জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)
জন্ম:
জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা হলেও তিনি জসীম উদ্দীন নামেই পরিচিত। তাঁর বাবার বাড়ি ছিল একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। পিতা আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট।
শিক্ষা জীবন:
শৈশবে ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে জসীম উদ্দীনের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় । তারপর ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা(১৯২১), রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ (১৯২৮) পাস করেন । তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ (১৯২৯) এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ (১৯৩১) পাস করেন ।
কর্ম জীবন:
জসীম উদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয় পল্লিসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে । ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, দীনেশচ্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীম উদ্দীন কাজ করেন । তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও । তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোক সঙ্গীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সঙ্গীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান পেয়েছে । তিনি বাংলা লোক সাহিত্যের বিশদ ব্যাখ্যা এবং দর্শন খণ্ড আকারেও লিখে গেছেন ।
১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত চাকরি করার পর ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি প্রথমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে এখান থেকে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করে তিনি ঢাকার কমলাপুরে নিজ বাড়িতে স্থায়িভাবে বসবাস করেন।
কাব্য:
জসীম উদ্দীন একদম অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন । কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায়, পরিবার এবং বিয়োগান্ত দৃশ্যে, একদম সাবলীল ভাষায় তিনি বিশেষ আলোচিত কবিতা "কবর' লিখেন । তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায় । গাঁয়ের লোকের দৃষ্টিতে গ্রাম্য জীবন এবং পরিবেশ-প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্য জসীম উদ্দীন বিশেষভাবে পরিচিত । তার এই সুখ্যাতি তাঁকে পল্লী কবি উপাধি এনে দিয়েছে ।
গ্রন্থাবলি:
কাব্যগ্রন্থ :
রাখালী (১৯২৭, ১ম কবিতা সংকলন)
নক্সী কাঁথার মাঠ (১ম সংস্করণ ১৯২৮, গাথাকাব্য, মিসেস মিলফোর্ড কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় অনূদিত "The field of the Embroidered Quilt' শিরোনামে )
বালুচর (১৯৩০)
ধানখেত (১৯৩৩)
সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪)
হাসু (১৯৩৮)
রূপবতী (১৯৪৬)
মাটির কান্না (১৯৫১)
সকিনা (১৯৫১, গাথাকাব্য)
এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬)
সুচয়নী (১৯৬১, ৯৩টি কবিতার সংকলন)
ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)
হলুদ বরণী (১৯৬৬)
জলে লেখন (১৯৬৯)
পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯)
কাফনের মিছিল (১৯৭৮)
মহরম
দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি (১৯৮৭)
মা গো জালিয়ে রাখিস আলো (১৯৭৬)
নাটক:
পদ্মাপার (১৯৫০)
বেদের মেয়ে (১৯৫১, লোকনাট্য, ইংরেজিতে অনূদিত)
মধুমালা (১৯৫১, লোকনাট্য)
পল্লীবধূ (১৯৫৬, লোকনাট্য)
গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯, লোকনাট্য)
ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮, লোকনাট্য)
আসমান সিংহ (১৯৮৬, লোকনাট্য, কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
আত্মকথা:
যাদের দেখেছি (১৯৫১)
ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১)
জীবন কথা ( ১৯৬৪)
স্মৃতিপট (১৯৬৪)
স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮)
উপন্যাস:
বোবা কাহিনী (১৯৬৪)
ভ্রমণ কাহিনী:
চলে মুসাফির (১৯৫২)
হলদে পরির দেশে ( ১৯৬৭)
যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮)
জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)
সঙ্গীত:
রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫, সংগৃহীত ও স্বরচিত ৪৮টি গানের সংকলন)
গাঙের পাড় (১৯৫৪, গানের সংকলন)
শিশুসাহিত্য:
হাস (১৯৩৩)
এক পয়সার বাঁশী (১৯৪৯)
পাকিস্তানী উপকথা (১৯৫৩)
ডালিমকুমার (১৯৬৩, রূপকথা)
আসমানীর কবিভাই (১৯৮৬)
গবেষণা গ্রন্থ
জারি গান (১৯৬৮): কবির সংগৃহীত জারি গানের সংকলন। গ্রন্থটিতে জারীগান সংগ্রহের বিবরণ, স্থান, কাল, জারীগানের বিখ্যাত গায়কদের জীবনতথ্য, জারীগান সম্পর্কিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ইত্যাদি রয়েছে। কয়েকটি জারীগান অনুষ্ঠানের ছবি এবং মিসেস ডানহামের তৈরি করা একটি জারীগানের স্বরলিপি সংযোজিত হয়েছে।
মুর্শিদা গান (১৯৭৭): কবি গ্রামের গায়কদের কাছ থেকে এই গানগুলি সংগ্রহ করেছেন এবং এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। এতে রয়েছে মুর্শীদা গানের সংজ্ঞা, এর প্রাচীনত্ব, গানের প্রকারভেদ, সুরবৈচিত্র্য, রূপান্তর ও গানের প্রায়োগিক তথ্য, সংগ্রহের তারিখ, স্থান, গায়কের জীবনতথ্য প্রভৃতি।
গল্পসংকলন:
বাঙালির হাসির গল্প (১ম খন্ড, ১ম সংস্করণ ১৯৬০), ২য় খন্ড (১৯৬৪)। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে ২৭টি গল্প সংগ্রহ করে শিশুমনের উপযোগী করে প্রকাশ করেছেন।
বাঙালির হাসির গল্প (২য় খন্ড, ১ম সংস্করণ ১৯৬৪)। B. Printer দ্বারা অনূদিত। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত Folktales of Bangladesh গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত।
অনুবাদ:
জসীম উদ্দীনের "নক্সী কাঁথার মাঠ' কাব্যটি "দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট" এবং "বাঙালীর হাসির গল্প' গ্রন্থটি "ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান' নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
পুরস্কার:
প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরম্যান্স, পাকিস্তান (১৯৫৮)
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি, ভারত (১৯৬৯)
১৯৭৪ সনে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন
একুশে পদক, বাংলাদেশ (১৯৭৬)
স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৮ (মরণোত্তর)
মৃত্যু:
তিনি ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। গোবিন্দপুরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে তার জন্মদিনকে স্মরণ করে জসীম মেলা নামে একটি পাক্ষিক উৎসব উদযাপন করা হয়। তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
প্রবন্ধ: সুইটি নাথ
তথ্যসূত্র:
১) জসীম উদ্দীন - উইকিপিডিয়া
২) গুহ বিমল, জসীম উদ্দীন - বাংলাপিডিয়া
৩) বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
There are no reviews yet.