E-Learning Info
Go to content

ফার্স বা প্রহসন

ভূমিকা:

প্রহসনই সম্ভবত বাংলা নাট্য সাহিত্যের একমাত্র শ্রেণী যা প্রত্যেক শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের প্রতিভাস্পর্শ লাভ করেছে । প্রহসন একধরনের হাস্যরসাত্মক নাটক তবে এর হাস্যরস কে প্রধান প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়– স্যাটায়ার বা খোলাখুলি ব্যঙ্গ, উইট বা বাকভঙ্গিজনিত ব্যঙ্গ তথা পরিস্থিতি গত হাস্যরস এবং হিউমার বা সহানুভূতিশীল তথা অশ্রুসজল হাস্যরস। প্রহসনের উদ্দেশ্য হল হাস্যরস ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপের অতিরঞ্জিত, অসংযত ও অভাবনীয় অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শকদের বিনোদন প্রদান করা। প্রহসন মূলত মঞ্চস্থকরন বা চলচিত্রায়নের জন্য লেখা হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রহসন রচনার পথ প্রদর্শক হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। "একেই কি বলে সভ্যতা' এবং 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো' বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক প্রহসন। পরবর্তীকালে দীনবন্ধু মিত্র প্রহসন রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। রাম নারায়ণ তর্করত্ন যখন "কুলীনকুলসর্বস্ব' "নবনাটক' লেখেন তখন স্পষ্টই বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত সমকালীন সমাজ আন্দোলন দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। রামনারায়ণ থেকে মধুসূদন দীনবন্ধু পর্যন্ত প্রহসন সাহিত্য মূলত প্রগতিপন্থী। তবে প্রয়োজনে গিরিশচন্দ্র ও কিছু প্রহসন রচনা করেছিলেন, কিন্তু তিনি আদর্শবাদী ও গম্ভীর ব্যক্তি ছিলেন বলে হাস্যরস তার স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র ছিল না বলে তিনি প্রহসন রচনায় উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। প্রহসন রচনার মাধ্যমে দ্বিজেন্দ্রলাল  বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন, তবে হাসির গানের রাজা হলে ও তিনি প্রহসনে অনুরুপ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হনন। এদিকে স্যাটায়ারকে কেন্দ্র করে প্রহসন রচনার সূত্রপাত করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও এর থেকে পিছিয়ে নেই "বৈকুণ্ঠের খাতা'য় রবীন্দ্রনাথ গভীরতর স্তরে আঘাত করার প্রয়াসী এবং এই আঘাতের মাধ্যমে বাংলা প্রহসনে নতুন হাস্যরস তিনি সৃজন করেছিলেন। বাস্তব উপাদানের অবাস্তব সন্নিধানের প্রয়োজন মানুষ তার মন রাজ্যে স্বীকার করে থাকে। ব্যক্তিমানসের বস্তুছায়া বিকরনে বস্তুর যে রূপ উপলব্ধি করা হয় তার মূল্যায়ন অনেকটাই আপেক্ষিক । সমাজ চিত্রের মূল্য ও তাই বিবেচনার অধীন হয় ।
বিষয়:

দৃষ্টিকোণ সংগঠন সমস্যাগুলোকে লেখক তার বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করে থাকেন। এই সমস্যাকে জড়িয়ে যে সামাজিক চিন্তাভাবনা ও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তাই সমাজ চিত্র। প্রহসনের সমাজচিত্র অতিরঞ্জিত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। ফলে প্রহসনের সমাজচিত্র প্রদর্শনী মাত্রারক্ষার মাধ্যমে এবং মাত্রা বিচারের মাধ্যমে উপস্থাপিত হওয়া উচিত। এ নিয়ে মধুসূদন 'একেই কি বলে সভ্যতা' ও "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো' নামে দুটো প্রহসন রচনা করেন। "একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসনে মধুসূদন ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত তথাকথিত আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত কলেজে পড়া যুব সম্প্রদায়ের ভ্রষ্টাচার, মদ্যপানাসক্তি, সংস্কারের নামে ভোগবিলাসী স্বেচ্ছাচারের বিকৃত রূপকেই প্রকাশ্য তুলে ধরেছে। মদ্যপানে অভ্যাস শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছিল। কিন্তু তার মাত্রা লঙ্ঘন ও তৎসংশ্লিষ্ট বার-বনিতা দোষ এবং সমাজ সংস্কারের কপটতার আড়ালে ভোগমূলক চাহিদাকেই মধুসূদন চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন অপসংস্কৃতিরূপে । রাজনারায়ণ বসুর মতে –
"তাহারা মনে করিতেন এক গ্লাস মদ খাওয়া কুসংস্কারের উপর জয়লাভ করা। মনে রাখা দরকার , এই মদ্যপানাসক্তি দুরারোগ্য  ব্যাধিরূপে তখন নাগরিক সমাজের মধ্যে দারুনভাবে সংক্রমিত হয়। প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ ব্যক্তিরা সুরাপান নিবারণী আন্দোলন চালান। পরবর্তীকালে দীনবন্ধু মিত্র ও অন্যান্য নাটক ও ব্যাপারটিকে নিয়ে প্রহসন রচনা করেন।'১
' বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো ' প্রহসনে লেখক হানিফ ও ফতিমার মুখে যশোহরের গ্রাম্য ভাষা দিয়ে মধুসূদন হাস্যকর পরিবেশ ও কৌতুক সৃষ্টি করলে তাতে ফুটে উঠেছে জমিদারি প্রথার নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা এবং প্রজাশোষণের ধারাকে ফুটিয়ে তুলেছেন । এই প্রহসনে সামাজিক সাধারণ চিত্রের প্রত্যক্ষতা শিল্পরূপ প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রহসন সমাজ সমস্যার ভিত্তিতে জন্ম নিয়েছে , সমাজ সমস্যা কে আত্মসাৎ করে গল্প গঠিত হয়েছে , চরিত্র সৃষ্ট হয়েছে । চরিত্রহীন বৃদ্ধ জমিদারের লাম্পট্যের কাহিনীতে ব্যাপক সমাজ সত্যের ছায়া পড়েছে ।
                              বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র তার উল্লেখযোগ্য ' সধবার একাদশী ' নাটকে সমসাময়িক কালের শিক্ষিত যুবক এবং ধনীর আদরে লালিত বিপথগামী সন্তানদের প্রকৃতি ও পরিণাম চিত্রিত হয়েছে। মধ্যপান ও তৎসংশ্লিষ্ট নৈতিক অধঃপতন কিভাবে সমাজকে বিধ্বস্ত করে তা দেখানোর জন্যই নাট্যকার নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবন রহস্যের গভীরে প্রবেশ করেছেন । তৎকালীন ইয়ংবেঙ্গল দলের উচ্ছলতা ও অনাচারের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। যেখানে সে যুগের কলকাতার উচ্চশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের পানা শক্তি , লাম্পট্য, পরস্ত্রী হরণ প্রভৃতি চরিত্রভ্রষ্টতার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ' সধবার একাদশী' প্রহসনে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে তখনকার নবীনসম্প্রদায়ের মধ্যে  মদ্যপান ইংরেজি সভ্যতাকে নিমচাঁদের মধ্য দিয়ে মদের নেশায় ও চারিত্রিক অবনতিতে তলিয়ে গেছেন। যেখানে নিমচাঁদ বলতে দেখা যায় :-
              "I read English, write English, talk English speechify English , think in English and dream in English "২
আসলে এই প্রহসনে নাট্যকার নিমচাঁদের মধ্যদিয়ে সে যুগের চরিত্রহীন যুবক সম্প্রদায় কে বুঝিয়েছেন।
দীনবন্ধুর রচনা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন -
                     "তোরপের সৃষ্টিকালে তোরাপ যে ভাষায় রাগ প্রকাশ করে তাহা বাদ দিতে পারিতেন না, নিমচাঁদ গড়িবার সময়ে নিমচাঁদ যে ভাষায় মাতলামি করে তাহা ছাড়িতে পাড়িতেন না, রুচির মুখ রক্ষা করিতে গেলে ছেঁড়া তোরাপ, কাটা আদুরি, ভাঙ্গা নিমচাঁদ আমরা পাইতাম।" ৩
                      'বিয়ে পাগলা বুড়ো' দীনবন্ধুর সর্বপ্রথম প্রহসন। এটি মধুসূদনের পুরো শালিকের ক্ষারের ও এর আদর্শের রচিত বঙ্কিমচন্দ্রের মতে:-
                    
" বিয়ে পাগলা বুড়ো ও জীবিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত হইয়াছিল।"৪
প্রহসন ধর্মী নাটকটি তিন অঙ্কে বিন্যস্ত প্রথমদিকে স্থুল বাহীিক জীবনের প্রাধান্যদান। তারপর আচার আচরণ ছেড়ে ব্যক্তি স্বরূপকে ধরবার চেষ্টা। ষাট বছরের বুড়ো যার পনেরো বছরের বিধবা কন্যা থাকা সত্ত্বেও সে পুনরায় বিবাহে উৎসুক। বিবাহ  বাতিকগ্রস্ত সেই বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের   পাকা ছেলেরা কিভাবে তাকে নাস্তানাবোধ করেছিল  তারই কৌতুক রসের কাহিনী। পাশাপাশি বিষয় ভাবনার গভীরে প্রবেশ না করে রসালো সংলাপের সঙ্গে গ্রাম্য ছড়া ও কবিতা পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি বাংলা প্রহসনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন ।
      
                           স্ত্রী প্রধান প্রহসন 'জামাই বারিক' প্রহসনটিতে বাংলার ধনী উচ্চঘরের শ্বশুরবাড়িতে ঘর জামাই পোষে রাখার প্রতাকে হাসিঠাট্টা ও রঙ্গ-বেঙ্গের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে। অনেকগুলো জামাইকে একটা ব্যরাকের মধ্যে পুরে রাখা এবং তাদের অন্তপুরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক হলেও প্রহসনের ক্ষেত্রে তা যথাযথ হয়েছে । পূর্বের কুলিন জামাইরা নিষ্কর্ম বেকার অবস্থায় শ্বশুরের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতো বলে তারা সকলের কাছে হাসির পাত্র হয়ে থাকত। এই কুলিন জামাইদের করুন অবস্থা ফুটে উঠেছে আলোচ্য প্রহসনে। দীনবন্ধু তৎকালীন হিন্দু সমাজের ঘরজামাইয়ের সমস্যা , বহুবিবাহের বিড়ম্বনা ও পারিবারিক বিষাদ উপস্থাপনসহ হাসি – আনন্দ ও অফুরন্ত কৌতুকরসের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।
                      রামনারায়ন তর্করত্ন সংস্কৃত প্রহসনের আদর্শে বাংলা প্রহসন রচনার পতিকৃৎ। তার শ্রেষ্ঠ প্রহসন 'কুলিনসর্বস্ব' (১৮৫৮) সমকালীন সামাজিক সমস্যা অবলম্বনে রচিত এ নাটকে তিনি হিন্দু সমাজের কৌলীন্য প্রথার রুপ তথা কুলিন ব্রাহ্মণদের বিবাহ বহির্ভূত যৌন বাসনা ও কামনা এবং দলিত কুলিন তনয়াদের বেদনাময় পরিণতিকে তুলে ধরেছেন ।
উপসংহার:-
প্রহসন নিয়ে 'স্বাধীনজেনানা' প্রহসনের একটি কথায় রামালদাস বলেছেন :
           "কেহ যেন মনে করে না এই প্রহসন দ্বারা কোন বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণীকে লক্ষ্য করা হইয়াছে । যদি কেহ গায়ে পরিয়া লইয়া  বিবাধ বাধাইতে চাহেন , তবে গ্রন্থাগার বলেন, সন্ন্যাসী চোর নয়, বোঁচকায় ঘটায়।"৫
প্রহসনের সমাজচিত্রে মাত্রা নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট অবকাশ আছে , উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা প্রহসনগুলি অধিকাংশই ব্যক্তিগত আক্রমণে ব্যক্তিগত কৃৎসা ঘটনের  প্রয়াস , প্রহসনের সমাজচিত্র আপাত দর্শনে সমাজের ভয়াবহ রূপের স্বাক্ষর বলে অনুভূত হয় । সমাজের এই ভয়াবহতা ও বীভৎসতার  মধ্যে বাস্তব সত্য যে বিন্দুমাত্র নেই , তা নয় রুচি এবং সাহিত্যিক সংস্কার সমাজের ভয়াবহ রূপের অনেক অংশই সভ্যতার নামে আবৃত রেখেছে এবং প্রহসনের সেই রূপকেই লেখক অনাবৃত করার চেষ্টা করেছেন । যেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত , দীনবন্ধু মিত্র , রামনারায়ণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাহসনিক দৃষ্টিকোণ সমাজের সর্বাঙ্গ চিত্র উপস্থাপিত হতে পারে নি । মানসিক বাধা ছাড়া ও বাহ্য কতকগুলো বাধা অনেকক্ষেত্রে বিদ্যমান থাকায় সমাজচিত্রের অনেকাংশই প্রহসন ধরা পড়ে নি । তাছাড়া প্রচুর প্রহসন অতলে তলিয়ে গেছে সেগুলোর মধ্যে উপস্থাপিত সমাজের অনেক মূল্যবান তথ্য ছিল যা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ।
প্রবন্ধ: সুপ্রিতা নাথ
(প্রকাশিত: ২৩.০৯.২০২৩)
There are no reviews yet.
0
0
0
0
0
https://visitorshitcounter.com/

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content