ও-কার এর ব্যবহার
- ও-ধ্বনির উচ্চারণ বোঝানোর জন্য কোনো কোনো শব্দের বানানে ও-কার যোগ করা সংগত কি না-এই সমস্যার নিরসনে সিদ্ধান্ত হল, এই সব শব্দে ও-কারান্ত রূপ থাকুক।যেমন: কালো খাটো ছোটো ছোটোগল্প বড়ো বড়োদিন ভালো ভালোবাসা মতো ইত্যাদি।
এগারো বারো তেরো চৌদ্দ পনেরো ষোলো সতেরো আঠারো ইত্যাদি।
কিন্তু, এত কত তত যত ইত্যাদি শব্দে ও-কার অপ্রয়োজন।
কোন্-কোন-কোনো-কোনও -এই বানানগুলির মধ্যে দুটি ভিন্ন অর্থে "কোন্' (বিশেষ-বোধক প্রশ্নবাচক সর্বনাম, practicularising which) আর "কোনো' (অনিশ্চয়সূচক সর্বনাম, some, any) বোঝাতে ব্যবহার করা হবে। অনেকগুলির মধ্যে কয়েকটি বোঝানোর জন্য লেখা হবে "কোনো কোনো'। তেমনিভাবে কখনও,কখনোই; আরও, কিন্তু আরোই।
- too অর্থে "ও' অর্থাৎ সংযোগাত্মক (inclusive) প্রত্যয় ও-কে ও দিয়ে (ও-কার শব্দের সঙ্গে যোগ না করে) লেখাই উচিত। তাই, আজো আরো এখনো তোমারো রামেরো নয়। লেখা হবে, আজও আরও এখনও তোমারও রামেরও ইত্যাদি। পদ্যের স্বাভাবিক অভ্যাসে কিংবা ছন্দবিচারে সম্ভাব্য বিভ্রমের আশঙ্কায় বানানে ও-কার থাকতে পারে। যেমন,"আরো আরো প্রভু, আরো আরো"।
- আদি দল বা অক্ষরে (syllable-এ) স্বরধ্বনি অ-যুক্ত মূল শব্দের সঙ্গে -উয়া প্রত্যয় জুড়ে যে রূপ হয় (জল+উয়া>জলুয়া), তার আধুনিক রূপে দুটো ও-কার দেওয়াই সংগত হবে। তাই জলুয়া থেকে জোলো, পড়ুয়া থেকে পোড়ো, পটুয়া থেকে পোটো। এইভাবে থোলো (হুঁকো), ঝোড়ো, টোকো(-ফল) ইত্যাদি।
- কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষণের "লো'প্রত্যয় ও-কার ছাড়া লেখার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন-ঘোরাল, ছুঁচোল, জোরাল, ধারাল, টিকোল,প্যাঁচাল। এতে উচ্চারণ-বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে বলে শব্দগুলির বানানে ল-প্রত্যয়ের ও-করান্ত উচ্চারণ বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। তাই: ঘোরালো ছুঁচোলো জোরালো টিকোলো ধারালো প্যাঁচালো ইত্যাদি। কিন্তু দাঁতাল (হাতি), দাঁতালো নয় (এখানে প্রত্যয়টি -আল্)।
- তো এবং সেই সূত্রে "হয়তো নয়তো'ও-কারযুক্ত করার প্রস্তাবও উচ্চারণসংগত।
- ক্রিয়াপদের বিভিন্ন রূপে নিম্নবর্ণিত পার্থক্যগুলি বজায় থাকা বিধেয়।
- নিত্যবর্তমানকালে নিয়মিত অভ্যস্ত ঘটনা বোঝাতে ক্রিয়ার অ-কারান্ত: তুমি কোন কাগজ পড়? এইরকম শোন, ভাব, কাট।
- বর্তমান অনুজ্ঞা বোঝাতে ক্রিয়ার ও-কারান্ত: এটা পড়ো/শোনো/ভাবো/কাটো তো দেখি।
- তুচ্ছার্থক বর্তমান অনুজ্ঞা বুঝাতে ক্রিয়ার শেষ ব্যঞ্জনে হস্ চিহ্ন: তুই পড়্/শোন্/ভাব্/কাট্।
- ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় অর্থাৎ আদেশে, অনুরোধে ক্রিয়ার একাধিক ও-কার: এ বইটা অবশ্যই পোড়ো। এই রকম শেষ ব্যঞ্জনে শুনো, ভেবো, কেটো, দেখিয়ো। ক্রিয়াটি তুচ্ছার্থ হলে, পড়িস, শুনিস, ভাবিস, কাটিস, দেখাস।
- বস্ ধাতুর ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় ক্ষেত্রেই অনুজ্ঞার রূপ হবে বোসো। তুচ্ছার্থক,বসিস।
- তবে ক্রিয়ারূপের অতীত ও ভবিষ্যৎ রূপে শেষ বর্ণে ও-কার বর্জনীয়; অর্থাৎ বলল বলব লেখা হবে, বললো বলতো বলবো ইত্যাদি নয়। হল (<হইল), হত(<হইত) ও-কার ছাড়া লিখতে হবে। সাধুভাষায় এসব প্রয়োগে বিভক্তিতে ও-কার ছিল না। চলিত ক্রিয়ারূপেও ও-কার দেবার প্রয়োজন নেই।
- সাধিত ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের শেষে -নো থাকবে। যেমন-করানো (করান নয়)। এইভাবে: খাওয়ানো চালানো দেখানো পাঠানো বলানো লাগানো শোনানো ইত্যাদি।
- কোথাও কোথাও দ্বি-দল (bisyllabic) ধাতুর দ্বিতীয় ব্যঞ্জনে ও-কার বর্জন করা হয়।যেমন: এগবে জুড়ল পিছবে পৌঁছাল ফুরল লুকবে।এই বানানরীতি যুক্তিহীন; তাই লিখতে হবে: এগোবে জুড়োল পিছোবে পৌঁছোল ফুরোল ভিড়োবে লুকোবে ইত্যাদি।
এরপক্ষে যুক্তি দু রকম। এক, ধ্বনিতত্ত্বের যুক্তি: লুকা-জুতা-ফুরা প্রভৃতি ধাতু স্বরসংগতিগত ধ্বনিপরিবর্তনে লুকো-জুতো-ফুরো-হয়েছে। যে নিয়মে মুলা থেকে মুলো, সুতা থেকে সুতো হয় সেই একই নিয়মে। আমরা মুলো সুতো বোঝাতে মুল সুত লিখি না। সুতরাং লুকো-ফুরো-ইত্যাদির সঙ্গেই বিভক্তি যোগ হবে। দুই, সমরূপতায় সম্ভাবনা এড়ানোর যুক্তি: ভিড়বে আর ভিড়োবে-র প্রথমটি প্রযোজক নয়, দ্বিতীয়টি প্রযোজক ক্রিয়া। বানান এক (ভিড়বে) হলে "নৌকা ভিড়বে', আর মাঝি "নৌকো ভিড়োবে'-এ দুয়ের মধ্যে তফাত রাখা যাবে না "ভিজবে' আর "ভিজোবে'-র মধ্যে। একই রকম তফাত রাখা দরকার -জুড়ল (ছেঁড়া পাতা জুড়ল), জুড়োল (ঠান্ডায় শরীর জোড়লো) ইত্যাদির মধ্যে।এই যুক্তিতে লেখা উচিত দৌড়ানো পুরোনো পৌঁছানো; দৌড়নো পুরনো পৌঁছনো নয়।
এমনকি বিশেষণ শব্দ পুরোনো-র মৌখিক রূপ হবে পুরোনো, পুরোনো নয়।
- সমাপিকা এবং অসমাপিকা ক্রিয়ার কোনো রূপেই অভিশ্রুতি বা স্বরসংগতিতে ও-কার বা উর্ধ্বকমার প্রয়োজন নেই। সুতরাং ব'লছে ক'রছে নয়, লিখব বলছে করছে। বোলে বা ব'লে নয়, লিখতে হবে বলে। তেমনই, করে হয়ে সয়ে পড়ে চলে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে অর্থবোধ সংশয় দেখা দিলে অসমাপিকায় উর্ধ্বকমার প্রয়োগ চলতে পারে। যথা : এমনি করে কেউ ভুল করে?
- এই কয়েকটি ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞা-রূপে ও-উচ্চারণ বোঝানোর জন্য ও-কার প্রয়োগ সংগত। যেমন: বোসো (কিন্তু বোস্ বসুন) ;হোয়ো (কিন্তু হও, হল, হত ইত্যাদি)
- সাধিক প্রযোজক ধাতুর ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় ইও-র বদলে -ইয়ো লেখাই সংগত। অর্থাৎ-করিয়ো দিয়ো দেখিয়ো শুনিয়ো ইত্যাদি।
- সিদ্ধ স্বরান্ত ধাতুর মধ্যম পুরুষের অনুজ্ঞার ক্ষেত্রেও ওইভাবে -য়ো হবে। যেমন:খেয়ো দিয়ো যেয়ো ইত্যাদি।