মহাশ্বেতা দেবী ( ১৯২৬ - ২০১৬ )
মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলন কর্মী। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিগুলির (বিশেষত লোধা ও শবর উপজাতি) অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছিলেন। ইতিহাস ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা যার শিল্পীসত্তার উৎস ছিল, যিনি আজীবন শোষিত-বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষের পাশে থেকেছেন, লোধা-সাঁওতাল-শবর-সহিস-কিরিবুরু-হরিজনদের জীবনযাপনের সঙ্গে যিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখে তাদের কথা দেশবাসীকে জানাতে চেয়েছেন, সেই মহাশ্বেতা দেবী মানুষ ও শিল্পী হিসেবে সমাজে ও সাহিত্যে বরণীয় ব্যক্তিত্ব রূপে প্রতিষ্ঠা ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। বিচিত্র ও বিপুল অভিজ্ঞতা, প্রতিবাদী স্বভাব ও সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর দরদ তাঁকে উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য রচনা ও লেখায় অনুপ্রেরণা দিয়েছে — যে কারণে শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, ভারতীয় সাহিত্যেও তিনি সমৃদ্ধ হতে পেরেছেন।
জন্ম ও পরিবার:
১৯২৬ সালের ১৪ ই জানুয়ারি (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) মকরসংক্রান্তির দিনে জিন্দাবাহার লেনের মামার বাড়িতে মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম। তাঁর বাবা মণীশ ঘটক (১৯০২-১৯৭৯) ছিলেন একাধারে কবি এবং সাহিত্যিক, "যুবনাশ্ব' ছদ্মনামে বাংলা ছোটগল্পে এক নতুন যুগের প্রণেতা ছিলেন তিনি। তাঁর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখিকা ও সমাজকর্মী। তাঁর কাকা ঋত্বিক ঘটক ছিলেন চিত্রপরিচালক ও সাহিত্যিক। তাঁর পরিবারের প্রায় সবাই বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তাঁর পিতামহ সুরেশ চন্দ্র ঘটক ইংরেজি ও ইতিহাস বিষয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে ডবল এম. এ. পাস করেছিলেন, পরে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে এস. ডি. ও. হয়েছিলেন। পিতামহী ইন্দুবালা দেবীও ছিলেন সে সময়ের শিক্ষিত এবং প্রবল সংস্কৃতি-মনা। মনীশ ঘটকেরা পাঁচ ভাই চার বোন ছিলেন — মণীশ, সুধীশ, তপতী, সম্প্রীতি, ব্রততী, আশীষ, লোকেশ, ঋত্বিক ও প্রতীতি। এরা প্রত্যেকেই বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে স্বনামধন্য। মহাশ্বেতার মাতৃকুলও শিক্ষিত ও সাহিত্যমনস্ক ছিলেন। মাতামহ নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত আইনজীবী ও সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক। মাতামহী কিরণময়ী দেবীর পিতা যাদবেন্দ্র চক্রবর্তী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুরাগী এবং রাজনারায়ণের বন্ধু ছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
মহাশ্বেতা দেবীকে খুব অল্প বয়সে ভর্তি করা হয় ইডেন মন্টেসরি স্কুলে। মাত্র চার বছর বয়সেই তিনি বাংলা লিখতে ও পড়তে শিখেছিলেন। ১৯৩৫ সালে তাঁর বাবা মেদেনীপুরে বদলি হলে তিনি সেখানের মিশন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরের বছর ১৯৩৬ সালে মেদেনীপুর ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয় শান্তিনিকেতনে। পরবর্তীতে তিনি অসুস্থ মা ও ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করার জন্য শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পর তিনি বেলতলা বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে তিনি পুনর্বার শান্তিনিকেতনে বি. এ পড়তে যান। ১৯৪৬ সালে ইংরেজি অনার্স সহ বি. এ পাস করে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফিরে আসেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ (ইংরেজি) ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিণামে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাময়িকভাবে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু তথাপিও তিনি থেমে থাকেননি, পরবর্তীকালে নানা কাজে যুক্ত থেকেও প্রায় সতেরো বছর পর ১৯৬৩ সালে তিনি এম. এ পাস করেন।
বৈবাহিক জীবন:
কলেজে পড়াকালীন সময়ে বিজন ভট্টাচার্যের (১৯১৫-১৯৭৮) সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে প্রখ্যাত নাট্যকার ও সাহিত্যিক বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে পারিবারিকভাবে তাঁর বিয়ে হয়। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথপ্রদর্শক। ১৯৪৮ সালে তাঁদের পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যের (১৯৪৮-২০১৪) জন্ম হয়। নবারুণ ভট্টাচার্য পরবর্তীকালে ঔপন্যাসিক ও রাজনৈতিক সমালোচক হয়েছিলেন। কিন্তু দারিদ্রতা তাঁদের সংসার জীবনকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি। ১৯৬২ সালে বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তীকালে তিনি দ্বিতীয় বার ১৯৬৫ সালে অসিত গুপ্তকে বিয়ে করেন। কিন্তু সেই বিয়েও সুখের হয়নি। ১৯৭৬ সালে আবার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে লেখাকে চিরসঙ্গী করে তিনি তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
কর্মজীবন:
সংসার চালানোর পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মহাশ্বেতা ১৯৪৮ সালে পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। জীবিকার তাগিদে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে ইনকাম ট্যাক্সের অফিসে চাকরি পেলেও তা করা হয়নি। এই বছরেই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের পোস্টাল অডিটে আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে চাকরি পান কিন্তু সেটিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৫৭ সালে রমেশ মিত্র বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ পাওয়ার পর তাঁর জীবনে কিছুটা স্থিতি আসে। ১৯৬৪ সালে তিনি বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজির অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পর ১৯৮৪ সালে তিনি সেখান থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তারপর থেকে বিভিন্ন সমাজসেবায় লেখায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। বিশেষকরে আদিবাসীদের কল্যাণমূলক কাজে তাঁর অবদান স্মরণীয়।
সাহিত্য:
মহাশ্বেতা দেবীর লেখক জীবনের শুরু চল্লিশের দশকে। খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত "রংমশাল' পত্রিকায় ১৯৩৯ সালে "রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা' তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় "দেশ ' পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কথায় তিনি ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। সে সময় তাঁর তিনটি ছোটগল্প "দেশ' পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ এর মধ্যে তিনি সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামে অনেকগুলো গল্প লিখেছিলেন "সচিত্র ভারত' পত্রিকায়। পরবর্তীকালে তাঁর প্রথম জীবনীগ্রন্থ "ঝাঁসীর রানী' ১৯৫৫ সালে "দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৫৬ সালে গ্রন্থটি পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়। "দেশ' পত্রিকাতেই "যশবন্তী' নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। পিতার মৃত্যুর পর আদিবাসীদের জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে মনীশ ঘটক সম্পাদিত "বর্তিকা' পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মূলত বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তবে সেইসব রচনার মধ্যে অনেকগুলি অন্যান্য ভাষায়ও অনুদিত হয়েছে।
উপন্যাস :
১) নটী (১৯৫৭)
২) মধুরে মধুর (১৯৫৮)
৩) যমুনা কী তীর (১৯৫৮)
৪) তিমির লগন (১৯৫৯)
৫) প্রেমতারা (১৯৫৯)
৬) এইটুকু আশা (১৯৫৯)
৭) বায়োস্কোপের বাক্স (১৯৬০)
৮) রূপরেখা (১৯৬০)
৯) তারার আঁধার (১৯৬০)
১০) লায়লা আসমানের আয়না (১৯৬১)
১১) পরম পিপাসা (১৯৬১)
১২) সামনে তাকাও (১৯৬১)
১৩) অমৃত সঞ্চয় (১৯৬২)
১৪) দিনের পারাবারে (১৯৬৩)
১৫) অজানা (১৯৬৫)
১৬) বাসস্টপে বর্ষা (১৯৬৬)
১৭) কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু (১৯৬৬)
১৮) আঁধার মাণিক (১৯৬৬)
১৯) বিপন্ন আয়না (১৯৬৬)
২০) তীর্থশেষের সন্ধ্যা (১৯৬৬)
২১) দুস্তর (১৯৬৬)
২২) মধ্যরাতের গান (১৯৬৭)
২৩) স্বামীর ঘর (১৯৬৮)
২৪) মাস্টার সাব (১৯৭২)
২৫) হাজার চুরাশির মা (১৯৭৩)
২৬) জন্ম যদি তব (১৯৭৬)
২৭) ধানের শিষে শিশির (১৯৭৬)
২৮) স্বাহা (১৯৭৭)
২৯) অরণ্যের অধিকার (১৯৭৭)
৩০) অপারেশন বসাই টুডু (১৯৭৮)
৩১) অগ্নিগর্ভ (১৯৭৮)
৩২) সরসতীয়া (১৯৭৯)
৩৩) সুভাগা বসন্ত (১৯৮০)
৩৪) নৈঋতে মেঘ (১৯৮০)
৩৫) জটায়ু (১৯৮০)
৩৬) অক্লান্ত কৌরব (১৯৮০)
৩৭) চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর (১৯৮০)
৩৮) সিধু কানুর ডাকে (১৯৮১)
৩৯) বিবেক বিদায় পালা (১৯৮৩)
৪০) শালগিরার ডাকে (১৯৮৩)
৪১) আশ্রয় (১৯৮৫)
৪২) তিতুমির (১৯৮৬)
৪৩) বিশ- একুশ (১৯৮৬)
৪৪) শ্রী শ্রী গণেশ মহিমা (১৯৮৭)
৪৫) টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা (১৯৯০)
৪৬) সতী (১৯৯০)
৪৭) ক্ষুধা (১৯৯২)
৪৮) গান্ধারী পর্ব (১৯৯২)
৪৯) মার্ডারারের মা (১৯৯২)
৫০) ব্যাধখণ্ড (১৯৯৭)
৫১) ঊনত্রিশ নম্বর ধারার আসামী (১৯৯৮), প্রভৃতি ।
ছোটগল্প সংকলন গ্রন্থ :
১) সোনা নয় রূপো নয় (১৯৬০)
২) সপ্তপর্ণী (১৯৬১)
৩) অবিশ্বাস্য (১৯৭২)
৪) মূর্তি (১৯৭৯)
৫) স্তনদায়িনী ও অন্যান্য গল্প (১৯৭৯)
৬) পাঁকাল (১৯৮৩)
৭) দৌলতি (১৯৮৪)
৮) ইটের পর ইট (১৯৮৭)
৯) কি বসন্তে কি শরদে (১৯৮৭)
১০) প্রথমপাঠ (১৯৮৮)
১১) ঘাতক (১৯৮৯)
১২) তালাক ও অন্যান্য গল্প (১৯৯২), প্রভৃতি ।
কিশোর গল্প সংকলন:
১) গল্পের গরু ন্যাদোশ
২) হারে-রে-রে
৩) বাঘা শিকারী
৪) জাতকের গল্প
৫) মুনেশ্বর, প্রভৃতি ।
কল্পনাধর্মী গল্প:
১) ভূতানন্দ কলোনি
২) শিবাজির ঘোড়া
৩) বিড়ালের দেশে যাওয়া , প্রভৃতি ।
চলচ্চিত্রায়ন:
১) সংঘর্ষ (১৯৬৮)
২) রুদ্রালি (১৯৯৩)
৩) হাজার চৌরাসি কি মা (১৯৯৮)
৪) মাটি-মায় (২০০৬)
৫) গাঙ্গোর (২০১০)
পুরস্কার:
১) ১৯৭৯ সালে সাহিত্য আকাদেমি
২) ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী
৩) ১৯৯৬ সালে জ্ঞানপীঠ
৪) ১৯৯৭ সালে ম্যাগসাইসাই
৫) ১৯৯৮ সালে রবীন্দ্রভারতী থেকে ডি. লিট
৬) ১৯৯৯ সালে ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট
৭) ২০০৫ সালে ইতালি থেকে নোনিনো
৮) ২০০৬ সালে পদ্মবিভূষণ
৯) ২০০৭ সালে সার্ক সাহিত্য পুরস্কার
১০) ২০০৯ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন
১১) ২০১০ সালে যশবন্তরাও চবন জাতীয় পুরস্কার
১২) ২০১১ সালে বঙ্গবিভূষণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ।
মৃত্যু:
২০১৬ সালের ২৩ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মহেশ্বেতা দেবী কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি হন। পরে ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
প্রবন্ধ: সুইটি নাথ
তথ্যসূত্র :
১) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস , ড. দেবেশ কুমার আচার্য্য
২) মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্যে আদিবাসী জীবন , আরা হোসেন
৩) মহাশ্বেতা দেবী — উইকিপিডিয়া ।
(প্রকাশিত: ২১.০৫.২০২১)
There are no reviews yet.