৮.০৫.২০২১)
There are no reviews yet.