কথকতা
উনিশ শতকের পূর্ব থেকেই কথকতা বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। কথকতা শব্দের অর্থ হলো মুখে মুখে কোনো গল্প বলা। যিনি গল্প বলেন তাকে বলা হয় কথক এবং তার গল্প বলাটিকে বলা হয় কথকতা। যুগযুগান্তর ধরে গল্প বলার যে রীতি চলে আসছে একেই বলা হয় কথকতা।
কথকতা লোকসংস্কৃতিরই অন্তর্ভূক্ত। বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে কথকতার যোগাযোগ বহুদিন ধরে চলে আসছে। যিনি কথকঠাকুর থাকেন তিনি উচুঁ বেদীর উপর শালগ্রাম শিলা স্থাপন করে মঙ্গলাচরণ করে কথার সূচনা করে থাকেন। পরবর্তীতে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত গীতা প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যাসহ কথকতার আসরে তা পরিবেশন করেন। কথকতাকে শুধু নীরস ব্যাখ্যা বলা যায় না, কারণ এর মধ্যে সংগীতের মোহময়তাও যুক্ত হয়। কথকঠাকুর তার বিষয় ব্যাখ্যায় এবং তার সংগীতের মধুময় কন্ঠস্বরে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে থাকেন। পূর্বে একটা সময় ছিল যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, বামন ভিক্ষা, নলদময়ন্তী প্রভৃতি বিষয় শোনবার জন্য কথকতার আসরে শ্রোতাদের ভিড় জমত, তারা এই গল্পগুলো শুনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন। কথকতায় গল্পের মধ্যে যে মূল বাক্য থাকে তাকে কথকতার আসরে "সার্ট' বলা হয়। একে "চুর্ণী' নামেও অভিহিত করা হয়। এই চুর্ণীর মধ্যে সংকেত ব্যবহার করা হত। চুর্ণীর ভেতরের অংশকে চুর্ণক বলা হয়। কথকঠাকুরকে চুর্ণ ছাড়াও রাত্রি বর্ণনা, মধ্যাহ্ন বর্ণনা, গ্রীষ্মবর্ণনা, দেশবর্ণনা প্রভৃতি মুখস্থ রাখতেই হত। প্রথমদিকে রাজা, জমিদাররা কথকতার আসরের আয়োজন করতেন কিন্তু উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে দেখা যায় নববাবুরাও কথকতার আসর দেওয়া শুরু করেন। কার কারো আসর ভীষণ জনপ্রিয়তাতা লাভ করেছিল। এদের মধ্যে ধরনীধর শিরোমণি, কৃষ্ণহরি ভট্টাচার্য প্রমুখের আসরের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে এই আসরগুলোর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।
কথকতার পরিবেশনকারী সাধারণত ব্রাক্ষণ বা ঠাকুর হতেন তাই এদেরকে কথকঠাকুর বলা হত। তিনি একধারে হতেন বক্তা এবং অন্যধারে হতেন গায়ক। তার মোহময় কন্ঠস্বরে হাজার হাজার মানুষের মন ভবের সাগরে বয়ে যেত। কখনো কখনো তার আসর হয়ে উঠতো জনসংযোগের মাধ্যম ও লোকশিক্ষার অঙ্গ। রাজা, শিক্ষিত লোক, অশিক্ষিত লোক, ব্যবসায়ী, ভিক্ষুক প্রত্যেকেরই এই কথকঠাকুরের গল্প শোনার অধিকার ছিল।
বর্ধমান জেলার সোনামুখী গ্রামের বাসিন্দা গদাধর শিরোমনি এবং ২৪পরগনার গোবরডাঙার রামধন তর্কবাগীশ কথকতার আদি প্রবর্তক। এঁরা সংস্কৃত শাস্ত্রপুরাণের ব্যাখ্যাকে বাংলা ভাষায় প্রবর্তন করেন এবং সংগীতের সঙ্গে তাকে যুক্ত করে তার মধ্যে সরসতার প্রবর্তন করেন। তাই আর পাঁচটি ধর্মীয় ব্যাখ্যার মত কথকতার আসর নীরস নয়। পূর্বে যেমন কথকতার খুব চর্চা ছিল, খুব জনপ্রিয়তা ছিল, সময়ের সাথে সাথে কথকতার চর্চা কমে গেছে বরং কথকতার তেমন কোন চর্চা এই বাংলাতে আর দেখা যায় না।
নিবন্ধ: টিনা চন্দ
তথ্যসূত্র:
১.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
(প্রকাশিত: ০৮.০৬.২০২১)
There are no reviews yet.