বাণিজ্যবিদ্যা-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
বিপুল জনশক্তি ও পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হয়েও
ভারত আজ অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আমরা জানি যে, যুগোপযোগী
শিক্ষাই জাতিকে দেয় পথ চলার নির্দেশ৷ এটিই জাতির সকল
আশা-আকাঙ্ক্ষার মূল শক্তি। সমগ্র জাতির সার্বিক কল্যাণ
নির্ভর করে সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার উপর। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হইতেছে মানুষের
জীবনের পূর্ণতা আনয়ন করা এবং পূর্ণতার বিকাশ সাধন করা। বিবেকানন্দ বলেছেন, “Education is the
manifestation of perfection that is already in man." শিক্ষার
উপযোগিতা বিবিধ। শিক্ষা যেমন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, তেমনি শিক্ষাই
মানুষের সুপ্ত মনুষ্যত্বের বিকাশসাধন করে। কিন্তু এ সত্যকে আজ অস্বীকার করার উপায় নাই যে, আমাদের দৃষ্টি সাধারণত: পুঁথিঘেঁষা বিদ্যার দিকেই সন্নিবদ্ধ, বাস্তব জীবনের সঙ্গে এ শিক্ষার কোন যোগ নাই। তাই আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো আজ অনেকটাই বিপর্যস্ত। বাস্তব জীবনে যখন মানুষ অর্থনৈতিক সমস্যার চাপে বিপর্যস্ত, তখন নিজের
জীবনের পূর্ণতা আনতে হইলে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধানের পথ আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ধারণা, বাণিজ্য
সম্বন্ধে উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমেই এই অবস্থার সমাধান সম্ভব ।
ব্যবসা ও বাণিজ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি দিন দিন জটিল রূপ ধারণ করছে। সুতরাং
ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন না করলে ব্যবসায় সফলতা অর্জন করা যায়
না। আমাদের বাণিজ্যনীতির মূলসূত্রের সঙ্গে পরিচয় সাধন করতে হবে, বাণিজ্যবিষয়ক
তত্ত্ব ও তথ্য সম্যকরূপে আহরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, বাণিজ্যসম্পর্কে
জ্ঞানার্জন বলিতে শুধু বি.কম্., এম্.কম্. প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
হওয়ার কথা বোঝায় না। এই পরীক্ষাগুলিতে উত্তীর্ণ হওয়ার যুক্তি নিঃসন্দেহে আছে, কিন্তু
পুঁথিঘেষা বিদ্যা কি খুব বেশী বাস্তব প্রয়োজনে আসে? তাই আমাদের, হাতে-কলমে
শিক্ষা অর্জন করতে হবে। কারণ পণ্য উৎপাদন, পণ্যের কেনাবেচা নিয়েই বাবসা-বাণিজ্যের
কারবার। সুতরাং ব্যবসায় যারা নামবেন, তাদেরকে দেশবিদেশের বাজার, মুদ্রানীতি ও
অর্থনীতির সঙ্গে সম্যক-পরিচিতি থাকতে হবে—ব্যবসায়িক
আইনকানুন, কোম্পানীর
সংগঠন, পরিচালনপদ্ধতি, ব্যাঙ্কের
লেনদেন-বিষয়ক পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কেও প্রচুর জ্ঞান আহরণ করতে হবে। শুধু মূলধন
থাকলেই সাফল্য আসে না, তার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন, অভিজ্ঞতার প্রয়োজন— বাণিজ্যের ব্যবহারিক ও তত্ত্বগত দিক, প্রভৃতির সঙ্গে পরিচয় থাকা প্রয়োজন। যদি ত না থাকে, তাহলে বাণিজ্যে
পদার্পণ করা মূর্খতারই পরিচায়ক।
বাণিজ্য দেশের সম্পদবৃদ্ধির একটি বড় উপায়। যে দেশ ব্যবসায়-বাণিজ্যে
অনগ্রসর, দেবী
কমলার দৃষ্টি হতে সে দেশ বঞ্চিত। কিন্তু বাণিজ্যশিক্ষা তো আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। আমরা শ্রমবিমুখ। নির্দিষ্ট আয়ের চাকুরীর মোহ, কেতাব-সর্বস্ব
বিদ্যাই ইহার মূল কারণ।
আমাদের আরামপ্রিয়তা বর্জন করে কঠোর
পরিশ্রমী হতে হবে। তা হলে জাতীয় জীবনে আমাদের অসহনীয় অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে এবং
তা থেকে মুক্তিলাভ করার একমাত্র উপায়
বাণিজ্যশিক্ষা ৷
আমাদের দেশে বাণিজ্যবিদ্যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের দেশে
যদি বাণিজ্যসম্বন্ধীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটে তা হলে আমাদের দৃষ্টির
অস্বচ্ছতা দূর হবে। আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করিয়া তুলবার সামগ্রীর অভাব নেই, অভাব শুধু বাণিজ্যমুখী মনোবৃত্তির, সাধু সঙ্কল্পের, শ্রমের
মর্যাদাবোধের।
অবশ্য একথা স্বীকার করিতে হবে যে, ভারতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যবিষয়ক
পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে ৷ এই প্রচেষ্ট৷ যদি সাফল্যলাভ করে তাহা
হলে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যের মূলনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লোকের সংখ্যা
বাড়তে থাকবে । ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে দেশ আরও উন্নত হবে৷ সাহিত্য ও বিজ্ঞান
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে স্বচ্ছ ও সহজ করে তোলে, জীবনসম্পর্কে
দৃষ্টিকে আরও উদার করে। বাণিজ্যের নীতিও সেভাবে মানুষের সামাজিক ও
অর্থ নৈতিক জীবনকে নানা সমস্যা হতে মুক্ত করে । তাই সাহিত্য
ও বিজ্ঞানের সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য শিক্ষার সম্প্রসারণও একান্ত প্রয়োজন।
অবশ্য দেশ শিল্পে উত্তরোত্তর যত সমৃদ্ধ হয়, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো যত বিস্তৃত হয় বাণিজ্যশিক্ষার
গুরুত্ব ততই বাড়বে।
সবশেষে এ কথা বলা যেতে পারে যে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে হলে বাণিজ্যশিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার
করে তাকে বাস্তব রূপদান করতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাণিজ্যমুখী করে তুলতে হবে—তা
হলেই আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও লাভ করব। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিরর্থক।
There are no reviews yet.