জেমস লঙ (১৮১৪-১৮৭৭)
জন্ম
রেভারেণ্ড জেমস লঙ এর জন্ম ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ড শহরে হয়েছিল। তার জন্ম স্থান বা বংশ পরিচয় অজ্ঞাত। শুধু জানা যায় তার জীবনের প্রথম ভাগ রাশিয়ায় অতিবাহিত। ১৮৩৯ সালে তিনি ইংল্যান্ডের গির্জার ‘ডিকন’ এবং পরের বছরই যাজক পদে অভিষিক্ত হন। লঙ ১৮৩৯ সালে যাজকরূপে কলকাতায় আসেন। কলকাতার দক্ষিণে ঠাকুরপুকুর গ্রাম ছিল তাঁর নির্ধারিত কর্মক্ষেত্র। সেখান থেকে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি তাঁর কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
শিক্ষা ও কর্ম জীবন
১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে লঙ ISLINGTION কলেজের ছাত্র ছিলেন সেখানে Anglican Church এর যাজকদের শিক্ষা দান করা হতো। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে লঙ Church of England এর যাজক হন। ১৪ই জুলাই তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করে কলকাতায় আসেন। ১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দে লঙ এমিলি নামে এক মহিলাকে বিবাহ করেন কিন্তু ১৮৪৭ সালে সমুদ্র যাত্রায় তার প্রথম স্ত্রী এর মৃত্যু হয়। শোনা যায় ১৮৬৭ সালে সমুদ্র যাত্রার সময় লঙ এর দ্বিতীয় স্ত্রীর ও মৃত্যু হয়। লঙ কলকাতায় এসে প্রথম Church Missionary Society র st Paul's School এর দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য লঙ ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ড এ ফিরে যান।
লঙ এর উল্লেখযোগ্য অবদান
সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণায় লঙ এর উল্লেখ যোগ্য অবদান রয়েছে। ১৮৬১ খ্রিঃ ২৬ শে এপ্রিল বেথুন সোসাইটির বিশেষ সভায় লঙ সমাজ বিজ্ঞানের উপর প্রস্তাবিত একটি রিপোর্ট পেশ করেন। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত Bengal Social Science Association এর গঠনে লঙ এর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে লঙ এর ভূমিকা
জেমস লঙ বাংলা , সংস্কৃত ও ফারসী ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন এবং অচিরেই একজন প্রাচ্যবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর Comparative Philology (১৮৪৩) প্রকাশিত হলে তিনি সে সময়ের ভাষাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বাংলার সাধারণ জনগণের সাথে প্রায়ই মিশে যেতেন, তাই বাংলার লোকসংস্কৃতির সাথে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। বাংলার অধিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশার সময় তিনি প্রবাদের ব্যবহার লক্ষ্য করেন এবং এগুলি সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তিনি বাংলার প্রায় সব অঞ্চল থেকেই প্রবাদ সংগ্রহ করেছিলেন এবং টীকা-টিপ্পনীসহ বই হিসেবে প্রকাশ করেন। তাঁর সংকলিত Bengali Proverbs (১৮৫১) বাংলা লোকসাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ।
বইটি সংকলের পর প্রায় দুই দশক তিনি বাংলা প্রবাদ ও লোকসাহিত্য নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করেন। বাংলার সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়নকালে লঙ A catalogue of Bengali Newspapers and Periodicals from 1818-1855 এবং Descriptive Catalogue of Vernacular Books and Pamphlets (১৮৬৫) প্রকাশ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ধাতুমালা, দৃষ্টান্তরত্ন, জীব-রহস্য, প্রাচ্য প্রবচন, পুরাতন কলকাতা, Selections from Unpublished Records of Government, Report on the Native Press of Bengal, Early Bengali Literature and Newspapers.
সমাজ বিজ্ঞানেরই একটি শাখা লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে লঙ এর ভূমিকা হিসেবে ১৮৭২ খ্রি "প্রবাদ মালা' নামে একটি সংকলন প্রকাশের কথা সুবিদিত। এরই ভিত্তিতে ১৮৭৫ খ্রি প্রকাশিত Oriental Proverbs in their relations to Folklore.. History, Sociology with Suggestion for their collections Interpretations, Publications নামক গ্রন্থটি লোক সংস্কৃতির বিষয় পরিধিতে লঙ এর মূল্যবান সংযোজক রূপে উল্লেখযোগ্য।
নীলদর্পণ এর দীনবন্ধু মিত্র ও জেমস লঙ
বিখ্যাত নাট্যকার নীলদর্পণ এর দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি একজন ইংরেজ হয়েও বাংলার নীল চাষীদের উপর অত্যাচারের কথা প্রচার করেন। পরিশেষে নীল দর্পণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেমস লঙ এর পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৬০ খ্রিঃ নীলদর্পণ এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের অপরাধে লঙ এর ১০০০ টাকার জরিমানা ও এক মাসের কারাদণ্ড হয়।
লঙ এর বিখ্যাত গ্রন্থ
জেমস লঙ এর রচিত "ধাতু মালা', "মহম্মদের জীবনী', "প্রাকৃতিক ইতিহাসের প্রশ্নাবলী', ইত্যাদি বাংলা গ্রন্থ খুব প্রচলিত ছিল। এছাড়াও তিনি বাংলা লোকসাহিত্যের উপরে অনেক কাজ করেছেন।
লঙ এর শেষ জীবন
জেমস লঙ একজন সত্যিকার অর্থে বাংলার লোক সংস্কৃতি তথা বাঙালির একজন আপনজন হয়েও ১৮৭২ খ্রিঃ তিনি কলকাতা ছেড়ে চিরদিনের জন্য লন্ডনে চলে যান। ১৮৭৩ সালে প্যারিসে, ১৮৭৪ সালে লন্ডনে, ১৮৭৬ সালে সেন্ট পিটার্স বারগে International Congress of Orientalists দের অধিবেশনে যোগ দেন। ইংরেজ হয়েও তিনি বঙ্গ দেশের মানুষ এর আপনজন ছিলেন। ১৮৭৭ খ্রি ২৩ শে মার্চ লন্ডনের অ্যাডামাস স্টিটের বাসভবনে জেমস লঙ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রবন্ধ: তন্ময়ী চৌধুরী
তথ্য সূত্র:
বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
প্রকাশিত-- (১৬. ০৫. ২০২১)
There are no reviews yet.