গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১)
ব্রতচারী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা ও জাতীয়তাবাদী লেখক ছিলেন গুরুসদয় দত্ত। তিনি অনেক সমাজ সেবামূলক কাজ করেছেন এবং অন্যান্য মানুষদেরকেও তিনি এই কাজে উৎসাহিত করেছেন। গুরুসদয় দত্ত লোকনৃত্য এবং লোকসঙ্গীত এর প্রতি খুব উৎসাহী ছিলেন এবং এই লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্প সংগ্রহ করার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন। তাঁর লোকসংস্কৃতির অনেক নিদর্শন কলকাতার উপকন্ঠে ঠাকুর পুকুরে অবস্থিত জাদু ঘরে সংরক্ষিত আছে। গুরুসদয় দত্তের সম্পূর্ণ নাম ছিল গুরুসদয় দত্ত চৌধুরী কিন্তু তিনি নিজে তাঁর পারিবারিক উপাধি চৌধুরী ব্যবহার করতেন না। তাই তিনি আমাদের কাছে গুরুসদয় দত্ত নামেই খুব পরিচিত ছিলেন।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
গুরুসদয় দত্ত ১৮৮২ সালের ১০ ই মে অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার বিরশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামকৃষ্ণ দত্ত এবং মাতার নাম ছিল আনন্দময়ী দেবী। রামকৃষ্ণ দত্ত ও আনন্দময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র গুরুসদয় দত্ত ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনাতে ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ, তাছাড়াও ছেলে বেলায় বন্ধুদের সাথে নৌকা চালানো, ঘোড়ায় চড়া, শিকার করা, প্রভৃতি গ্রামীণ ক্রীড়ায় তিনি অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন। গুরুসদয় দত্তের পিতা রামকৃষ্ণ দত্ত চৌধুরী ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত জমিদার। মাত্র ১৪ বছর বয়সে গুরুসদয় দত্ত পিতা- মাতা উভয়কে হারিয়ে জমিদার জ্যাঠামশায়ের আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছেন।
শিক্ষা ও কর্ম জীবন
গুরুসদয় দত্তের শিক্ষা জীবনের সূত্রপাত হয় স্বগ্রামের মাইনর স্কুলে। শিক্ষা জীবনের প্রথম থেকেই তিনি অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বীরশ্রী গ্রামের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তারকনাথ রায়। গুরুসদয় দত্ত এই তারকনাথ রায়ের সাহচর্যে পড়াশুনায় একের পর এক সাফল্য অর্জন করেন। গ্রাম্য পাঠশালায় তিনি পড়াশুনা শেষ করে ১৮৯৮-৯৯ সালে শ্রীহট্ট গভর্মেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছোট বেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মেধানুসারে তিনি ১৯০১ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ. এ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন।১৯০৩ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান এবং ১৯০৪ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আই. সি. এস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯০৫ সালের শেষ দিকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এর সদস্য হয়ে স্বদেশে ফিরে এসে তিনি এস.ডি.ওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯০৬ সালে গুরুসদয় দত্ত সরোজনলিনী দেবীকে বিবাহ করেন। সরোজনলিনী দেবী কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা না করলেও দেশি ও বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি ঘোড়ায় চড়া, টেনিস খেলা, বেহালা বাজানো, এবং সঙ্গীত শিক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। গুরুসদয় দত্ত এবং সরোজনলিনী দেবীর একমাত্র পুত্র ছিল বীরেন্দ্রসদয় দত্ত। ১৯১১ সালে গুরুসদয় দত্ত তাঁর স্ত্রীর প্রেরণায় বিহার থেকে বাংলা বিচার বিভাগের কাজে যুক্ত হন এবং ১৯১৯ সালে বীরভূম জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৯২৩ সালে কলকাতায় কৃষি বিভাগের সচিব হন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি তাঁর স্ত্রী সরোজনলিনী দেবী পরলোক গমন করেন। পরে তিনি তাঁর মৃত পত্নীর নামানুসারে "সরোজনলিনী শিক্ষা সমিতি' (১৯২৫) এবং "সরোজনলিনী নারী মঙ্গল সমিতি' নামে দুটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৯ সালে রোমে আন্তর্জাতিক কৃষি প্রতিষ্ঠান এর অধিবেশনে প্রতিনিধিত্ব করে স্বদেশ ফেরার পর তিনি ময়মনসিংহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হন। গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি "ব্রতচারী সমিতি' গঠন করেন।
গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন
ব্রতচারী আন্দোলন হচ্ছে ১৯৩২ সালে গুরুসদয় দত্তের প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক উন্নয়নের আন্দোলন। ১৯৩২ সালে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। ব্রতচারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল- জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয় চেতনা ও নাগরিকত্ব তৈরি করা। গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী সম্পর্কে একটি ইংরেজি বই "The Brata Chari Synthesis' এবং একটি আলোচনা গ্রন্হ "ব্রতচারী পরিচয়' ১৯৪১ সালে প্রকশিত হয়। ব্রতচারী বিজ্ঞান, ব্রতচারীর প্রণীতি, ব্রতচারীর পর্যায় বিভাগ ইত্যাদি নিয়ে "ব্রতচারী সখা' রচিত হয়েছে। গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত লাভ করেন। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ তৎকালীন সময়ের অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গ গুরুসদয় দত্তের প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলন এর সাথে যুক্ত হন।ব্রতচারী আন্দোলনের মূল কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নং লাউডন স্ট্রিটে। ব্রতচারীগণকে জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য, ও আনন্দ এই পঞ্চ ব্রতে দীক্ষিত হয়ে দেশ সেবায় আত্মোৎসর্গ করতে হতো। ব্রতচারী হতে ইচ্ছুক ব্যাক্তিকে নিম্নরূপ প্রতিজ্ঞা করতে হতো:
'ব্রতলয়ে সাধব মোরা বাংলাদেশের কাজ
তরুনতার সজীব ধারা আনবো জীবন- মাঝ।
চাই আমাদের শক্ত দেহ, মুক্ত উদার মন।
রীতিমতো পালবো মোরা মোদের প্রতিপণ।'
তাছাড়াও ব্রত চারীকে আরো তিনটি পণ করতে হতো---
"আমি বাংলাকে ভালবাসি
আমি বাংলার সেবা করবো
আমি বাংলার ব্রতচারী হবো।'
বাংলার লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুসদয় দত্তের অবদান
বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে গুরুসদয় দত্তের অবদান ছিল চিরস্মরণীয়। তিনি একাধিক লোকসংস্কৃতি সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেগুলো লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ অপরিহার্য। ভারতীয় লোকনৃত্য সম্পর্কে তিনি ১৯৩৩ সালে একটি আলোচনা গ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং এটি হলো- "Indian Folk Dance and Folk Song Movement' তিনি বারো বছর ধরে বাংলার লোকশিল্পের একাধিক উপাদান সংগ্রহ করেন। তার মধ্যে অন্যতম উপাদান হলো- বিভিন্ন ধরনের নকশী কাঁথা, পট, মাটির-কাঠের-পাথরের পুতুল ও মূর্তি, সরা প্রভৃতি। যেগুলো ব্রতচারী সমিতির প্রচেষ্টায় তৈরি "গুরু সদয় সংগ্রহ শালায়' সংগৃহীত রয়েছে।
শেষ জীবন ও মৃত্যু
গুরুসদয় দত্ত ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে ও দুরারোগ্য কর্কট রোগের কারণে তাঁর স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। ১৯৪১ সালের ২৫শে জুন তিনি পরলোক গমন করেন। গুরুসদয় দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর লোকনৃত্য বিষয়ক গ্রন্হ "The Folk Dances Of Bengal' (১৯৫৪) অশোক মিত্র কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তাছাড়াও "শ্রীহট্টের লোক সঙ্গীত' (১৯৬৬) এবং "Folk Arts and Crafts of Bengal' (১৯৯০) ইত্যাদি গ্রন্থগুলোও প্রকাশিত হয়েছিল।
গুরুসদয় দত্তের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
গুরুসদয় দত্ত অসংখ্য গ্রন্থ ও রচনা প্রকাশ করেছিলেন, যেগুলো বর্তমানে দুর্লভ। তাঁর রচিত গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো হলো --
১. পল্লীর সংস্কার (১৯২৫)
২. Village Reconstruction (১৯২৫)
৩. সরোজ নলিনী (১৯২৮)
৪. পল্লী সংস্কার ও সংগঠন(১৯২৮)
৫. গানের সাজি (১৯৩১)
৬. বাংলার সামরিক ক্রীড়া (১৯৩১)
৭. Folk song and Folk Dance in Indian School (1931)
৮. চাঁদের বুড়ি (১৯৩৩)
৯. Indian Folk Dance and Folk lore Movement (1933)
১০. Brata Chari Synthesis (1937)
১১. পটুয়া সঙ্গীত (১৯৩৯)
১২. A woman Of India (1941)
১৩. ব্রতচারীর মর্মকথা (১৯৪০)
১৪. শ্রীহট্টের লোক সঙ্গীত (১৯৬৬)
১৫. Folk Art and Crafts of Bengal (1990). ইত্যাদি।
প্রবন্ধ: তন্ময়ী চৌধুরী
তথ্য সূত্র:
১. বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী।
২. বাংলা পিডিয়া।
(প্রকাশিত: ৩০- ০৫-২০২১)
There are no reviews yet.