E-Learning Info
Go to content

ভারতে বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা | ভারতে বিশ্বায়নের সুফল ও কুফল

ভূমিকা: ইংরেজি Globalization-এর বাংলা প্রতিশব্দ হল বিশ্বায়ন। সমগ্র বিশ্ব বা ভুবনকে কোনাে একটা কিছুর মধ্যে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া যদি বিশ্বায়ন হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে সেই কোনাে কিছুটা ঠিক কী? কে বা কারা সমগ্র বিশ্বকে একটা কিছুর মধ্যে নিয়ে আসতে চাইছে? ওই কোনাে কিছুটা অর্থনীতি, যােগাযােগ ব্যবস্থা, বাজার, সংস্কৃতি যা কিছু একটা হতে পারে, হয়তাে এসব কিছুর সম্মিলিত অর্থই হল বিশ্বায়ন। এককথায়, বিশ্বায়ন হল সমগ্র বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে একক বিশ্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং নিবিড় সংযােগসাধনের একটি প্রক্রিয়া। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বাজার বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, কর-কাঠামাের সংস্কার ও আইনি ব্যবস্থা সরলীকরণের মধ্য দিয়ে বিশ্বায়নকে ভারতে প্রয়ােগ করা হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ভারতের শিল্পক্ষেত্রে, কৃষিক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক জীবনে। ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাবের সুফল ও কুফলগুলি আলােচনা করা যেতে পারে।

ভারতে বিশ্বায়নের সুবিধাসমূহ
ভারত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে দেশীয় বাজারের মুক্তি ও আমদানি-রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগের বেড়াজাল উন্মুক্ত করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক পর্বে মনে করা হয়েছিল যে, ভারতের চিরাচরিত আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধারণা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে, ভারতীয়রা বিশ্বায়নের সুফলকে অনুভব করতে পেরেছে।
প্রথমত: উদারীকরণ নীতি অনুসরণ করার ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আমদানি ব্যয়ের অধিকাংশই মেটানাে হচ্ছে রপ্তানি আয়ের সাহায্যে। অর্থাৎ মুক্ত অর্থব্যবস্থা বিনিময় হারকে সরলীকরণ করেছে। এর ফলস্বরূপ রপ্তানি বাণিজ্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত: বিগত শতাব্দীর আশির দশকে ভারতের বেহাল অর্থনীতির কারণে দেশের সােনা বিদেশে বন্ধক দিতে হয়েছিল, সেই বন্ধকের হাত থেকে ভারত আজ মুক্ত। ভারতে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তৃতীয়ত: ভারতবর্ষে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিত চাল, আলু, গম, তুলা প্রভৃতি শস্য গুলির আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দাম বেশি থাকায় তা রপ্তানি করা হচ্ছে। ফলে কৃষকরা অতিরিক্ত দাম পাচ্ছে।
চতুর্থত: ভারতীয় টাকাকে পুরােপুরি লেনদেন বা বিনিময়যােগ্য করা হয়েছে। ফলে ডলারের অনুপাতে টাকার বিনিময় হারে ওঠানামা লক্ষ করা যায়। বর্তমানে ভারতীয় টাকার বিনিময় হারে স্থায়িত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পঞ্চমত: বিশ্বায়নের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি আমদানি ব্যয়ের প্রায় সমস্তটাই রপ্তানিকৃত অর্থের সাহায্যে মেটানাে সম্ভব হচ্ছে।
ষষ্ঠত: প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় প্রযুক্তিবিদরা বিদেশে যথেষ্ট সংখ্যায় কর্মসংস্থানের সুযােগ পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ভারতবর্ষ আজ অগ্রণী দেশে পরিণত হয়েছে।
সপ্তমত: ভারতীয় উদ্যোগপতি ও শিল্পপতিরা বিশ্বায়নের সুযােগকে সদ্ব্যবহার করে বিদেশের মাটিতে গাড়ি শিল্প, ইস্পাত শিল্প প্রভৃতি অধিগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে।
অষ্টমত: মহাকাশ গবেষণায় আজ ভারত বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। ভারতের প্রতিষ্ঠান ইস্রাে প্রচুর বৈদেশিক কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাকাশে রকেটের সাহায্যে পাঠিয়ে বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ফলে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে দেশকে সাহায্য করেছে।
নবমত: বিশ্বায়নের ফলে ভারতে যােগাযােগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে গেছে। ইনটারনেট, সেলফোন আজ প্রতিটি ভারতবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। ভারত সরকার স্বপ্ন দেখে তারা ভারতবর্ষকে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় পরিণত করবে।
দশমত: উদারীকরণ নীতি প্রয়ােগের ফলস্বরূপ ভারতের সাধারণ মূল্যস্তরে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

ভারতে বিশ্বায়নের অসুবিধাসমূহ
বিশ্বায়নের সুফল ভোগের পাশাপাশি আজ তার কুফলগুলিও ভারতের অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিদারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। সেগুলি আলােচনা করা প্রয়ােজন।
প্রথমত: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলে বিশ্বের বহুজাতিক বৃহৎ কোম্পানিগুলি এদেশে অবাধে কাজ করার ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, যার ফলস্বরূপ ভারতীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত: প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের জন্য বা FDI (Foreign Direct Investment)-এর জন্য বিদেশি বিনিয়ােগপতিদের কাছে খুলে দেওয়া হল ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পসংস্থাগুলিকে। যে-সমস্ত ক্ষুদ্র শিল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখত তারা আজ মৃতপ্রায়। বহুসংখ্যক শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকারে পরিণত হয়েছে।
তৃতীয়ত: কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার অবাধ হওয়ার ফলে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। বিদেশি সস্তা চাল এদেশে আসছে। ফলে কৃষকরা চাষ করে লাভজনক দাম পাচ্ছে না। ফলে কৃষিতে তার প্রভাব পড়ছে।
চতুর্থত: বিশ্বায়নের পরিণামে ভারতে বেকারসমস্যা প্রকট হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাসমূহের মূলধন উৎপাদন পদ্ধতির কারণে বৃদ্ধি পাওয়ায় চাকরির সুযােগ হ্রাস পাচ্ছে।
পঞ্চমত: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ভারতীয় অর্থনীতিতে শিল্পোৎপাদনের উর্ধ্বমুখী ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি।
ষষ্ঠত: প্রভিডেন্ট ফান্ড ও পেনশন প্রভৃতি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক সুবিধাগুলি আজ বাজার নির্ভর হয়ে গেছে। সরকার এখন পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা শেয়ার বাজারে লগ্নি করছে। ফলে নাগরিকদের ভবিষ্যৎ জীবনে অন্ধকার নেমে আসছে।
সপ্তমত: সমালােচকরা বলে থাকেন, ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে স্ফীতি হয়েছে, যে তথ্য বিশ্বায়নের সমর্থকরা দিয়ে থাকেন তা বিভ্রান্তিমূলক। আসলে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের জন্য এই স্ফীতি দেখায়। প্রকৃতপক্ষে ভারতের নাগরিকরা বিশ্বব্যাংকের মতাে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেনায় ডুবে আছে।
অষ্টমত: সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের দৌলতে আজ বিদেশি টেলিভিশন, ইনটারনেট এবং বলিউড সিনেমার প্রভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতা সংকটের মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এর দৌলতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নবমতম: বহুজাতিক সংস্থা গুলোর অবস্থান এর ফলে ভারতের কৃষিজ ও বনজ সম্পদও রক্ষা পাচ্ছে না। পেটেন্ট আইনের জন্য ভারতের সুপ্রাচীন বনজ ও কৃষিজ সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে।
দশমত: সব কিছুতেই ঠিকা শ্রমিক, চুক্তিমূলক চাকরি, স্বেচ্ছা ও বাধ্যতামূলক অবসর, বেসরকারিকরণ ও জনগণের জন্য সরকারি পরিসেবা হ্রাস করা হচ্ছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা বা উন্নত কলাকৌশলের পরিবর্তে দিচ্ছে শুধু বিলাসসামগ্রী। উন্নত পুঁজিবাদী দেশের কোম্পানিগুলির মূল উদ্দেশ্য প্রায় ১২৫ কোটি মানুষের বাজার দখল করা। যার ফলে ওষুধপথ্য-সহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে।
উপসংহার: তবে বলা যায় যে, বিশ্ব অর্থনীতি থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব নয়, উচিতও নয়; সংযুক্তিকরণ আবশ্যক। তবে ভারতের স্বার্থের অনুকূলে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। মূলধনের বিশ্ব বাজারের সঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতির সংযােগের ফলে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে সম্যকভাবে সংগতিসাধনের সামর্থ্য ভারতীয় অর্থনীতিকে অর্জন করতে হবে। বিশ্বায়নের অশুভ ফল দূর করতে হলে ভারতকে তার নিজস্ব সমাজ সংস্কারের কাজে মন দিতে হবে এবং বিদেশিদের উপর নির্ভর না করে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু সার্বিক চিত্রে ভারতে বেকারত্ব, কারখানায় লক-আউট, শ্রমিকের কাজ হারানাে, মাথাপিছু আয় কম, দারিদ্র্য বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয় গুলো দেখা যাচ্ছে। তাই সমালােচকরা বলে থাকেন, ভারতে গ্লোবালাইজেশন নয় আমেরিকানাইজেশন' ঘটেছে।
There are no reviews yet.
0
0
0
0
0

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content