কালুরায়
সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের মানুষ সভ্য সমাজের বাসিন্দা হলেও জীব-জন্তুদেরকে একেবারে তাদের জীবন থেকে বাদ দিতে পারেনি। বরং এদের কেন্দ্র করে আবির্ভূত নানান দেবতাও তাদের জীবনে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছেন। কালু রায় এমন এক গ্রাম্যদেবতা যিনি গ্রামীন মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন।
কুমিরের হাত থেকে রক্ষার জন্য কালু রায়ের পূজা দেওয়া হয়। সুন্দরবনে জল ও বনজীবী মানুষেরা তার পূজা করে। সুন্দরবনের কালুরায় ও রাঢ়ের ধর্মঠাকুর একনয়।লোককাহিনি অনুসারে স্থানীয় হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে গিয়ে বহুবার হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে পীর বড়খাঁ গাজীর বিরোধ ও সংঘর্ষ ঘটেছে। আঞ্চলিক প্রভুত্বের অধিকার নিয়ে সুন্দরবনের হিন্দু ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের সঙ্গে তার প্রবলযুদ্ধ হয়। গাজী ও দক্ষিণরায়ের যুদ্ধ বিরতির শর্ত অনুযায়ী, কুমীর দেবতা কালুরায় হিজলীর শ্রদ্ধা সম্মানের অধিকার লাভ করেন।
কালুরায় মহিষের দেবতা। মেদিনীপুরের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই দেবতার বাস। কিংবদন্তি আছে যে উত্তরাঞ্চলের উত্তর রায় এবং দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণ রায় বড়ভাই কালুরায়ের কাছে মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে হেরে গিয়ে উত্তরে এবং দক্ষিণে পালিয়ে যান। উত্তর রায় সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না, তবে দক্ষিণরায় বাঘের দেবতা। আসলে মানুষ দেবতাদের সৃষ্টি করে নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে। তাই দেবাদিদেব মহাদেব ভিক্ষুক ব্রাক্ষণ আর আদিশক্তি পার্বতী বাঙালি ঘরের কন্যা হয়ে যান। আর কালু রায়ের জন্মের ইতিহাসে লুকিয়ে থাকে অধিকার দখলের বৃত্তান্ত যাকে কোন দৈব বিষয় বলে অন্তত মনে হয় না। মানুষের বশ্যতা মেনে মহিষ মানুষের সাহায্যে বাঘকে হারিয়ে দেয়-তেমনই কালুরায় হারিয়ে দেন দক্ষিণ রায়কে।
গ্রামীন মানুষ দক্ষিণরায়ের যেমন আকৃতি দিয়েছে কালু রায়ের তেমন কোন আকৃতি দেয়নি। কোথাও একটি, কোথাও তিনটি, কোথাও আবার পাঁচটি গোলাকার প্রস্তরখন্ড এই দেবতার প্রতীকরূপে অবস্থান করে। কালু রায়ের মন্দির দেখা যায় না, গাছের তলাতেই তার পূজা হয়। কালুরায়ের ডানদিকে থাকে দক্ষিণরায় ও চন্ডী আর বাম দিকে উত্তর রায় ও মঙ্গলাদেবী। কালুরায় অধ্যুষিত এলাকায় যে এক সময় প্রচুর মহিষের আধিক্য ছিল তা এই অঞ্চলের নাম থেকেই জানা যায়। যেমন-মহিষাদল, মহিষগোট প্রভৃতি।পূজামন্ত্রারূপে মহাকাল ভৈরবের মন্ত্র উচ্চারিত হয়। কারণ মহিষ যমের বাহন, এই দেবতার পূজায় তেমন কোন বাহুল্য নেই। নৈবেদ্য রূপে ফলমূল, কলা, আতপচাল দেওয়া হয়।কালু রায়কে কেন্দ্র করে একটা ছড়া এই অঞ্চলে প্রচলিত-
"উত্তর দক্ষিণরায়ে রাখি দুই পাশে
মধ্যস্থলে জ্যেষ্ঠ কালু রায় বসে।
সবার দক্ষিণে চন্ডী বামেতে মঙ্গলা,
পঞ্চরূপে পৃথিবীতে করেন লীলাখেলা।
কোথা একা, কোথা তিন, কোথা পঞ্চজন
নির্ভয়েতে কালুরায় করেন বিচরণ
ঘরবাড়ি নাহি কিছু বাস বৃক্ষতলে,
সদাচিন্তা কি যে হবে গ্রামের মঙ্গল।
বন্দো কালু রায়ে সবে গ্রামের দেবতা
গ্রামের ভরসা বিপদেতে রক্ষাকর্তা।'
প্রবন্ধ: টিনা চন্দ
তথ্যসূত্র:
১.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
(প্রকাশিত: ০৭.০৬.২০২১)
There are no reviews yet.