ক্ষেত্রপাল
ক্ষেত্রপাল শব্দের অর্থ হলো ক্ষেত্রের অধিপতি ও সৃষ্টির অধিপতি বা মঙ্গলের ধারক ও বাহক। ক্ষেত্রপাল সর্বভারতীয়দের একজন দেবতা। কৃষকদের একজন লৌকিক দেবতা হিসাবে ক্ষেত্রপাল পূজিত হন। বাংলার লোকসমাজে ক্ষেত্রপাল এর পুজো দীর্ঘ দিন ধরেই প্রচলিত হয়ে আসছে। অনেকেই ক্ষেত্রপালকে শিবের একটি রুদ্র রূপ হিসাবে কল্পনা করে থাকেন। কারণ মঙ্গলকাব্য এর মধ্যে শিব কৃষি কার্যের সঙ্গে নিযুক্ত ছিলেন। তন্ত্রশাস্ত্রে শিবের একটি নাম হলো ক্ষেত্রপাল। তাই ক্ষেত্রপাল যে শিবেরই রূপান্তর তাতে আমাদের মধ্যে কোনো সংশয় নেই। ক্ষেত্রপালের কোনো নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। তাছাড়া অনেকই ক্ষেত্র পালকে একজন "অনার্য দেবতা' বলেছেন। ক্ষেত্র দেবতার পুজো হলো এক ধরনের প্রতীক পুজো। কোনো কোনো জায়গায় ক্ষেত্রপাল মূর্তির আকারে বা শিলার আকারে পূজিত হন। অনেক সময় ক্ষেত্রপালের কোনো বিশেষ মূর্তি না থাকার জন্য ধর্ম ঠাকুরকে নিম্ন বিত্ত মানুষেরা ক্ষেত্রপাল হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। মানুষ নানা প্রকার রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ক্ষেত্র পালের কাছে প্রার্থনা করে থাকেন। এমনকি রোগ মুক্তি থেকে শুরু করে দুঃখ- দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ও মানুষ লৌকিক দেবতার কাছে প্রার্থনা করেন।
ক্ষেত্রপালের মন্দির
ক্ষেত্র পালের মন্দিরটি বর্ধমান জেলার পানাগড় মিলিটারি ক্যাম্পে অবস্থিত। ক্ষেত্র পাল দেবতার অবস্থান ছিল হাঁসুয়া নামক একটি গ্রামে। হাসুয়া গ্রামে ক্ষেত্রপাল পুজোর সূত্রপাত কবে হয়েছিল তা সম্পূর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করে। পূজারীদের মধ্যে অন্যতম একজন পূজারী হলেন ষষ্ঠীচরণ চক্রবর্তী। তার মতে এই পুজো আনুমানিক পাঁচশো বছরের ও একটি পুরনো পুজো। প্রথমে ক্ষেত্রপালের অবস্থান ছিল খোলা আকাশের নীচে। বহু পরে ক্ষেত্রপালের মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। মানুষের বিশ্বাস ক্ষেত্রপালের কাছে মানত করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। দেবতার আশীষ পাওয়ার আশায় মন্দিরে ভক্তগণ মানত করে একটি মাটির ঘোড়া বাঁধেন। পরে আশা পূর্ণ হলে যে কোনো একটি ঘোড়া খুলে পিতলের একটি ঘন্টা বেঁধে আসেন। ক্ষেত্রপালের মন্দিরে গেলে আমাদের চোখে পড়ে হাজার হাজার পিতলের ঘন্টা। ক্ষেত্রপালের ধ্যান মন্ত্রের মধ্যে ঘণ্টার উল্লেখ আছে। "বিশ্ব কোষ' নামক একটি তন্ত্র গ্রন্থে ক্ষেত্রপালের নাম ছিল "ঘণ্টাদ'। এই "ঘন্টাদ' নাম থেকেই এই ঘণ্টা বাঁধার রীতি প্রচলিত হয়েছিল।
ক্ষেত্র পালের পুজোর নিয়মাবলি
বাংলা মঙ্গলকাব্যে ক্ষেত্রপালের যে বন্দনা পাওয়া যায় তা থেকে মনে হয় ক্ষেত্রপাল দেশের সকল দিক রক্ষাকারী একজন দেবতা। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ক্ষেত্রপালের বিশেষ পুজোর রীতি প্রচলিত রয়েছে উত্তর বঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার প্রভৃতি জেলায়। ক্ষেত্রপালের পুজো শুরু হয় দোল পূর্ণিমার দিন থেকে। নিত্য পুজো করা হয় পালা করে। নিত্য পুজোয় নারকেল, ফল, মিষ্টি প্রভৃতি দেওয়ার রীতি ই প্রচলিত। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের শনি ও রবিবার ক্ষেত্র পালের বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শ্রাবণ মাসের প্রত্যেক সোমবারের পুজোয় ভক্ত সমাগম হয় একটু বেশি। বাংলার লোক সমাজে ক্ষেত্র পাল জাগ্রত দেবতার আসন লাভ করেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই তার মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য ক্ষেত্র পালের পুজোতে হাজির হয়ে এই পুজোকে জনপ্রিয় করে তুলেন।
মধ্য বঙ্গের হাওড়া জেলার কোনো কোনো স্থানে ক্ষেত্রপালের পুজোর রীতি আমাদের চোখে পড়ে, তাছাড়াও বাংলাদেশে উত্তর বঙ্গের কয়েকটি জায়গায় এবং চট্ট গ্রামে ক্ষেত্র পালের পুজোর প্রাধান্যও লক্ষ্য করা যায়। ক্ষেত্রপালের পুজোর প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয় কাসার ঘট বা কলসি, একটি থালা, এবং বংশ দন্ড। দোল পূর্ণিমার সময় বন থেকে বংশ দন্ড সংগ্রহ করে, তারপর এটিকে পুকুরে স্নান করিয়ে লাল কাপড় জড়িয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ এর পর সেটিকে পুজো ক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয়। দশ দিন সেটিকে পুজো করার পর নিকটবর্তী কোনো পুকুরে রাখা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সেটিকে তুলে এনে আবার মহা আড়ম্বরে পুজো করা হয়। ক্ষেত্র পালের পুজোয় দুধ, আতপ চাল, মিষ্টান্ন দ্রব্যের সঙ্গে আমিষ জাতীয় খাদ্য ও নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। বর্তমানে এই পুজো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
প্রবন্ধ: তন্ময়ী চৌধুরী
তথ্যসূত্র:
বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী।
(প্রকাশিত: ২৭-০৫-২০২১)
There are no reviews yet.