E-Learning Info
Go to content

দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা

বিশ শতকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা দেশ বিভাগ। এই দেশ বিভাগের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিশ শতকের ঐতিহাসিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে এই ঘটনা। উনিশ শতকের শেষ দিকে শিক্ষিত ভারতীয়দের নবজাগ্রত বোধ জন্ম দিয়েছিল ভারতের প্রথম স্বদেশীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় কংগ্রেসের (১৮৮৫)। প্রাথমিকভাবে এই রাজনৈতিক সদস্যদের ভূমিকা ছিল খানিকটা আবেদনের মত। অল্প দিনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠলো বহুবিধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী যারা দেখতে আরম্ভ করল স্বাধীনতার স্বপ্ন। বিশ শতাব্দীর প্রথম সাড়ে চার দশক ব্যাপ্ত করে এই স্বাধীনতা স্পৃহ রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্রম বিস্তৃতি সূচিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি পদে ব্রিটিশ শাসকের সম্পর্ক জটিল হয়েছে উত্তরোত্তর। অবশেষে নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু বহু প্রজন্ম বাহিত ধর্ম বিভেদ জনিত দূরত্ব, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভ্রান্ত পদক্ষেপ এবং ব্রিটিশ রাজশক্তির কুটবুদ্ধি এই তিনের সমন্বয়ে সেই স্বাধীনতার সঙ্গে এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি জড়িয়ে গেল সেটাই হল দেশ বিভাগ। প্রায় দুশো বছর ধরে টানা ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষকে শাসন করার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত হল দেশভাগের। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রশাসন চারটি দেশের বিভাজন ঘটিয়েছে- ভারত, আয়ারল্যান্ড, পালেস্টাইন আর সাইফাস। এদের মধ্যে সর্ববৃহৎ বিভাজন ঘটেছে ভারতে ১৯৪৭ সালে। ভারতের পূর্ব পশ্চিম প্রান্তকে জাতিগত বিভিন্ন তার ভিত্তিতে কেটে টুকরো করে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের। বিভাজিত পাঞ্জাবের পশ্চিম অংশ পাকিস্তানের যুক্ত হয়েছিল এবং পূর্ব পাঞ্জাব ভারতেরই অংশ ছিল। অপর দিকে বঙ্গদেশ ভেঙ্গে হয়েছিল পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ। প্রকৃত অর্থে দেশভাগ যতটা না ছিল ধর্ম ও তার আদর্শের রূপরেখায়, তার চেয়ে বেশি ছিল কিছু মানুষের ক্ষমতা লোলুপ ও রাজনৈতিক স্বার্থের আশা-আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশের প্রতিচ্ছবি। দেশভাগের যন্ত্রণার কাতরতায়, স্বাধীনতার সুখ এনে দেয়নি। অনেকেরই এই স্বাধীনতা আন্দোলনের  মানসিকতা ছিল না। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ মৌলানা আবুল কালামের India Wings Freedom' গ্রন্থের (১৯৫৭) অপ্রকাশিত ত্রিশ পাতা প্রকাশিত হয়। মৌলানা ও এই স্বাধীনতা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। বীর সাভারকরের মত জাতীয়তাবাদীরাও খুশি ছিলেন না, তারা চেয়েছিলেন এক অখন্ড ভারতবর্ষ। আর.এস.এস ও হিন্দু মহাসভার মত রাষ্ট্রবাদী সংগঠন ভারতের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠানের প্রচার করেন। কিছুদিনের মধ্যেই এই নকশার জনক রাজনীতির মুখোশ আলাদা হয়ে সরে যায় ও চোখের ঠুলি খসে পড়ে যায়। কারণ স্বরূপ তাদের সামনে প্রকট হয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে হিংসাত্মক সম্প্রদায়িক অত্যাচার ও হত্যালীলা। যেখানে অত্যাচারের সংখ্যাটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ছিল। প্রায় এক মিলিয়ন ছিল নিহত মানুষের সংখ্যাও ধর্ষিত হয়েছিল প্রায় ৭৫ হাজার। দুই দেশের প্রান্ত থেকে ট্রেন ভর্তির মৃতদেহ আদান-প্রদান হতে থাকে শরণার্থী শিবিরের দুরবস্থায় স্বাধীনতার আনন্দ  তিক্ততায় ম্লান হয়ে যায়।  মানুষের মননের ইচ্ছা ও তার বহিঃপ্রকাশ এবং সামাজিক চালচিত্রের গতিপ্রবাহ স্থান পায় ইতিহাসে অগণিত মানুষের সাথে দেশ ছাড়তে হয়, দুই পাড়ের বহুবিশিষ্ট ব্যক্তিদের। দেশভাগের হাত ধরে এনেছে দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, কলোনি সংস্কৃতি আর আমাদের দেশের স্বাধীনতা। যা দেশের ভূগোলটাকে পাল্টে দিল। তছনছ হয়ে গেল আমাদের আর্থসামাজিক জীবন-সাংস্কৃতিক বোধ  বিশ্বাস। এই সমস্ত সমস্যার মধ্যে জাতিগত প্রবল বিদ্বেষের কারণে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার ফলে প্রাণ প্রাণের নিরাপত্তাও বাসভূমি হারানো অসংখ্য অসহায় মানুষদের কষ্ট প্রধানতম দেশ ভাগের মূল পরিণতি বা পর্যায়।

দেশভাগের ফলে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি  রাষ্ট্র বহুভাবে দুর্বল ও বিপন্ন হয়েছে, সম্মুখীন হয়েছে জটিলতা অসুবিধার। কিন্তু সম্ভবত সর্বাধিক বিপন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল পাঞ্জাবে ও বাংলায়, যে দুটি প্রদেশের মধ্যে দিয়ে টানা হয়েছিল বিচ্ছেদ রেখা। প্রকৃত পক্ষে দেশভাগ যতটা না ছিল ধর্ম ও তার আদর্শের রূপরেখায় তার চেয়ে অধিক ছিল কিছু মানুষের ক্ষমতা লোলুপ ও রাজনৈতিক স্বার্থের আশা আকাঙ্ক্ষার বহি:প্রকাশের প্রতিচ্ছবি। দুই দেশের অগণিত জনগোষ্ঠীকে তার বাস্তব ভিটে ছেড়ে আসতে বাধ্য করা হয়। গবেষক স্যনন্ডেল ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানে বসবাসকারী যথাক্রমে মুসলিম ও হিন্দুদের ‘proxy citizen' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলায় ৫৪ শতাংশ ও পাঞ্জাবের ৫৭ শতাংশ জনগণ মুসলিম ছিল। সরকারি সূত্রে হিন্দু ও মুসলিম জনগণের অদল বদল হয়েছিল। এই সূত্রে আরো বলা হয়েছে অনেকে ভারতীয় অপেক্ষা করতে চেয়েছিল কিন্তু নিয়মিত বলপূর্বক' তাদের দেশ ত্যাগ বাধ্য করা হয়েছিল। এই সময় বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে কলকাতায় দাঙ্গা ও সম্প্রদায়িক টানাপোড়েন পশ্চিমবঙ্গের বহু মুসলিম পরিবারকে ভিটেছাড়া করেছিল দেশত্যাগ করতে। সেই সময় কিরণ শংকর বলেন:
"বেশিরভাগ মুসলমানই হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করতে চায়, কিন্তু গুন্ডারা হামলা চালাচ্ছে, কোন কোন পত্রিকায় তা-তে মদত ও দেওয়া হচ্ছে।"
হিন্দুদের পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসার এক প্রধান কারণ ছিল- পাঞ্জাবি পুলিশ, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড আর গুন্ডাদের হামলার হুমকি। কলকাতার প্রবাসী পত্রিকায় তা নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছিল-
"পূর্ববঙ্গ হইতে যাহারা অগ্রপ্রশ্চাত  বিবেচনা না করিয়া আসিতে আরম্ভ করিয়াছেন তাহাদের পিছনে হিন্দু মহাসভার কোন কোন নেতার উসকানি রহিয়াছে ইহা ক্রমশ প্রকাশ হইয়া পড়িতেছে।"
মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব, মুসলমানদের ঔদত্ত, অর্থনৈতিক সংকট সব মিলিয়ে এক ধরনের 'মানসিক পীড়ন' এর চাপে দেশ ছাড়ছিলেন হিন্দুরা। কলকাতা এবং শহরতলিতে মুসলমানদের ওপর এই সময় একতরফাভাবেই আক্রমণ চালানো হতে থাকে। কলকাতা এবং শহরতলিতে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের এই ঘটনার সংবাদ পূর্ববঙ্গে নিয়ে পৌঁছালে সেখানে বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের উপর উৎপীড়ন শুরু হয় এবং তারা দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হন। মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ চলে আসেন কলকাতায়। অন্যদিকে কলকাতা এবং পশ্চিমবাংলায় গ্রামাঞ্চল থেকেও মুসলমানরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পূর্ববঙ্গে চলে যেতে শুরু করেন। উদ্বাস্তু স্রোত এই সময় থেকে দুই দিকেই বইতে শুরু করে। জানা যায় যে ১৯৪৭-র ডিসেম্বরেই  ভারত পাকিস্তানের যৌত প্রয়াসে  অপহরিতা নারীদের পুনরুদ্ধারের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগের ফলে দু বছরের মধ্যেই বারো হাজার(১২০০০) নারীকে ভারতে এবং ছয় হাজার (৬০০০) জনকে পাকিস্তানে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। নিঃসন্দেহে সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু অপহৃত নারীদের কাছে এটা অনেক সময় হয়ে উঠেছিল এক ধরনের উৎপীড়ন।  পুনরুদ্ধারের নামে তাদের যখন ছিন্ন করা হচ্ছিল তাদের নতুন গড়ে ওঠা পরিবার থেকে, দাম্পত্য জীবন থেকে, সেই নারীদের অনেকের কাছেই সেটা ছিল আরেক দফা অত্যাচার।  তারা অনেকেই আর স্বদেশে ফিরে যেতে চায়নি, ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে বলেছিলেন-
"কেন তোমরা আমাদের ঘর ভেঙ্গে দিচ্ছ, কি হবে আর পুরনো কথা মনে করে?... তোমরা বলছ এই বিয়ে অনৈতিক; দেশে নিয়ে গিয়ে আমাদের যে আবার বিয়ে দেবে, সেটা অনৈতিক নয়।"

পঞ্চাশের দশক থেকে কলকাতার মুসলিম মহল্লাগুলি ধীরে ধীরে নিঝুম হয়ে উঠেছিল। এলাকার চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী তাদের পূর্বপুরুষের বসত গুটিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। বদলি নিয়ে নিশ্চুপে সীমান্ত এলাকা পেরিয়ে গিয়েছিলেন বহু সরকারি কর্মী। দেশ ছেড়েছিলেন মুসলিম আর্দালি, পিওন, চাপরাশিরা। রাতারাতি বদলি নিয়ে উচ্চপদস্থ মুসলিমদের দেশত্যাগের ফলে বিভিন্ন সরকারি পদে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল তা সামলে দেওয়া গেলেও নিচুতলার কর্মীরা চলে যাওয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আইন দফতর এ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তবে গ্রামীণ মুসলিমদের দেশত্যাগের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল দেশবিভাজনের অন্তত বছর চারেক পরে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে গ্রামীণ মুসলিমরা দেশত্যাগ করতে কেন কাল বিলম্ব করেছিলেন? পূর্ববঙ্গের পরিবেশের সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না। চেনাজানার পরিধিও ছিল ছোটো। তাই অচেনা দেশে কে তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে তা নিয়ে গভীর সংশয় ছিল নিম্ন ও মাঝারি আয়ের চাষী ও বিভিন্ন কলকারখানার মুসলিম শ্রমিকশ্রেণির। কিন্তু একের পর এক দাঙ্গার আঁচে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকায় মনোবলও একসময় ধাক্কা খেয়েছিল। গ্রামীণ মুসলিমদের গড়িমসির আরেকটি কারণ হল জীবন যাপনের অন্যতম ক্ষেত্র মুসলিম প্রধান গ্রামগুলিতে যেতে হবে তাদের। প্রথম থেকেই মুসলিম প্রধান মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম, হুগলি, ২৪ পরগণার মুসলিম মহল্লাগুলি ছিল নির্দিষ্ট এলাকায় এবং সংঘবদ্ধভাবে হিন্দু বসত থেকে একটু দুরত্ব রেখে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে সেই গ্রামগুলি গড়ে তোলা হয়েছিল। তাই গঠনের মধ্যেই ছিল 'একাত্ম হয়ে থাকার লক্ষণ-যা তাদের বাড়তি 'মনোবল' জোগাত বলে মনে করেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ওয়াহেদ আলম। এই একাত্মবোধই দাঙ্গাপ্রতিরোধ করে; ভিটে আগলে পড়ে থাকার মনোবল জুগিয়েছিল এদেশীয় মুসলিমদের। বিভাজনের পরে ক্রমাগত অস্থিরতা সত্ত্বেও তাই দেশত্যাগের কথা প্রাথমিকভাবে ভাবতেই পারেনি তারা।

দেশভাগের ফলে ভারত, পশ্চিমপাকিস্তান ও পূর্বপাকিস্তানের স্থানীয় মানুষের কাছে এক নতুন মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল যেন তারা মানুষ নয়। যে নামেই তারা পরিচিতি পাক না কেন এদের সবার ভাগ্যে উপেক্ষা, অবহেলা, অনাদর ছাড়া যেন আর কোনও প্রাপ্তি থাকার কথাই ছিল না। তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা পূর্বপাকিস্তানে গিয়েছিল তারা ততটা উপেক্ষা, অবহেলা বা অনটনের শিকার হয়নি। পূর্বপাঞ্জাব থেকে যারা পশ্চিমপাকিস্তানে গিয়েছিল তাদের ভাগ্যেও খুব বেশি দুর্দশা জোটেনি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরাও সাময়িক দুর্দশা কাটিয়ে সরকারি সহায়তায় আবার মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার অর্জন করেছিল। কিন্তু ব্যক্তিক্রম ঘটে শুধু পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা লোকবিনিময়ের ফলে এবং ভারত সরকারের উদ্বাস্ত পুনর্বাসন দপ্তরের পরিপূর্ণ সহায়তার দৌলতে যথেষ্ট লাভবান হয়েছিল। ওরা ভারতের অন্তর্গত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে পুনর্বাসনের সহায়তা পেয়ে পুনরায় মাথা উঁচু করে বাঁচার সুযোগ পেয়েছিল। -
দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্বাস্তুরা ছড়িয়ে পড়েছিল। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেশভাগের সমকালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে উদ্বাস্তু আগমনের চিত্রটি দেখে নেওয়া যেতে পারে।
পাঞ্জাব: ৩২,৩১,৯৮১ জন
পশ্চিমবঙ্গ: ২০,৯৯,০৭১
উত্তরপ্রদেশে: ৮,৮০,২৭০
বোম্বাই প্রদেশ: ৩,৩৮,০৯৬
আসাম: ২,৯৮,৮০০
মধ্যপ্রদেশ: ১,১২,৭৭১ "
বিহার: ৭৭,৫৫২
ওড়িশা: ২০'০৩৯
মাদ্রাজ: ৮,৯২৯
এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, দেশভাগ-সমকালে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে অনেক বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তু আগমন ঘটেছিল। কিন্তু বাস্তবে উদ্বাস্তু আগমনের চাপ পাঞ্জাব অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি ছিল। এর কারণগুলি  হলো
প্রথমত: পাঞ্জাবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ আয়তনে অনেক ছোট প্রদেশ।
দ্বিতীয়ত: লোক বিনিময়ের ফলে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের উদ্বাস্তুরা লাভবান হয়েছিল। দেশভাগের ফলে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে যে সংখ্যায় উদ্বাস্ত পূর্বপাঞ্জাবে এসেছিল, তার থেকে অনেক বেশি মানুষ পূর্বপাঞ্জাব থেকে পশ্চিমপাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। ফলে তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি, বাড়িঘর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল।
তৃতীয়ত: পশ্চিমপাকিস্তান থেকে শুধু দেশভাগের সমকালেই উদ্বাস্তু আগমন ঘটেছিল।
কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত অনবরত পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা পশ্চিমবঙ্গে আসতে থাকে। এরা পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষ (missing man)। পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) থেকে এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলি সংলগ্ন আসাম ও ত্রিপুরা অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গেই বেশি আশ্রয় নিয়েছে। একটি পরিসংখ্যান মোতাবেক :
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পূর্ববাংলার ৭০ হাজার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় পেয়েছিল। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আশ্রয় শিবিরে ছিল ৭৯৮০১ জন উদ্বাস্তু। ১৯৫৭ খ্রি: মধ্যে এপারে আসে ১,২৭,০০০ মানুষ। ৩৬,০০০ জন ছিল আশ্রয় শিবিরে, ১৯৫০ খ্রি: থেকে আগত পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের অবিরাম প্রবাহ ও উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ঔদাসীন্য ডেকে আনে সংকট।
পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের এই অনবরত চাপে স্থানীয় সরকার যেমন অসহায় বোধ করেছিল, কেন্দ্রীয় সরকারও ছিল তেমনি উদাসীন।

দেশভাগের সমকালে মূলত প্রভাব প্রতিপত্তিশালী হিন্দুরাই দেশত্যাগ করেছিল। নিচু তলার হিন্দুরা দেশত্যাগের ব্যাপারে ততটা উৎসাহী ছিল না কারণ আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানে তারা পূর্ববঙ্গের সিংহভাগ মুসলিম জনগণের সমকক্ষ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে হিন্দুদের ক্রমাগত দেশত্যাগের ফলে নিচুতলার হিন্দুরা ক্রমে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয় এবং এই হিন্দুদের উপর ক্রমাগত ভয় দেখানো হতে থাকে। ফলে এরাও আর পূর্ববঙ্গের নিজেদের নিরাপদ মনে করেনি। ক্রমাগত ভয় দেখানোয়, নারীর সম্মানহানির কিছু ঘটনায় এই নিচুতলার মানুষগুলি শেষপর্যন্ত এপার বাংলায় পারি জমায়। এরা বেশিরভাগ ভূমিহীন, জনমজুর, তাঁতি, কুমোর, কামার আর ছুতোরের দল। পশ্চিমবঙ্গে এদের স্থান হয়েছিল প্লাটফর্মে, ভাঙা মন্দিরে, মিলিটারিদের পরিত্যক্ত ছাউনিতে, কখনও বা মনুষ্যবসতিহীন দুর্গম অঞ্চলে। এরা দখল করে বসল রেলের জমি, শহরের ফুটপাত, গড়ে তুলল হাজার হাজার কলোনি। এই বিশাল জনসংখ্যার চাপে শহর শহরতলির চরিত্র বদলে যায়, গ্রামাঞ্চলের জনবিন্যাস পরিবর্তিত হয়। উপেক্ষা, অবহেলা, অনাদরের শিকার হয়েও এই মানুষগুলিই শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ণায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কেউ এদের সাদরে গ্রহণ করেনি কিন্তু তবু এইসব মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি তথা আর্থসামাজিক পরিকাঠামো এবং জনবিন্যাসের ভারসাম্যকে আমূল বদলে দিয়েছে।

উদ্বাস্তু শ্রেণি-সমস্যা স্বাধীনতোত্তর ভারতের এক উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসাবে পরিগণিত। সরকারি দিক থেকে যদিও রিলিফ ক্যাম্পগুলিকে বাঙালি উদ্বাস্তু মহিলাদের আশ্রয়স্থল বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু All India Woman's Conference-এর রিপোর্ট থেকে উঠে আসে উদ্বাস্তু মহিলাদের বাস্তবিক অবস্থা, কেমন ছিল তার ছবি। কিছু সংগঠন যেমন- নারী সেবা সংঘ, উদয় ভিলা, আনন্দ আশ্রম উইমেন্স কো-অপারেটিভ হোম, অল বেঙ্গল উইমেন্স ইউনিয়ন ইত্যাদি। সমকালীন সংগঠনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, অপহৃত ও ধর্ষিতা মহিলারা এই সময় সবচেয়ে বেশি জটিলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। দেশভাগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন তাই বাঙালি মহিলাদের ভাবমূর্তি পরিবর্তিত করেছিল। রিফিউজি ক্যাম্পে জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার জন্য পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে মহিলারাও জীবিকার অন্বেষণে চার দেওয়ালের চৌহদ্দির বাইরে পা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময়ের অস্থির এবং জটিল পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছিল বিভিন্ন ধরনের পেশা খুঁজে নিতে। কেউ শহরের বাবুদের বাড়িতে কাজের লোক বা রাঁধুনি হিসাবে, কেউ বা রঙের মিস্তিরির জোগাড়ের কাজ ধরেছিল। আবার কেউ ছোটখাটো কারখানায় শ্রমিক হিসাবে ঢুকে গেল। কেউ কেউ পরিস্থিতির চাপে নিজের দেহ বেচে সংসারের হাল ধরে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। সত্তর বাহাত্তর বছর আগের এই কলঙ্কিত অধ্যায়কে তাদের বর্তমান প্রজন্ম আড়াল করে রাখতেই বিশেষ তৎপর। বিশেষত, যে সকল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়েছিলেন।
দেশভাগের উদ্বাস্তু সমস্যা নারী হরণ নারী নির্যাতন প্রায় সব দিকে লক্ষ্য করা যায়। শত্রুকে অপমান করতে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ভেঙ্গে ফেলতে দুর্বৃত্ত শত্রুরা হানা দেয় শত্রু শিবিরে, মেয়েদের উপর দেশভাগের সময়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি, পশ্চিমে দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে পাঞ্জাবের পঞ্চনদ যখন রক্তে ভেসে গিয়েছিল অনেক মেয়েরা তার মধ্যেই ডুবে গিয়েছিল আর কিছু মেয়ে অন্য পাড়ে সাঁতারে এসে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ যে ছিন্নমূল্য উদ্বাস্তুদের জন্য স্বর্গরাজ্য ছিল তা নয়। উদ্বাস্তু শিবির, শিয়ালদহ স্টেশন, জবরদমন সর্বত্র দেখা যায় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। মেয়েরা যার পুরোভাগে ছিল। অনেক অধঃপতনের পিছল পথে নেমে আসে। কেউ বা না নামতে গিয়েও জীবনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। উদ্বাস্ত পরিবারের মেয়েরা আগে ভদ্র মেয়েদের উপযুক্ত মনে করা হত না। মেয়েরা পরিবারেরও সম্প্রদায়ের মান মর্যাদা ধরে রাখে গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই এই ধারণা বদ্ধমূলক। ফলে দাঙ্গার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি মেয়েদের উপর এসে পড়ে। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত হিন্দু মুসলমানের সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়, ফলে দেশ বিভাগের আগে পড়ে ধর্ষণ হত্যা লুণ্টন কিছু কম হয়নি। ক্ষমতাবানরা মেয়েদের অপহরণ করেছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করেছে জোর করে বিবাহ করেছে যৌন দাসত্ব বাধ্য করেছে বলতো দেশবাগ নারী নির্যাতন নারী ধর্ষনের সাথে সাথে উদ্বাস্ত  সমস্যায় জর্জরিত হন মেয়েরা।

১৯০ বছর শাসন এর পর ইংরেজরা আমাদের স্বাধীনতা দিল আর উপহার হিসেবে দিয়ে গিয়েছে দেশভাগ। ভারত ভেঙ্গে তৈরি হলো নতুন রাষ্ট্র। দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। একই জলবায়ুতে লালিত পালিত হিন্দু মুসলমান তাই তখন রক্তক্ষয়ী যুক্তে লিপ্ত। বিশেষ সম্পত্তি নারীর সম্মান সবই লুন্ঠিত । হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হয়। দেশভাগ হলো আর সব সমস্যা সমাধান হল তা নয়। সমস্যা তখন আরো জটিল আরও কঠিন শুধু প্রাচ্য নয় মধ্যপ্রাচ্য হোক বা প্রাশ্চাত্য সব ক্ষেত্রে সমস্যা সমান। দেশভাগের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো উদ্বাস্তু সমস্যা, শিক্ষা বা শিল্প ভাবনা এখানে আসে না। সৃষ্টি হয় না নতুন কোন সাহিত্য। জীবনের উন্নতি তখন স্তব্ধ। সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রকে স্পর্শ করে এই উদ্বাস্তু সমস্যা। তৈরি হয় বিপুল সংখ্যায় বেকার সমস্যা, তার সঙ্গে তৈরি হয় খাদ্য সংকট। অতীতের একান্নবর্তী পরিবারে গুলো ভেঙ্গে এখন অনেক টুকরো হয়েছে তাতে কিন্তু সুখ আসেনি, এসেছে অবসাদ আর একাকীত্ব বেড়েছে হিংসা। পরিবার ভাগ বা দেশভাগ কোন ভাগে জীবনে সুখ আসে না। দেশভাগের ফলে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা গুলো সেগুলো সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি আজ ও বাঙ্গালীরা নানাভাবে নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে চলেছে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পটিপ্রেক্ষিতে দেশভাগ হয় জনগণ ও তার লাভ উপলব্ধি করতে পারেননি। দেশভাগের সমস্যা আরো জটিল ও কঠিন দেশের কঠিন দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রকে উদ্বাস্তু সমস্যার স্পষ্ট করে গেছে। সুতরাং দেশব্যাক শুধুমাত্র আলোচনার বিষয় নয় এটি আমাদের সবাইকে এক ভাবনার জগতে ত্বরান্বিত করেছে।

তথ্যসূত্র
১.দেশভাগ দেশত্যাগ, বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দীপ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৪, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ২০০৭, দ্বিতীয় সংস্করণ: জানুয়ারি, ২০১০ পরিমার্জিত পুনর্মুদ্রণ: জানুয়ারি, ২০১৬, পৃষ্ঠা:৬৭
২. তদেব, পৃষ্ঠা:৭৩
৩.পৃষ্ঠা:৯৭
৪.বাংলায় গন আন্দোলনের ছয়  দশক, চৌধুরী কমল, পত্র ভারতি,এপ্রিল ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা; ৮৯

গ্রন্থপঞ্জি
১.দেশভাগ দেশত্যাগ, বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দীপ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৪, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ২০০৭, দ্বিতীয় সংস্করণ: জানুয়ারি, ২০১০ পরিমার্জিত পুনর্মুদ্রণ: জানুয়ারি, ২০১৬
২.দেশভাগ বিপন্ন প্রান্তিক-নারী, কাঞ্জিলাল মৈত্র জয়তী, প্রথম প্রকাশ:জুন ২০২১, সম্পাদনা-সত্ব সম্পাদকের, প্রকাশক:অণিমা বিশ্বাস
"মাটির বাড়ি", তার পার্ক, খোলাবাজার, কলকাতা ৭০০ 132
৩.দেশভাগ-দেশত্যাগ, প্রসঙ্গ উত্তর-পূর্ব ভারত বর্মন প্রসূন, প্রকাশকাল:বৈশাখ ১৪২০ মে ২০১০, ভিকি পাবলিশার্স, সরস্বতী অ্যাপার্টমেন্ট, ভাঙাগড়, গুয়াহাটির পক্ষে সৌমেন ভারতীয়া কর্তৃক প্রকাশিত এবং ভবানী অফসেট প্রাইভেট লিমিটেড, ভবানী কমপ্লেক্স হাতাশিলা, পানীখাইতি, গুয়াহাটি-৭৮১০২৬ থেকে মুদ্রিত।
৪.দেশভাগ স্মৃতি স্তব্ধতা, ঘোষ সেমন্তী, প্রথম প্রকাশ:১ মার্চ ২০০৮, প্রকাশক:অণিমা বিশ্বাস, গাঙচিল মাটির বাড়ি, ডঙ্কার পার্ক, ঘোলা বাজার, কলকাতা ৭০০ ১১১
৫.আগুনপাখি, আজিজুল হাসান হক, দে'জ পাবলিশিং,কলকাতা ২০০৮
প্রবন্ধ: সুপ্রিতা নাথ
(প্রকাশিত: ২৩.০৯.২০২৩)
5.0 / 5
1 review
1
0
0
0
0
Rudra
30 Jan 2024
Helped alot
https://visitorshitcounter.com/

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content