E-Learning Info
Go to content

গমীরা বা গম্ভীরা


বাংলা লোকসংগীতের বিভিন্ন বিশিষ্ট ধারা হিসেবে পরিচিত গম্ভীরা। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে এর প্রচলন অধিক। এটি একধরনের বর্ণনামূলক গান এবং দলগত ভাবে গাওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের  মালদহ জেলার বিভিন্নস্থানে গম্ভীরার মুখোশ পড়ে গানের তালে তালে নাচ করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় "গম্ভীরা' শব্দটি গমীরা নামেও প্রচলিত। আবার অনেকে মনে করেন গমীরা গানটি গম্ভীরা গান থেকে অনেক বেশি পুরনো। কারণ আমাদের বাংলার রাজধানী একসময় গৌড় ছিল। আর্থিক প্রয়োজনে উত্তর অঞ্চলের মানুষ গৌড়কে ঘিরে চলে আসেন। ফলে এই গমীরা উৎসব গম্ভীরা উৎসবে পরিণত হওয়া অসম্ভব নয়। তবে পূজা পদ্ধতি এক হলেও রীতিগত দিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে বৈকি। গম্ভীরা চৈত্রসংক্রান্তিতে শুরু হয়ে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলে। কিন্তু গমীরা চৈত্রসংক্রান্তির আগে থেকে শুরু হয় এবং তারও আগের থেকে মানুষরা  জমায়েত হয়। বিশেষত কৃষক শ্রেণির লোকেরা সেখানে উপস্থিত হন। তাদের সঙ্গে নানা ধরনের আসবাবপত্র থাকে যেমন- শিবমূর্তি, একজন  পুরোহিত, ঢাকি, কাঁসি, ঢুলি ইত্যাদি বাদকেরাও থাকেন। এই বিশিষ্ট দিনের আনন্দানুষ্ঠানকেই আঞ্চলিক ভাষায় গমীরা উৎসব বলে। স্থানীয় কৃষক শ্রেণি গোষ্ঠীরা গ্রামের মঙ্গলার্থে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনশ্রুতি আছে যে সেদিন পূজার শেষে পুরোহিত গ্রামের লোকেদের মাথায় শান্তির জল ছিটিয়ে দেন এবং পরবর্তীতে তারা বাদকের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। শিব প্রতিষ্ঠার পর যে কোন দিন গানটি গাইতে পারেন কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তির দিনই শেষ দিন, নতুন বছর না আসা পর্যন্ত যাওয়া সম্ভবপর নয়।

যারা যারা এ গানের দলের সঙ্গে যুক্ত তারা এই সময় নিরামিষ আহার ভক্ষণ করেন অথবা ফলাহার করেন, আমিষ আহার ভক্ষণ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু সেক্ষেত্রে গাঁজা খাওয়ার বিধান রয়েছে। আবার যারা গানের দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গান করবেন তাদের স্নান নিষেধ। তাদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের নীল সন্ন্যাসী বা গাজন সন্ন্যাসীদের অনেক মিল রয়েছে। গমীরা গানগুলি সাধারণত শিব বিষয়ক হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজ যেহেতু নতুন চিন্তা-চেতনার সমাজ এবং সকলেই শিক্ষার আলোয় উদীয়মান তাই সেই গ্রামবাসীদের মধ্যে গানের বিষয়বস্তুর বিস্তর প্রভাব ঘটেছে। তাই বর্তমান সভ্যতায় শিবের গানের পরিবর্তে প্রেমবিষয়ক গানের প্রচলন সর্বাপেক্ষা বেশি। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে দোতরা, খঞ্জনী, সারিন্দার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-

"শিব নাচোরে শিব সাজে কানা কড়িটা ঝুমুর বাজে।
বাজেকো ঝুমুর বাজেকো তাল, এই গিরিটা জগৎ ভাল।
জগতেও রুনি ঝুনি সোনারে বান্দিনু টুনি।
সোনারে খেরুয়ার বাঁকা অ‍্যাক দুয়ারে ন‍্যাখো হাঁস।'

কিন্তু বর্তমানে গমীরা গানে শিব বিষয়ক কথা গৌণ হয়ে গেছে এবং সামাজিক সুখ দুঃখের বাণীই প্রাধান হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-
"তোর টাকা খাইয়া মুখত বানধিনি
                ডাংগাও তোর গে আই।
এমন বসালেন জামাই আর মুলুকত
                বরগে পালেক নাই।'

এই চার পাঁচ দিন ধরে গ্রামবাসীরা যে অভাব-অভিযোগ সুখ- দুঃখ মজার বিষয় সবকিছুই এই গমীরা গানে প্রকাশ পায়। গম্ভীরা যেমন শিবকে কেন্দ্র করে সব বিষয় সমাধানের জন্য উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু গমীরা গানে তা নয়, সেখানে নিজের বক্তব্য বিষয়টিকে সোজাসুজি বলে যায়। আবার সমাজের ভন্ড নেতাদের ধিক্কার জানাতে তাদের কুণ্ঠাবোধ নেই-

"হামার কথা শুনহে তমরা
চাষী মানুষী ল‍্যাখা পড়া নাই শিখি
তমরা হল‍্যা শহর কলকাতাবাসী
            অঁঅঁঅঁ হঁ হঁ হঁ।
আমরা হলাম চাষী মানসী
যেই বুলাইছ সেই বুল‍্যাছি- আইস্যাছে ভোটের পালা
খ‍্যায়ারা দিমু কাঁচাকলা।'

এতক্ষণ আমরা জানলাম গমীরা সম্বন্ধে এখন আমরা জেনে নিব গম্ভীরা সম্বন্ধে:

মালদহ জেলার সর্বাধিক প্রচলিত লোকনাট‍্যের ধারাটি হলো গম্ভীরা গান। গম্ভীরার ঐতিহ্য ইতিহাস সুপ্রাচীন। যেদিন থেকে মালদা লোকসমাজে গম্ভীরার মন্ডপ করে শিব উৎসব উদযাপন শুরু হয়েছে সেদিন থেকে গম্ভীরা গানের সূচনা হয়েছে। শিব উৎসবকে কেন্দ্র করে মালদহ জেলায় চৈত্রের শেষ থেকে জৈষ্ঠ্য পর্যন্ত গম্ভীরা মণ্ডপ তৈরি করে অনুষ্ঠান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে গম্ভীরা মণ্ডপে প্রচলিত নৃত‍্যগীত অনুষ্ঠিত হয় তারই নাম গম্ভীরা উৎসব বা গম্ভীরার সংগীত। স্থানীয় গ্রামবাসীরা উচ্চারণ করে গমহীরার গান। বুৎপত্তিগতভাবে গম্ভীরার অর্থ বলতে মধ্যযুগের "দেবগৃহ' বা মন্দির বোঝায়, কিন্তু গম্ভীরা পূজা ও উৎসবাদিতে মন্দিরে ছিল না। পরবর্তী পর্বে তার শিব পূজায় রূপান্তরিত হয়েছে। ধর্মঠাকুর বা সূর্যপূজায় যে গামার কাঠের পিঁড়ি ব্যবহার করা হয়, এই গামার শব্দটি হয়তো পরবর্তীতে "গম্ভীরা' শব্দে পরিণত হয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে মূলত এ গম্ভীরা পূজা পালন করা হয়ে থাকে। তাছাড়া কোথাও কোথাও কথিত আছে বাংলায় গম্ভীর অর্থে শিবকে বোঝানো হয়েছে।

তাই শিব গাজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা উত্তর বাংলার মালদা অঞ্চলে গম্ভীরা নামে পরিচিত। নাগর, চাঁই, তুরী, কেওট, নুনিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা আদি পূজক হলেও পরবর্তীকালে অন্য সম্প্রদায়ের নর-নারী তাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই গম্ভীরা উৎসব যে দীর্ঘ দেড় হাজার বছরের প্রাচীন উৎসব তা ইউ-এন-সাঙের বিবরণীতেও দেখা যায়।    

চৈত্রসংক্রান্তি ও তার পূর্বের চারদিনের পূজার মধ্যে রয়েছে ঘটভরা, ছোট তামাসা, বড় তামাসা, আহারা ইত্যাদি। চারদশক আগেও মালদা জেলায় জাতীয় উৎসব বলে প্রচলিত ছিল। গম্ভীরা পূজাকেন্দ্রিক গম্ভীরায় মুখোশ নৃত্য স্থানীয় ভাষার মুখা নাচ হিসাবে পরিচিত। কিন্তু তা গম্ভীরা মুখোশ নৃত‍্যই প্রাচীনতম।
গম্ভীরা মুখোশ নৃত‍্য

গম্ভীরা পূজার সঙ্গে তান্ত্রিক ও ঐন্দ্রজালিক নৃত‍্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। চামুণ্ডা, ঝাঁটাকালী, কালী, নরসিংহীর ইত্যাদির এক একক নৃত‍্য বিশেষ। এখনকার সময়ে কাগজের মণ্ড দিয়েও মুখোশ প্রস্তুত করা যায়। গম্ভীরা মুখোশ নৃত‍্যের মধ্যে চালি নৃত‍্য, ঘোড়া নৃত‍্য, মাতাল, শিব-দুর্গা, রাম-লক্ষ্মণ, সাবিত্রী-সত‍্যবান প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গম্ভীরা গান
শত বছর পূর্বের গম্ভীরা অর্থাৎ শিব পূজার সঙ্গে এখনকার গম্ভীরা গানের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটের আমূল পরিবর্তনের পর লোকসমাজের রুচিতে তা লোকনাট‍্যের রূপ নেয়। গম্ভীরা গানের অনুষ্ঠানের মুখপাদ্, বন্দনা, দ্বৈত, চারইয়ারী, পালাবন্দী, খবর বা রিপোর্ট। পূর্বে ঢোলকই একমাত্র বাদ্য ছিল। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে হারমোনিয়াম, বাঁশি, তবলা ইত্যাদি সহযন্ত্র হিসেবে যুক্ত হয়। গম্ভীরা বিভিন্ন সুরের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে আলকাপ, রামপ্রসাদী বাউল, কীর্তনের ঢঙ্ অন্যতম। এর সুর সৃষ্টিতে অমৃতি গ্রামের লোহারাম খলিফার অবদান অপরিসীম। মালদার লোকায়ত ভাষায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তুতে শিক্ষিত করার আদলে হাস্যরসের মোড়কে গান অনন্য লোকশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোন সন্দেহ নেই। লোকশিক্ষার প্রতিফলনে গম্ভীরার জুড়ি মেলা ভার।
প্রবন্ধ: অপরাজিতা ভট্টাচার্য
তথ্যসূত্র:
.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
২. উইকিপিডিয়া
৩. বাংলাপিডিয়া
(প্রকাশিত ০৯.০৬.২০২১)
There are no reviews yet.
0
0
0
0
0

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content