নারীবাদ ও বাংলা সাহিত্য
সামাজিক দৃষ্টিপাতের নিরিখে নারীর ধর্ম-বর্ণ পরিপ্রেক্ষিত বাংলা উপন্যাস
নারীবাদ কী
নারীবাদ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Feminism। Feminism শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ Femminisme থেকে। Femme অর্থ নারী Isme অর্থ মতবাদ। উনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে ফরাসি সমাজতান্তী চার্লস ফুরিয়ার (Charles Fourier) সর্বপ্রথম ‘Feminism’ শব্দটি আবিস্কার করেন। ১৮৮০ এর দশকে ফ্রান্সে শব্দটি গৃহীত হয় পরে ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয়।
“কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না ;বরং হয়ে ওঠে নারী”__ নারী সম্পর্কিত বহুল আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় এই মন্তব্যটি করেন খ্যাতনামা ফরাসি ‘দার্শনিক’, ‘প্রাবন্ধিক’, ‘ঔপন্যাসিক’_সিমোন দ্য বোভোয়ার। একজন মানুষ হিসেবে নারী তার পরিপূর্ণ অধিকারের দাবী হলো নারীবাদ। নারী স্বাধীনতা আলোচনা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নারীবাদ । বিশ্বজুড়ে যে বিদ্যমান লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাগ পুরুষের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দায়িত্ব অর্পণ করে এবং নারীকে গোটা সংসারের বোঝা বহনকারী এবং নানা পীড়নের মধ্যে ঠেলে দেয় তাকে চ্যালেঞ্জ করে নারীবাদ। নারীবাদ বিরাজমান ক্ষমতা কাঠামো আইন-কানুন রীতি-নীতি যা নারীকে অধীনস্থ ও হীন করে রাখে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নারীবাদ। নারীবাদ হল একটি সামাজিক আন্দোলন, যা নারীর ইমেজ এর পরিবর্তন, লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপ এবং পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকার অর্জনের প্রয়াসী। নারীর স্বাধীনতা অর্থবহ করার লক্ষ্যে যে আন্দোলন যুক্তি ও তত্ত্ব বিভিন্ন চিন্তাবিদগণ প্রদান করেছেন তাকে সাধারণভাবে নারীবাদ আখ্যা দেয়া যায়। নারীবাদ নারীর সামগ্রিক কল্যাণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। নারীবাদ ও নারী স্বাধীনতা অভিন্ন নয়। নারীবাদী গবেষকদের মধ্যে মত ও পথের ভিন্নতা রয়েছে কিন্তু প্রত্যেক গবেষক নারীর কল্যাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মতবাদ দিলেও তাদের উদ্দেশ্য হলো নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করণ।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব:
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব হঠাৎ একদিনে সৃষ্টি হয়নি অনেকদিন ধরেই এর চর্চা শুরু হয়েছে। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনায় যে ব্যাপারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নারী নামক যে শ্রেণি তাদের নিজস্ব কিছু শারীরিক গঠন ও অস্তিত্বের প্রকাশ তারা করতে চায় নিজেদের বয়ান অনুযায়ী, নিজেদের কন্ঠস্বর ও নিজেদের ভাবনা অনুযায়ী, নিজেদের পরিবেশ পরিস্থিতি দেশকালের প্রেক্ষাপটে। যখন এই সমস্ত প্রেক্ষাপটে কোন স্বর উপস্থাপিত হয়, এই ধরনের শ্রেণি কেন্দ্রিক যে বয়ান তাকে নারীবাদ বলে। নারীর যে বয়ান তাকে যারা সমালোচনা করে, তা হলো নারীবাদ সমালোচনা। এই সমালোচনার মধ্য দিয়ে যে সমস্ত সর্বজনস্বীকৃত গুণগুলিকে গ্রহণ করা হয় তাই হলো নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ গত আড়াই দশকের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নারীবাদীরা যেমন আক্রমণ করেছেন ও বলে দিতে চেয়েছেন পিতৃতান্ত্রিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো, তেমনই আক্রমণ করেছেন ও বদলে দিতে চেয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চিন্তাধারা। কয়েক হাজার বছরের বিশ্বসাহিত্যে পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব সৃষ্টি করেছে সাহিত্য ও তার তত্ত্ব করেছে মূল্যায়ন। কিন্তু নারীরা পুরুষের সৃষ্টিশীলতা মূল্যায়নকে মানেনি এবং পুরুষের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা রীতিকে সংশোধন করার জন্য নিজেদের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার লক্ষ্য সব সময়ই রাজনীতিক এবং পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি বের করেছে। নারীবাদী সমালোচনার একটি ধারা দেখা যায় মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট “ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান”, সেখানে তিরষ্কার করেন ও পুরুষতন্ত্রের নানা মহাপুরুষকে।
নারীবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ:
পাশ্চাত্য নারীর মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ফরাসি রাজসভার নারী সদস্য chiristim de pizan ১৪০৫ সালে। তিনি THE BOOK OF THE CITY OF LADIES নামক গ্রন্থ রচনা করেন পশ্চিম ইংল্যান্ডের নারীমুক্তির লড়াই একটি সংগঠিত রূপ নেয় সাম্রাজের ক্রান্দালনের মাধ্যমে। নারীবাদকে প্রথম সংঘটিত আকারে উপস্থাপিত করেন ইংল্যান্ডের মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সে সিম ব্যবহার রচনা করেন THE SECOND SEX নামক গ্রন্থ । ১৯৬১ সালে কেট মিলেট SEXUAL POLITICS নামে সারা জাগানো গ্রন্থ রচনা করেন। এর বহু পূর্বে ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ডের নারীর অধিকারের পক্ষে প্রথম পুরুষ দার্শনিক উইলিয়াম কমসনের বই THE HALF PORTION OF MANKIND WOMEN’S APPEAL TO THE REST PORTION GAINST MALE CHAUVINISM প্রকাশিত হয়। আধুনিক নারীবাদ এর মধ্যে ভার্জিনিয়া উলফ এর সাহিত্যকর্ম, ১৯৬৬ সালে বেটি ফ্রাইডান রচিত THE FAMININE MYSTIC, ১৯৭০ সালে কোলনতাই রচিত SEXUAL RELATIONS AND CLASS STRUGGLE, কোটি বোইফে’র BEAUTY MYTH ও FIRE WITH FIRE প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থ নারীবাদ এর জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে ।
রাজা রামমোহন রায় ১৮১৮ সালে কলকাতায় সতীদাহ প্রথা বিলোপ এর উদ্যোগ নেন । যার ফলে ১৮২১ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র নারী শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেরীককের সঙ্গে মিলে মোট ৪৩ বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বাংলার প্রধান নারীবাদী রূপে খ্যাত সরলা দেবী ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় নারী সংগঠন ভারতস্ত্রী মহামন্ডল প্রতিষ্ঠা করেন, আর বেগম রোকিয়া আধুনিক অর্থে বাংলার প্রকৃত নারীবাদী নারী। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে তাই রোকিয়া সাখাওয়াত সরলা দেবী এবং পন্ডিত রমাবাই হলেন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নারীবাদী চিন্তার জনক।
নারীবাদ এর বিভিন্ন তত্ত্ব:
উদারনৈতিক নারীবাদ:
মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ,জন স্টুয়ার্ট মিল, হ্যারিয়েফ টাইলর উদারনৈতিক নারীবাদ এর প্রবক্তা। Betty Friedman মূলত রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমর্থক ছিলেন। বিদ্যমান সমাজ কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করা হলো এর মূল বৈশিষ্ট্। এরা মূলত সংস্কারে বিশ্বাসী। তারা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আইন কানুন বিধিব্যবস্থা, সংস্কার সংশোধন করে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও অসমতা দূর করা সম্ভব।
মার্কসীয় নারীবাদ (Marxixt Feminism):
কাল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মার্কসবাদী মতাদর্শ হলো এই নারীবাদ এর ভিত্তি। লেনিন অগাস্ট, বেবেল, ক্লারা জেটকিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই, প্রমুখ এই মার্কসীয় নারীবাদ এর ভিত্তি নির্মাণ করেন। এরা শ্রেণিবৈষম্য নারী নির্যাতনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ক্যাপিটালিজমের উচ্ছেদ করে শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নারী মুক্তি সম্ভব বলে মনে করেন। এদের কাছে নারী মুক্তি আন্দোলন পুরুষের বিরুদ্ধে নয় পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে।
রেডিক্যাল ফেমিনিজম (Radical Feminist):
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এই নারীবাদ এর উদ্ভব ঘটে। পাশ্চাত্যে shula mittle fierstone এই ধারার জনক। kate millet, Marilyn Franch এই মতবাদের প্রবক্তা। এই নারীবাদ এর মূলকথা হলো পুরুষ নারীকে শোষণ করে sexual 0peression এর মাধ্যমে এরা নারী-পুরুষের বিচ্ছেদে বিশ্বাসী, পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি ও পুরুষের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক অস্বীকার করে নারীর স্বতন্ত্র অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীদার ।এখানে পুরুষকে প্রতিপক্ষ রূপে চিহ্নিত করে প্রচলিত বৈবাহিক সম্পর্ককে অস্বীকার করা হয়। তারা বিশ্বাস করে পিতৃতন্ত্র ও তার অনুযায়ী সমাজব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত করে নারী ও পুরুষের সমতা আনা সম্ভব এই ধারাকে অনেকে উগ্র নারীবাদ আলট্রা লেফট ফেমিনিজম বলে চিহ্নিত করে থাকে।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ:
রেডিক্যাল এবং মার্কসীয় নারীবাদ এর মিলিত রূপ হল সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ এরা মনে করে যে গণতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের জটিল মিথস্ক্রিয়া নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ এবং গণতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের বিলোপ সাধন করে নারী মুক্তি সম্ভব নয় এরা বিশ্বাস করে যে নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা এই সমাজের সমতা অর্জন নিশ্চিত হতে পারে এই নারীবাদকে অনেকেই সোশ্যাল ফেমিনিজম রূপে অভিহিত করে থাকে।
সাংস্কৃতিক নারীবাদ(Social Femminisme):
কিছুটা গার্ডিকেল ফেমিনিজম এবং কিছুটা সোশালিস্ট ফেমিনিসম এর মিলিত রূপ কালচারাল ফ্যাসিজম মনে করে যে জেন্ডার সম্পর্কিত সামাজিক ও ঐতিহাসিক ভাবে সৃষ্ট এবং তা পরিবর্তনের যোগ্য নারী-পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য গত বাস্তবতা নয় এই নারীবাদ কখনো মাতৃত্বকে অবমূল্যায়ন এবং নারীসুলভ গুণাবলিকে ধ্বংস করার পক্ষপাতি নই অবশ্য এরা ও পুরুষকে তাদের শত্রুরূপে বিবেচনা করে।।
পরিবেশ নারীবাদ (Cultural Femminisme):
নারী ও প্রকৃতির ওপর সমান্তরালভাবে বিদ্যমান পুরুষ প্রাধান্যের অবসান দাবি করে এই নারীবাদ। ভারতের বন্দনা, শিবা মারিয়ামিজ, প্রমুখ এই পরিবেশ নারীবাদ এর অন্যতম প্রবক্তা। পরিবেশ নারীবাদ নারী ও পরিবেশকে অভিন্ন মাত্রায় সংযোজন করে ।এর মূল বক্তব্য হলো নারী ও প্রকৃত উভয়ই পিতৃতন্ত্রের নির্মম শিকার।
বৈশ্বিক নারীবাদ (Global Femminisme):
এই তত্ত্ব নারীদের অবস্থানকে বৈশ্বিকভাবে দেখার একটা দিক নির্দেশনা প্রদান করে ।লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের কর্মকৌশল এবং সমাজের নারীরা তাদের সমস্যাবলী যথাযথভাবে চিহ্নিত করা ও সমাধানের উপায় খুঁজে বের করাই এই মতবাদের মূল বক্তব্য।
সামাজিক নিচু দৃষ্টিপাত ও তত্ত্বের ভিত্তিতে নারীর ধর্ম বর্ণ পরিপ্রেক্ষিত ও বাংলা উপন্যাস:
সমাজের নারীবাদ এর বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নারীর ধর্ম-বর্ণ বাংলা উপন্যাসে কোথায় কোথায় ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করবো তার আগে সমাজে ধর্ম-বর্ণ ও নারীর অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনাআলোচনা করছি। বাংলা সমার্থক শব্দ হিসেবে নারী শব্দের সমার্থক শব্দ গুলো হলো স্ত্রী, মেয়ে, মেয়েলোক, রমণী, ললনা, অবলা, মানবী, মহিলা, অর্ধাঙ্গিনী, নিতম্বিনী ইত্যাদি। ঐতিহ্য রক্ষার্থে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পূজারি পূর্বের ও বর্তমানে বেশিরভাগ ভাষাবিদ ও অভিধানিকগণ নারী ও পুরুষের মাঝে তুলে দিয়েছে দেয়াল দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ পেয়েছে লৈঙ্গিক রাজনীতি ও সামাজিক বৈষম্যের।
পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নানারকম সংস্থা। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নারীদের সব সময় সরাসরি শাসন করতে পারে না তাই পিতৃতন্ত্র পরিবারে সাহায্যে শাসন করে । এই শাসনের বিশেষ শিকার নারীরা যেসব পিতৃতান্ত্রিক সমাসমাজে নারীদের আইনসঙ্গত নাগরিক অধিকার দেয়া হয়েছে সেখানেও দেখা যায় নারী শাসিত হয় পরিবারের দ্বারাই। পিতৃতন্ত্রের তিনটি সংস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একে অন্যের সাথে জড়িত ও নির্ভরশীল। টিকে থাকার জন্য পিতৃতন্ত্র পরিবারের প্রধান ব্যক্তি কে দিয়েছে সমস্ত কর্তৃত্ব এবং ধর্মীয় বিধানের সাহায্যে বিধিবদ্ধ করেছে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে _____
পিতা রক্ষতি কৌমারে,
যৌবনে রক্ষতি যৌবনে
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রের, স্ত্রী স্বতন্ত্রমহতি
অর্থাৎ কুমারী কালে পিতা, যৌবনে স্বামী ,ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে। নারীকে পিতৃতন্ত্রের আরো নানা সংস্থা বিদ্যালয়, পুরোহিত, প্রচার মাধ্যম এবং কি নয়?প্রতিষ্ঠা করা হয় জীবনের সমস্ত এলাকায় পুরুষ অধিপত্য নারীকে করা হয় অধীন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিন্তু তার কাছে নারী অনেক বেশী স্বপ্নের। দুই বোন উপন্যাসের শুরুতে তিনি মন্তব্য করেন____মেয়েরা দুই জাতের কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি এক জাত প্রধানত মা অপর জাত প্রিয়া। কোন পণ্ডিতের কাছে এটা শোনার দরকার ছিল না। এটা তার নিজেরই কথা। একটি পুরো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি একথা প্রমাণ করার জন্যই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন না নারী মুক্তিতে,যদিও কোনো কোনো পংক্তি নারীবাদের ইস্তাহারের মতো শোনায়। তিনি বিশ্বাসী ছিলেন পুরুষতন্ত্র পুরুষ আধিপত্যে।
ঘরে-বাইরে ও চার অধ্যায় লেখা হয়েছে পৃথক পৃথক এলাকা তথ্য প্রমাণ করার জন্য ঘরে-বাইরে উপন্যাসের পৃথক পৃথক এলাকা তথ্য প্রমাণ করার জন্যই রবীন্দ্রনাথ নিরীক্ষা চালিয়েছেন এবং দেখিয়েছিলেন ঘরের বাইরে গেলে নারীর সর্বনাশ হয়। বিমলার জীবন তখন সার্থক যখন সে স্বামী প্রেমে আর ব্যর্থ যখন সে সারা দেয় বাইরের হাতছানিতে।
চার অধ্যায় এ তত্ত্বের আরেক নিরীক্ষা ও প্রমাণ। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি রবীন্দ্রনাথের চোখে খুবই জঘন্য আর তা চরম জঘন্য হয়ে ওঠে যখন তাতে যোগ দেয় নারী ।নারী সন্ত্রাসে যাবে না তারা যাবে প্রেমে ।আর প্রেমের পবিত্র জায়গা হচ্ছে গৃহ। যেখানে নারী হবে তার স্বামীর খেলার পুতুল ও আমরণ দাসী।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের নারী চরিত্রে দেখা যায় সমাজের বঞ্চনা। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে নারী চরিত্র কুন্দনন্দিনী ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ রোহিণী চরিত্র অঙ্গনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। এই চরিত্রগুলি সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি। নারী শিক্ষাকে মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল এবং বিধবা বিবাহ তো দুঃস্বপ্নের মতো ।বঙ্কিমচন্দ্র নারীদের দেখেছেন আত্মম্ভরী উপহাসের চোখে।
আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি সুবর্ণলতা বকুলকথা ও প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসে নারী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন মধ্যবর্তী মহিলাদের জীবনের ক্ষুদ্র এবং সেই সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণ নিয়ে তার বেশিরভাগ গল্প প্রথম প্রতিশ্রুতি আশাপূর্ণা দেবীর নারী বাদী হয়ে উঠেছেন।লেখিকা বারবার জানিয়েছেন__“শুধু একজন সুবর্ণলতায়ে নয় এমন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সুবর্ণলতা এমনি করে দিনে দিনে তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে, কেউ লড়াই করে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে, কেউ ভীরতায় অথবা সংসারের শান্তির আশায় আপন সত্তাকে বিকিয়ে দিয়ে পুরুষ সমাজের ইচ্ছের পুতুল হয়ে বসে আছে”। পুরুষ শাসনের প্রতি তার ক্রোধ এবং ধিক্কার নিরুউচ্চারিত নয়। সত্যবতীর মাধ্যমে এই সমাজ ব্যবস্থার মূল কাঠামো বিবাহ প্রথা ও নারী পুরুষের সম্পর্ক তিনি অবলীলায় অস্বীকার করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভু রামকালীর কাছেও মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষা ছিল অর্থহীন তাই সত্যবতীর বিদ্যা চর্চার সংবাদ যখন রামকালী পায় তখন তিনি সত্যবতীকে প্রশ্ন করেন-“মেয়ে মানুষের এত বেদ পুরান জানবার দরকারই বা কি?” তখন সকলের কাছে সমীহ ও সম্ভ্রমের পাত্র রামকালীর এত কালের সংস্কার ও মূল্যবোধের উপর তীব্র কষাঘাত করে সত্যবতী বলে “এত যদি দরকারের কথা তো মেয়ে মানুষের জন্মাবারই দরকার কি” এই কথা শুনে রামকালী সত্যবতীকে বিদ্যাশিক্ষা অর্জনের অধিকার দেয়।
ইবসেনের Doll’s House এর নায়িকা নোরার এই কথা ক’টিতে নারী- সমস্যার মূল সত্যটি প্রকাশ পেয়েছে— সর্ব প্রথমে আমি মানুষ, তারপরে পত্নী ও জননী। (পারিবারিক নারী সমস্যা) আশাপূর্ণা দেবী প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসে সত্যবতীকে এঁকেছেন একজন নিষ্ঠাবান পত্নী, নিষ্ঠাবান মা ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে। সত্যবতী তার অসম্পূর্ণ ইচ্ছাকে মেয়ে সুবর্ণলতা মধ্যে সম্পূর্ণ করার স্বপ্ন দেখে কিন্তু শশুরের মৃত্যুর পরে গ্রামে এলে এলোকেশী পরোক্ষভাবে সুবর্ণকে মায়ের সম্পর্কে বৈরীভাব গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। মা যেমন কুকুর সুবর্ণকে তার উপযুক্ত মুগুর করে তোলার চেষ্টা করে এলোকেশী, মায়ের ইচ্ছেকে চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত নষ্ট করে দেওয়ার জন্য। মেয়েকে রক্ষা করার জন্য সত্যবতী একবার ঘুমের ঘোরে অর্ধচেতন অবস্থায় স্বামীকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে_“ষোলো বছর না হলে বিয়ে দেবে না সুবর্ণর” কিন্তু নবকুমার সত্যবতীর কথাকে পাগলের প্রলাপ ভেবেছে_ পাগলের সঙ্গে চাতুরিতে দোষ কি_ সত্য পাগল অতএব পাগলের সাথে ছলনা করলে কোন দোষ নেই। সত্যবতী শুধু নিজের মেয়েই নয় সমাজে কঠোর একপাক্ষিক নিয়ম কাননে আবদ্ধ নারী সমাজের মুক্তির কথা বলে। তাই মায়ের মুখ দিয়ে আমরা শুনতে পাই শুধু সুবর্ণয় নয় এই বাংলাদেশের হাজার হাজার নির্যাতিত নারীর কথা_সুবর্ণ কে মেরে ফেলো না। ওকে বাঁচাতে হবে, হাজার হাজার সুবর্ণ কে বাঁচাতে হবে। নবকুমারের কাছ থেকে আদায় ক’রে নেওয়া সেদিনের প্রতিশ্রুতি যখন মিথ্যা হ’য়ে গেছে, তখনও প্রত্যয়দীপ্ত জীবনবোধের প্রেরণায় সে সৌদামিনীকে বলতে পেরেছে –“সুবর্ণ যদি মানুষ হবার মাল-মশলা নিয়ে জন্মে থাকে ঠাকুরঝি, হবে মানুষ.. নিজের জোরেই হবে।” আমরা দেখতে পাই উনিশ শতকের নবজাগরণের যুগোচক্রের আলোড়ন সত্যবতীর চিন্তা চেতনার মধ্যে।
সত্তরের দশকের পরে নারীবাদী লেখা এবং ধ্যান ধারণা বাংলা সাহিত্যে অনেক বেশি মাথাচাড়া দিয়েছে। তসলিমা নাসরিনের রচনা পুরোটাই নারীবাদী দৃষ্টিকোণ।নির্বাচিত কলাম ও তার অন্যান্য লেখায় সমাজে নারী অবহেলার কৈফিয়ত চেয়েছেন। মল্লিকা সেনগুপ্ত রামায়ণকে নতুন আলোকে উপস্থিত করেছেন। এখানে রামায়ণের মুখ্য চরিত্র রাম নয় সীতা এক মাতৃতান্ত্রিক সাম্য সমাজকে অগ্রাসী আর্য রাষ্ট্র-তন্ত্র কেমন করে পুরুষের কব্জায় নিয়ে এলো তার এই গল্প “সীতায়ণ” ।
স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা উপন্যাসিক তার উপন্যাস “কাহাকে” যেখানে কাজ করেছে প্রধান নারীবাদী মনোভাব। এই উপন্যাসের নায়িকা মনি ভেঙ্গে ফেলেছে প্রথাগত নারী ভাবমূর্তি। বাঙালি নারীকে পিতৃতন্ত্র দিয়েছে স্বামী ভক্তির পাঠ।
শৈলবালা ঘোষজায়ার “জন্ম-অপরাধী” নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এক অসামান্য উপন্যাস। জন্ম অপরাধী নামটি প্রগাড় তাৎপর্যতা নির্মমভাবে তুলে ধরে পিতৃতন্ত্রের নারীর অস্তিত্বের বিভীষিকা। উপস্থিত করেছেন পীড়ন আর পীড়নের রূপ,যেন পিতৃতন্ত্র নারীর উপর যত পীড়ণ করেছে তা একযোগে ভোগ করেছে তার নারীরা। এই উপন্যাসে প্রথম অপরাধ সে নারী দ্বিতীয় অপরাধ সে দরিদ্র ঘরের অনাথ মেয়ে তার বিয়ে হয়েছিল কৌশলী বিনোদ লালের সাথে, তবে তার স্বামী এক হিংস্র পাষন্ড। অপেরা বিদ্রোহী নয়। সে পুরুষতন্ত্রের ছক মেনে নিয়েই বেঁচে থাকতে চেয়েছে কিন্তু তাকে বাঁচতে দেয়া হয়নি। তাই সে মনে দাগ কাটে প্রতিবাদীর থেকে অনেক বেশি, তার শোচনীয় জীবনই হয়ে ওঠে এক নিরন্তর নিঃশব্দ বিদ্রোহ। শৈলবালা পাতায় পাতায় শ্লেষ করেছেন পুরুষ-ঈশ্বর-ধর্মকে সমগ্র পুরুষতন্ত্রকে। পুরুষতন্ত্রে কোন সম্মান নেই নারীর অপেরারও কোন সম্মান নেই শ্বশুরবাড়িতে। বিয়ের পর সম্ভাবনাময় কিশোরীটির জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায় নষ্ট হয়ে যায় তার জীবন, তার জীবনের নাম পীড়ণ। এই উপন্যাসে পুরুষকে দেখেছেন হিংস্র অমানবিক জন্তুরূপে যাদের কাজই নারী পীড়ণ।শৈলবালা আক্রমণ করেছে সমগ্র পিতৃতন্ত্রকে। অপেরারও মনে জাগে প্রতিবাদ। তখন নির্দয় শক্তিতে নিষ্পেষিত অপেরার হাত টিপিয়া ধরিয়া কঠোর ভঙ্গি করিয়া রূঢ় স্বরএ স্বামী বলিলেন__ “দেখো মেয়ে মানুষের অতটা তেজ ভালো নয়” তাই উপন্যাসে নারীদের স্থান কতটা নিচে তা দেখানো হয়েছে_“পুরুষ মানুষের চটি জুতার স্থানটা যেখানে বিবাহিত স্ত্রীর স্থান যে তাহার নিচে….”।
অনুরূপা দেবী হিন্দু বিধানের দীক্ষিত প্রথাগত ঔপন্যাসিক। ‘মন্ত্রশক্তি’ (১৯১৫)উপন্যাস দেখিয়েছেন নারী পুরুষের বিরোধের থেকেও এখানে ধর্মীয় বিধান বড় হয়ে উঠেছে। নায়িকা বাণীকে পুরুষের পায়ে সপে দিয়েছেন এঁকেছেন লৈঙ্গিক রাজনীতি ও বিরোধের চিত্র। নারী সংসার নিয়মের মাধ্যমে কিভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন অবজ্ঞা করে তার কাহিনী চিত্রিত করেছেন।
নিরুপমা দেবীর ‘দিদি’(১৯১৫) উপন্যাসে চেতনা ও কাঠামোয় অনুরূপার মন্ত্রশক্তির সাথে অভিন্ন এই উপন্যাসে প্রচার করা হয়েছে পিতৃতন্ত্রের বিধান। মহাশক্তিতে বাণী সারা উপন্যাসে নিজের দেহ রক্ষা করেছে স্বামীর কবল থেকে, শেষে আত্মসমর্পণ করেছে মৃত স্বামীর পায়ে। এই উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় গুলিতে নারীর জন্য প্রলোভন, মাঝের অধ্যায় গুলি নারীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত, আর শেষ পৃষ্ঠায় বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ণ। নিরুপমা দেবীর ‘শ্যামলী’ উপন্যাসে শ্যামলী নামের এক কালা বোবা পাগলীকে এই কাব্যিক নামটি ছাড়া আর সবই শোচনীয়। শ্যামলী কালো বোবা পাগলী তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে সবকিছ, শ্যামলী নারী তার জীবন নিষ্ফল হওয়ার জন্য কালো ও বোবাই যথেষ্ট। অন্যেরা ও নিরুপমা তাকে বারবার জন্তু জানোয়ার বলে নির্দেশ করেছে।
তথ্যসূত্র:
১. উনিশ শতকে নারীমুক্তি আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য (১৮৫০-১৯০১), রণজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, পুস্তক বিপণি, কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৯৯।
২.উনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বঙ্গমহিলা, মঞ্জুশ্রী সিংহ, শালবনি পাবলিশার্স, কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ, ২০০0
৩.উনবিংশ শতাব্দীর নারী প্রগতি ও রামমোহন বিদ্যাসাগর, কনক মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা বুক এজেন্সি, কলিকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৩।
৪.নারী প্রগতি : আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গ রমণী, গোলাম মুরশিদ, নয়া উদ্যোগ, কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ, ২০০০।
৫.নারী শ্রেণী ও বর্ণ (নিম্নবর্ণের নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান), কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
৬.নারী জাগৃতি ও বাংলা সাহিত্য, জ্ঞানেশ মৈত্র, ন্যাশন্যাল পাবলিশার্স, কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৮৭।
৭.নৈতিকতা ও নারীবাদ (দার্শনিক প্রেক্ষিতের নানা মাত্রা), শেফালী মৈত্র, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলিকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০/
৮.সিমন দ্য বোভোয়ার ও তাঁর নারীবাদ তত্ত্ব : মনোজিৎকুমার দাস
৯.দ্বিতীয় লিঙ্গ : সিমোন দ্য বেভোয়ার, হুমায়ুন আজাদ
প্রবন্ধ: সুকুমার পাল
কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়
(প্রকাশিত: ২২.০৯.২০২৩)
1 review
Sukanta barman
18 Jan 2024
অসধারণ লিখেছেন স্যার