অ- তৎসম শব্দে বানানের নিয়ম
বাংলা অ- তৎসম শব্দ বলতে, সংস্কৃত তৎসম শব্দের ধ্বনি-পরিবর্তনে জাত অর্ধতৎসম/ভগ্নতৎসম শব্দ, ধারাবাহিক পরিবর্তনে রূপান্তরিত তদ্ভব, অস্ট্রিক বা দ্রাবিড়মূল শব্দ, অজ্ঞাতমূল অথবা দেশি শব্দ অথবা অ-ভারতীয় বিদেশি অথবা ঋণশব্দ ইত্যাদি বিবিধ শব্দশ্রেণিকেই বোঝায়। এগুলির মধ্যে উত্তরাধিকার-সূত্রে আগত তদ্ভব শব্দে মূলের ধ্বনি, স্বর বা ব্যঞ্জন, উভয়ক্ষেত্রেই পরিবর্তন ঘটে গেছে। সুতরাং সেইসব শব্দের বানানে মূলের বর্ণরূপের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার বা সাযুয্য রক্ষার প্রশ্নটি অধিকাংশ স্থলে নিছক সংস্কার মাত্র। সেই জাতীয় শব্দের বানানকে উচ্চারণের সমীপবর্তী বা অনুকূল করাই বানান-সংস্কারের তথা সমতাবিধানের মূলসূত্র হওয়া উচিত। তবে ব্যতিক্রম ঘটলে সেই সেই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের স্বতন্ত্র কারণ বা ব্যাখ্যা থাকতে পারে।
হ্রস্ব ই-কার ও দীর্ঘ ঈ-কার
একদা
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সমিতি অ-তৎসম শব্দের দীর্ঘ ঈ-কারের পরিবর্তিত রূপ হ্রস্ব ই-কারকে স্বীকার করে হ্রস্ব-দীর্ঘ দুটি বানানই বিকল্পে ব্যবহারযোগ্য বলে বিবেচনা করেছিলেন। তদবধি কুমীর-কুমির, পাখী-পাখি প্রভৃতি দুটি রূপই প্রচলিত। এখন অ- তৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ-কারযুক্ত বিকল্প রূপটি সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয়। এই অনুসারে প্রায় সর্বপ্রকার অ- তৎসম শব্দে বিকল্প দীর্ঘ ঈ পরিহার করে কেবল হ্রস্ব ই-কার ব্যবহৃত হবে।
যেমন: কুমির গাড়ি
চাঁদনি ছেনি
দিঘল দিঘি
দিয়াশলাই নিলা
পশমি পাখি
পারানি পিরিতি
বাড়ি বাঁশরি বাঁশি
রাখি সুপারি
সেঁউতি হাতি
হিরে ইত্যাদি।
কাহিনি
তদ্ভব শব্দ (কথনিকা>কহণিআ>কহানী/কাহিনি)
ফলে
এতে ন-এ দীর্ঘ ঈ-কার রাখার কোনো যুক্তি নেই। চিন চিনা-ও প্রাচীন
বাংলায় চিনা (কঙ্গুচিনা) হিসেবেই পাই। ‘চিনাবাদাম’ও প্রচলিত। ফলে
এই দেশনামটিকে তৎসম হিসাবে গণ্য করা অসংযত। তবু চিন ও চীন বিকল্প রাখা হল। গাভী-ও তৎসম নয়। ফলে এ শব্দটি ‘গাভি’ হিসেবে লেখাই সংযত।
- সংস্কৃত স্ত্রীবাচক প্রত্যয়ের নীতি অনুসারে অ- তৎসম শব্দেও দীর্ঘ ঈ-কার (বা-নী-কার) দিয়ে স্ত্রীলিঙ্গ বোঝানোর রীতি এখনও কমবেশি চলছে। ব্যাপকতর সমতার জন্য তাই সিদ্ধান্ত: এ ক্ষেত্রেও, অর্থাৎ অ- তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে, হ্রস্ব ই-কারের অথবা নি-কারের ব্যবহার হবে। তাই লেখা হবে, কাকি(-মা) কামারনি, খান্ডারনি, খুকি, খুড়ি খেঁদি, গয়লানি, চাকরানি, চাচি, ছুঁড়ি, ছুকরি, জেঠি(-মা), ঝি ঠাকুরানি, দিদি(-মা), নেকি, পাগলি পিসি(-মা), পেঁচি, বাঘিনি, বামনি, বেটি, ভেড়ি, মামি(-মা), মাসি(-মা), মুদিনি, মেথরানি, রানি, সাপিনি, সোহাগিনি, স্যাঙাতনি, ইত্যাদি।
- জীবিকা ভাষা সম্প্রদায় গোষ্ঠি জাতি ইত্যাদি বোঝানোর জন্য যে ই-কারান্ত প্রত্যয় ব্যবহার করা হয় তা দীর্ঘ ঈ-কার হবে না, সবসময় হ্রস্ব ই-কার হবে। যেমন: উজিরি, ওকালতি, জজিয়তি, জমিদারি, ডাকাতি, ডাক্তারি, নবাবি, ফকিরি, বরকন্দাজ, ব্যারিস্টারি, মাতব্বরি, মাস্টারি, মোক্তারি, হাকিমি ইত্যাদি।
- আরবি, ইংরাজি, কাশ্মীরি, গুজারাতি, পাঞ্জাবি, ফরাসি, ফারসি, ভিয়েতনামি, মারাঠি, মালয়ালি, মৈথিলি, সিন্ধি, হিন্দি ইত্যাদি।,
- অকালি কংগ্রেসি ঝারখন্ডি ইত্যাদি।
- ইরাকি ইরানি ওড়িশি কাবুলি জাপানি পশ্চিমি পাকিস্তানি বর্মি বাংলাদেশি বাঙালি বিহারি লাডাকি হানাফি ইত্যাদি।
কিছু
অ-তৎসম, মিশ্র ও বিদেশি বিশেষণ শব্দে যে ই-প্রত্যয় যুক্ত হয় তাও হ্রস্ব ই-কার দিয়েই লিখতে হবে। এ প্রসঙ্গে পূর্ববর্তীতালিকার অতিরিক্ত কয়েকটি শব্দ। যেমন: আকবরি আন্দাজি
আসামি কয়েদি
কারবারি কুদরতি
খানদানি খুনি
গায়েবি জঙ্গি
জরুরি জাহাজি তুঘলকি
তুফানি তেজারতি
দরকারি দরদি
দেশি ধানি(-রং) নজরবন্দি নাকি(স্বর) ফরায়েজি বন্দি(= কয়েদি) ভিনদেশি মজলিশ
মরমি মরশুমি
মুলতুবি মৌসুমিব
রাজি শরবতি
সরকারি হজমি
হিসেবি হিসাবি
ইত্যাদি।
কিছু
দেশি-বিদেশি সাধারণ বিশেষ্য শব্দেও হ্রস্ব ই-কার লেখা হবে। যেমন: কবুলতি কাঁসারি কেরামতি কোরামতি ক্যারদানি খবরদারি গোলামি চালাকি চালিয়াতি জবানবন্দি জালিয়াতি টিটকিরি ঠগি ঠুংরি ডুগডুগি ঢাকি(যারা ঢাক বাজায়) থানকুনি দেহলি পড়শি ফরিয়াদি সরফরাজি সালিশি হম্বিতম্বি হালালি হুজ্জতি
ইত্যাদি।
সংস্কৃত -ঈয়
প্রত্যয়
যদি বিশেষণার্থে বিদেশি শব্দ বা অ- তৎসম শব্দ বা শব্দাংশের সঙ্গে যুক্ত হয় সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ-কার বজায় রাখতে হবে। যেমন: অস্ট্রেলীয় আর্টেজীয় আলজিরীয় ইউরোপীয় ইতালীয় এশীয় কানাডীয় ক্যারিবীয় ক্যালেডোনীয় জর্জীয় পোলিনেশীয় লাইবিরীয় সাইবেরীয়
ইত্যাদি।
হ্রস্ব উ-কার, দীর্ঘ ঊ-কার
- অ-
তৎসম শব্দে বিকল্পহীনভাবে হ্রস্ব উ-কার ব্যবহার সর্বতোভাবে সমর্থনযোগ্য। সুতরাং – ধূলো পূজো না
লিখে লিখতে হবে ধুলো পুজো।
এ-রকমভাবেই: উনিশ চুন চুনি চুল জুয়া পুব ইত্যাদি।
- দীর্ঘ ঊ-কারযুক্ত তৎসম শব্দ কিংবা উপসর্গের সঙ্গে বাংলা প্রত্যয় কিংবা শব্দ যুক্ত হলেও দ্রুত অর্থবোধেরসহায়ক বলে মূলের দীর্ঘ ঊ/ঊ-কার বজায় রাখাই বিধেয়। তাই, ধূর্তামি মূর্খামি পূজারি।
- কিন্তু শব্দগুলি অর্ধতৎসম রূপ গ্রহণ করলে দীর্ঘ ঊ-কারের বদলে হ্রস্ব উ-কারই গৃহীত হবে। যেমন: উনত্রিশ, উনচল্লিশ, উনপঞ্চাশ, উনপাঁজুরে, ধুর্তুমি মুকখুমি পুজুরি ইত্যাদি।
There are no reviews yet.