E-Learning Info
Go to content

কবিগান

কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। গায়ককে কবি হতে হয়। তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন।

কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন "কবিয়াল' বা "সরকার'। তার সহকারী গায়কদের বলা হয় "দোহার'। তাঁরা সাধারণত নেতার কথাগুলিই পুনরাবৃত্তি করেন। কবিগান শুরু হয় "বন্দনা' বা "গুরুদেবের গীত'- এর মাধ্যমে। "বন্দনা' অংশটি সরস্বতী, গণেশ, জনতা ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এরপর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান গাওয়া হয়। এরপর চারটি বিষয়ভিত্তিক গান গাওয়া হয় "সখী সংবাদ',"বিরহ', "লহর' ও "খেউড়'। এরপর প্রতিযোগিতামূলক অংশটি শুরু হয়।কবিগানের আসরে এই অংশটিকে "কবিলড়াই'ও  বলা হয়। এই অংশে একজন গীতিকার-সুরকার মুখে মুখে গান বেঁধে অপর গীতিকার-সুরকারকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমে সেই আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কৃষ্ণনগর থেকে ভাগীরথীর তীরবর্তী নাগরিক কেন্দ্র থেকে সদ্য গঠিত কলকাতার বিত্তমান সমাজে একপ্রকার লঘু ধরণের গীতবাদ্য, যাত্রাপাচাঁলি প্রভৃতির বিশেষ প্রচলন হয়েছিল। তখন পুরাতন ঐতিহ্যের পথ রুদ্ধ হয়ে এসেছে, নতুন শিক্ষাসভ্যতার স্বর্ণদ্বার উন্মুক্ত হয়নি, অথচ নাগরিক সমাজের অনেকের হাতে কাঁচা টাকা জমেছে প্রচুর। এই বিকৃতরুচির নাগরিকদের রসের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য একপ্রকার নাগরিক লোকগীতি, অভিনয় ও কাব্যকলার অনুশীলন হয়েছিল। একে এককথায় কবিসংগীত ও উক্ত গায়কদের কবিওয়ালা বলা হলেও এর মধ্যে অনেক ভাগ উপবিভাগ আছে। মোটামুটি কবিগান, টপ্পা, যাত্রা ও পাচাঁলি-এই কটি শাখায় এই নাগরিক সাহিত্যের শ্রেণি বিন্যস্ত হতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দী বা তার পূর্ব থেকেই মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর প্রভৃতি ঈষৎ অগ্রসর নাগরিক অঞ্চলে হালকা চালেরও স্থূলরসের গীতিসাহিত্য বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। এরই নিকৃষ্টরূপ খেউড় গানে ফুটে উঠেছিল। ভারতচন্দ্রের "বিদ্যাসুন্দর'-এ দেখি, সুন্দরকে শ্বশুরবাড়িতে ধরে রাখার জন্য বিদ্যা তাকে প্রলুব্ধ করেছে খেউড় গানের উল্লেখ করে-"নদে শান্তিপুর হৈতে খেঁড়ু আনাইব। নূতন নূতন ঠাটে খেঁড়ু শুনাইব।' যাই হোক, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কবিগান কলকাতা ও তার চারপাশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল- সেই  জনপ্রিয়তা অব্যাহত ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। তারপর মাইকেল প্রভৃতি নব্যতন্ত্রের কবির উদয় হলে এই নাগরিক লোকনীতিধারা ক্রমে ক্রমে লোপ পেয়ে গেল।

একদল কবি ও গায়ক যাদের  শিক্ষাদীক্ষা বিশেষ না থাকলেও প্রকৃতিদত্ত শক্তির বলে সভায় দাঁড়িয়ে তৎক্ষনাৎ মুখে মুখে গান রচনা করে তাতে সুর সংযোগ করে গাইতে পারতেন, তাদের কবিওয়ালা বলা হয়। ওয়ালাযুক্ত হওয়াতে কবির জাত গেছে।  "কবিওয়ালা' শব্দ অনেকটাই ইংরেজী Poetaster শব্দের মতো। ফেরিওয়ালা মাথায় করে জিনিসপত্র ফেরি করে বেড়ায়, এই কবিওয়ালারা ঠিক তেমনিভাবে কবিতা বা গান ফেরি না করলেও তাঁরা সরস্বতীর সাধনাকে জীবিকার কাজে লাগিয়ে ছিলেন।

কবিগানের চারটি উপচ্ছেদ-ভবানী বিষয়ক, সখী সংবাদ, বিরহ, খেউড়। দুদল কবিওয়ালা আসরে অবতীর্ণ হয়ে পর্যায়ক্রমে চারটি স্তরে সঙ্গীত প্রতিযোগিতা ভাগ করে নিতেন।ভবানী, অর্থাৎ শ্যামাবিষয়ক; সখীসংবাদ ও বিরহ বৈষ্ণবপদাবলীর ঢঙে রচিত। খেউড় গান অনুষ্ঠানের শেষে গাইতে হত। বলাই বাহুল্য  এই অংশে পরস্পরের অশ্লীল রঙ্গকৌতূক ও ব্যক্তিগত গালিগালাজ আসরে অশ্লীল উত্তেজনা ছড়াত। তবু খেউড় কিছুটা সহনীয়, কিন্তু "পচা খেউড়' অতি অশ্লীল, কুরুচিকর। কিন্তু কবিগানে কিছু প্রতিভারও পরিচয় আছে। কবিওয়ালারা অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত হলেও পৌরাণিক ঘটনা ভালোই জানতেন। তাঁদের বেতনভূক বাঁধনদার ছিলেন, যাঁরা আসরে বসে বসেই গান বেধেঁ দিতেন এবং কবিওয়ালারা সেই গান সুর-তালে গাইতেন। অবশ্য কবিওয়ালাদের খ্যাতির পিছনে বাঁধনদারদের পরিচয় চাপা পড়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "কবিওয়ালাদের গান সাহিত্যরসের সৃষ্টি অপেক্ষা ক্ষাণিক উত্তেজনা উদ্রেকই প্রধান লক্ষ।' এ কথা অযৌক্তিক না হলেও কোনও কোনও কবিগানে কিছু কবিত্ব ও বুদ্ধি বিবেচনার পরিচয় আছে, তা অস্বীকার করা যায় না।
প্রবন্ধ: টিনা চন্দ
তথ্যসূত্র:
১.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
(প্রকাশিত: ০৭.০৬.২০২১)
There are no reviews yet.
0
0
0
0
0

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content