কবিতা সিংহের কবিতা
আন্তিগোনে
(কেয়া চক্রবর্তীকে)
একটি সতেরো বছরের মেয়ের পায়ের তলায়লুটিয়ে পড়তে পারে না একবার একবারো
তাবৎ সংসার?
শূকরী পালের মতো মুখাবয়বহীন রমণীর অপ্রয়োজন?ঘাড় ধরে নিয়ে এসে, – অবশ্য স্তন ও উদর ছাড়া
যদি থাকে অতিরিক্ত ঘাড়
একবার, শুধু একবারচুম্বন করাতে চাই আন্তিগোনে
তোমার ওই কলাপাতা রঙ পোশাকের পুণ্য প্রান্তদেশ!
আন্তিগোনে? তুমি কি জানতে পেরেছিলে?না না আন্তিগোনে, ওরা, পুরুষেরা, মনে মনে
সমস্ত, সবাই, হিসেবী ক্রেয়ন ওরা
তাবৎ সংসার শুধু অলীক আঠায় জোড়া দিতে চায়
আমি চাই কেবল তোমার আত্মা যা চায়! যা চায় !
আন্তিগোনে!
আমি ওই সর্বগ্রাসী লোভী মেয়েদের
যাদের সমস্ত চাই, সব চাই, সতীত্ব এবং পরকীয়া
একসঙ্গে সতীচ্ছদ, এবং রমণ এমন কি বাৎসায়নও যাদের বিধান দেন
দিনে সতী রজনীতে বেশ্যা বনে যেতে (ইতিগজঃ স্বামীর সকাশে)
আন্তিগোনে!
তুমি কেন সতেরো বছরে জেনে গেলে
ওইসব শূকরীরা মনোমতো রান্নাঘর, সমর্থ পুরুষ আর
স্তনের দুধের শারীর যন্ত্রণা ভার কমাবার মতো শিশু পেলে
থামাবেই সমস্ত চিৎকার, শুধু রেখে দিয়ে তার আদি খুনসুটি ?
আন্তিগোনে! তুমি কেন সতেরো বছরে জানতে পেরেছিলে সব?লোভ এক ছুরি— লোভী হতে নেই – লোভ কুটিকুটি সব দাঁতে কাটে
জন্মদিনের বড় নিটোল চাঁদের মতো কেক্
সে কেবল খণ্ড খণ্ড করে।
সমস্ত পুরুষ করে জননী গমন, শুধু স্বীকারোক্তি করে ইডিপাস?
তাই আন্তিগোনে, অত সকাল সকাল, কিংবা সকালেরও আগে নাকি
রাতে? নাকি জন্মের সময় – নাকি পিতার জ্যোর্তিময়
ঔরসেই ভাসমান বসে
তুমি বুকে রেখেছিলে মৃত্যুবীজ তীব্র সহজাত?
যেভাবে, স্বভাবে, বুকের ভিতর বয়, মিথ্যার যন্ত্রণা কিছু
স্বতন্ত্র ঝিনুক!
আন্তিগোনে!তোমার উন্নত বুকে ঈশ্বরেরো ছিল আয়োজন
তোমার বস্তির সুগঠনে থেবাই-এর অনাগত নৃপতির
প্রথম দোলনা !
তবু তুমি ত্যাগ করে চলে গেলে দুধের ধারার সেই নিঃসরণ-সুখপ্রসবের দুষ্প্রাপ্য আস্বাদ
কারণ তুমি যে ওই সতেরোর ভীষণ সকালে
জেনেছিলে সত্যিকার কিছু,
কিছু তো ছাড়তেই হয়
মাংস ও শরীর।
আস্তিগোনে, পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ করে মাতৃ-গমনস্বীকার সাহস রাখে শুধু ইতিহাস
আর একমাত্র সেই ইডিপাসই
জন্মদিতে জানে তোকে, তোকে আন্তিগোনে।
গর্জন সত্তর
পিস্তল ধ্বনিত করলো তাদের ছুট—দূর থেকে শোনা যাচ্ছে সেই অশ্বক্ষুর ধ্বনি
থরথর কেঁপে উঠছে চারদিক
ছুটে আসছে অগুনতি বর্ণময় অশ্বারোহী
গর্জন সত্তর।
ঘাড় বেঁকে আছে রোখা ঘোড়ার—টবগব করছে রক্ত
কেশর কাঁপছে রাগে
অভিমানী নাসায় ফুঁসছে আগুন
থরথর কেঁপে উঠছে মাটি—
আমি, গর্জন সত্তরের অগুনতি অশ্বারোহীর উল্লাস শুনতে পাচ্ছি!
তাচ্ছিল্যের হার্ডল ভাঙছে ক্রমাগত—
উল্টে ফেলছে অবহেলার খুঁটি—
উপড়ে দিচ্ছে উইয়ে-ধরা স্বপ্রোথিত জয়স্তম্ভ গর্জন সত্তরের অশ্বারোহী!
তারা নকল ইতিহাসকে ভাঙতে আসছে
সরসর করে আগুন এগোচ্ছে,
গর্জন সত্তর আসছে অন্ধ পাহাড় গুঁড়িয়ে
বধির নদীর স্থগিত কূল ছাপিয়ে
হো হো করে হেসে উঠছে, সব মন্দিরের দরোজা হাট করে দিয়ে দুরন্ত অশ্বে আমার জ্বলন্ত অশ্বারোহীরা
রমণীকে একভাবে কার্ডবোর্ড ছবির মতো
তারা নকল ইতিহাসকে ভাঙতে আসছে
বাতাসে উড়ছে ফুলকি হাওয়ায় দহনের সোঁদা গন্ধ -
শুকনো পাতার ওপর দিয়ে তারা চালিয়ে দিচ্ছে লাল ঘোড়াসরসর করে আগুন এগোচ্ছে,
গর্জন সত্তর আসছে অন্ধ পাহাড় গুঁড়িয়ে
বধির নদীর স্থগিত কূল ছাপিয়ে
হো হো করে হেসে উঠছে, সব মন্দিরের দরোজা হাট করে দিয়ে
ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে শুধু সাজানো মুখোশ
ছুটে আসছে
ক্ষুরের আঘাতে ভাঙছে পদ্মভোজীর ডেরা
বাস্তু ঘুঘুর ঘুম
ফাল ফাল করে ছিঁড়ে দিচ্ছে মুখোশ
খুলে আনছে বিদেশী মার্ক
বালিশ ফাটিয়ে বের করছে স্মাগড্ ডলার
সাবাস। আমার স্বপ্নের অশ্বারোহীরা
খান খান ভেঙে দিচ্ছে সমস্ত যৌন টোটেম
কবিতায় রমণী ব্যবসা!
র্যাবো ভেরলেন শার্ল বোদলেয়ার কাঁচিকাটা করেফেলে দিয়ে বাতিল পুরোনো সব অনুবাদ গন্ধলাগা গলিত দর্শন
ছুটে আসছে গর্জন সত্তররমণীকে একভাবে কার্ডবোর্ড ছবির মতো
নীল-ছবি পোস্টকার্ডে
যারা দেখবে না
চতুর্মাত্রিক তাকে সম্পূর্ণ দেখাবে, তারা আসছেঅন্তরে বাহিরে এক, নতুন দর্শন নিয়ে
পথ কেটে চলে যাচ্ছে অদ্ভুত সত্তর
পিস্তল ধ্বনিত করলো সেই তীব্র ছুট—
পথের বাঁকের দিকে কীভাবে নিমেষহীন চেয়ে!
দ্যাখো থরথর কেঁপে উঠছে ভূধর
অশ্ব হ্রেষা, ল্যাজের চামর আপসানিরেকাব উষ্ণীষ থেকে ঠিকরে পড়ছে জ্যোতি
যে কোনো মুহূর্তে আমি দেখতে পাবো সেই সব মুখ,
সরল কোমল রেখাহীন,— গর্জন সত্তর।
বৃক্ষ
বার বার বৃক্ষই কেবলবৃক্ষই আমার কাছে ফিরে ফিরে
আসে প্রত্যয়ের মতো
এমন প্রত্যয় আর বৃক্ষশাখা ভিন্ন কোথা রাখি
বৃক্ষই আমার সব
আমার সবেকী!
আমার জন্মের মধ্যে রয়ে গেছে তরুর ইশারা
বীজ থেকে ক্রমে আমি হাড়ে মাংসে শোণিতে মজ্জায়
চোখে কানে সঞ্চারিত হই
আমি যাই পত্রগুচ্ছের দিকে ফুলে ও পাপড়িতে যাই
বহিরঙ্গে আকাশে বাতাসে
তারপর বীজ ওড়ে আমার নিজের বীজ বাতাসে বাতাসেআমার কথারা যায় আমি যাই ইচ্ছাগুলি যায়
সব যায় দিকে ও বিদিকে
আর তারও পরআমি ফিরে আসি
নিজেকে সংবৃত করি সংকুচিত একেলা একাকী
বৃক্ষেরই দৃষ্টান্তে ফিরে আসি
বৃক্ষের দৃষ্টান্তে হই একা
বহিরঙ্গ ঢেকে ফিরি অন্তরঙ্গ গূঢ় মৃত্তিকায়বৃক্ষ থেকে শিখে নিই বাহিরে ভিতরে
এইসব মনোময় অঙ্গময় প্রাণময় বাঁচা!
সেই নারী
সেই নারী অধোনেত্রে পিছনে জগৎ রেখে স্থিরপৃথিবীর মত সেই অন্য এক পৃথিবীতে একা
চলে যাবে মুখ ঢেকে।
ভয়, মুখে শত মসীরেখা
দুঃখ যদি ভীতি যদি
তীক্ষ্ণ টানে এঁকে এঁকে রাখে।
অবোধ ভেবেছে কেশে কোনো চিহ্ন বেদনা রাখে না
কে জানিত কেশগুলি কোঁকড়ানো বেদনা অধিক
হৃদয়ের সব রক্ত ওই কৃষ্ণ রেখায় প্রতীক
দুঃখ ঠিক দেহ ঘিরে রেখে গেছে নিজের সঙ্কেত।
ঝড়ে সারা রাত্রি তার বাতায়ন বন্ধ হয়, খোলেকাহার চরণ ধ্বনি, যে ধ্বনি কামনা সে তো নয়
বুকের মুঠোয় ফোটে সারারাত রক্তজবা ভয়
এলে মুখ দেখাবো না; বুঝতে পারবে ভালোবাসি।
অপমানের জন্য ফিরে আসি
অপমানের জন্য বার বার ডাকেনফিরে আসি
আমার অপমানের প্রয়োজন আছে।
ডাকেন মুঠোয় মরীচিকা রেখে
মুখে বলেন বন্ধুতার– বিভূতি
আমার মরীচিকার প্রয়োজন আছে।অপমানের জন্য বার বার ডাকেন
ফিরে আসি উচ্চৈঃশ্রবা বিদূষক—সভায়
শাড়ি স্বভাবতই ফুরিয়ে আসে
আমার যে
কার্পাসের সাল্লাই মেলে না
অপমানের জন্য বার বার ডাকেন
ফিরে আসি
ঝাঁপ খুলে লেলিয়ে দেন কলঙ্কের অজস্র কুকুর
আমার কলঙ্কের প্রয়োজন আছে;
যুদ্ধরীতি পাল্টানোর কোনো প্রয়োজন নেইতাই করমর্দনের জন্য
হাত বাড়াবেন না।আমার করতলে কোনো অলিভচিক্কণ কোমলতা নেই।