E-Learning Info
Go to content
গিরিশচন্দ্র ঘোষ (২৮ ফেব্রুয়ারী, ১৮৪৪–৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯১২)
সমাজের সাধারণ মানুষের বোধগম্য নাটক রচনা করে এবং জনসাধারণের প্রবেশাধিকারের জন্য বাংলায় রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়ে বাংলা নাট্য-সাহিত্য জগতে ভাস্বর হয়ে রয়েছেন নাট্যকার তথা অভিনেতাদের গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ। অনেকে তাঁকে ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত অভিনেতা গ্যারিকের সাথে তুলনা করেন কিন্তু গ্যারিক ছিলেন একতরফা অভিনেতা এবং দু-একখানি অসফল নাটক রচনা করেছিলেন। লেখক গিরিশচন্দ্রের মতো একাধারে অতি সাধারণ লোকের উপযোগী নাটক রচনা, রঙ্গমঞ্চ পরিচালনা করা, রঙ্গশালা প্রতিষ্ঠা, অভিনয় শিল্পের শিক্ষাদান এবং নাট্যকোম্পানি বা নাট্যগোষ্টী গড়ার উদ্যম– এক কথায় নট-নাট্য-নাট্য পরিচালনা ইত্যাদির বিভিন্ন দিক দিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের কৃতিত্ব, বাংলা নাট্য জগতে অপর কোনো ব্যক্তিত্ব্যের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। লেখক গিরিশচন্দ্র ঘোষ অবগত ছিলেন যে নাট্যরস প্রদর্শনের মূল ভিত্তি রঙ্গমঞ্চ এবং তিনি উপলব্ধি করতেন সমাজের সাধারণ মানুষের চাহিদা এবং সেই চাহিদা অনুযায়ী ভিন্ন নাটক রচনা করে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাংলা নাট্য-সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তথা বাংলার নাট্যরস পিপাসু জনমানসের নাট্যরস তৃষ্ণা দূরীভূত করতে পেরেছেন।
জন্ম ও বাল্যজীবন
গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ২৮ ফেব্রুয়ারী কলকাতার বাগবাজারে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা নীলকোমল ঘোষ। তিনি ছিলেন তাঁর পিতার অষ্টম সন্তান। বাল্যকালেই মাতা-পিতাকে হারিয়ে তিনি একপ্রকার অভিভাবকহীন হয়ে পরেন ফলে পড়াশোনা না করে বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় করতেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও হুল্লোড় বাজি করে। কিন্তু বংশগত প্রতিভার ফলে মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন এবং সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে নাটকে ভালো অভিনয় করতেন। পিতার সহজাত স্বভাবে বাল্যকাল হতেই অত্যন্ত দামাল, অভিমানী একঘোয়ে স্বভাবের গড়ে ওঠে ছিলেন। অবিনাশ গঙ্গোপাধ্যায় “গিরিশচন্দ্র” গ্রন্থে গিরিশের উপর তাঁর পিতৃ বংশ ও মাতৃ বংশের প্রভাব বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন, "অসাধাণ বুদ্ধিমত্তা, কর্মকুশলতা, লোক-চরিত্র জ্ঞান  ও আত্মনির্ভরতা- এ সমস্তই গিরিশচন্দ্রের পিতৃ-সম্পত্তি। ভাব প্রবণতা, বিদ্যানুরাগ, অধ্যয়নশীলতা ও তর্কশক্তি – গিরিশচন্দ্রের হৃদয় নিহিত ভক্তিবীজ তাঁহার মাতামহ বংশের যৌতুক।'
শৈশব কাল থেকেই গিরিশচন্দ্রের রামায়ণ পাঠের আসর এবং পৌরাণিক গ্রন্থ পাঠের আসরের প্রতি আকর্ষণ, বৈষ্ণব-ভিক্ষুকদের কণ্ঠে নাম-কীর্তন শুনতে শুনতে অল্প বয়সেই তাঁর হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠত এবং ঈশ্বরের প্রতিও তাঁর অগাধ বিশ্বাস জন্মে ছিলো।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
বাল্যকালে লেখক গিরিশচন্দ্র প্রথমে পাইক পাড়া স্কুল, হেয়ার স্কুল এবং পরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু তাঁর পড়াশোনা বেশীদূর এগোয়নি। ১৮৬২ সালে এনট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে সফল হন নি। পরবর্তীতে তিনি ইংরেজি ও হিন্দু পুরাণে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন।
আটিকিনসন টিলকন কোম্পানিতে বুক-কিপারের কাজের মধ্যদিয়ে ২০ বছর বয়সকালে লেখক গিরিশচন্দ্রের কর্মজীবনের সূচনা হয় এবং সেইক্ষণে বন্ধু ব্রজবিহারী সোমের অনুপ্রেরণায় তিনি দেশী ও বিদেশী পাঠে মনোনিবেশ করেন ও প্রচুর পড়াশোনাও করেন। কৈশোর কালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ কিছুকাল হাফ-আখড়াই গানের দলের সঙ্গে যোগদান করেন এবং সেই সুবাদে অভিনয় জগত এবং সঙ্গীতের প্রতি আসক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি বাগবাজারে বন্ধুদের সঙ্গে থিয়েটারের দল তৈরি করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ট্রাজেডিমূলক “শর্মিষ্ঠা” নাটকের গীতিকার রূপে ১৮৬৭ খিস্টাব্দে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাংলা নাট্য-জগতে প্রথম পদার্পণ করেন। দুবছর পর লেখক দীনবন্ধু মিত্রের “সধবার একাদশী” নাটকে অভিনয় করে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেন। বাগবাজারের প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে সপ্তমী পুজার রাতে মঞ্চ তৈরি করে অভিনয়  হয়েছিল এবং অভিনেতা গিরিশচন্দ্র এই নাটকে নিমচাঁদের চরিত্রে অভিনয় করে অনেক প্রশংসা অর্জন করেন। এই নাট্য সংস্থার নামই পরবর্তীকালে ন্যাশনেল থিয়েটার হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গিরিশচন্দ্রের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অভিনয় রজনীতে টিকেট বিক্রির প্রশ্ন নিয়ে তিনি ওই থিয়েটারের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন। কিছুদিন পর যখন গ্রেট ন্যাশনেল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা হয়, গিরিশচন্দ্র সেটাতে যোগ দেন এবং বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয় করেন। পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানে ১০০ টাকা পারিশ্রমিকে ম্যানেজার পদে নিযুক্ত হন এবং নিয়মিত ভাবে নাট্য রচনা শুরু করেন।
গিরিশচন্দ্রের জীবনে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রভাব
শৈশব কালে গিরিশচন্দ্রের ঈশ্বরের প্রতি খুবই অনুরাগ জন্মে ছিলো কিন্তু পরবর্তীকালে ২৬ বছর বয়সে নানা কারণে ঈশ্বরের প্রতি আস্থা হারান এবং ঘোর নাস্তিক, স্বেচ্ছাচারী ও কুখ্যাত মদ্যপ হয়ে ওঠেন। ১৮৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, নটী বিনোদিনীকে নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ কলকাতার স্টার থিয়েটারে “চৈতন্যলীলা” নাটকটি অভিনয় করেন, যে নাটকটি দেখতে স্বয়ং ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্টার থিয়েটারে আসেন এবং মুগ্ধচিত্তে তাদের পরিবাশনা দেখে উৎফুল্ল হয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও নটীবিনোদিনী দাসীকে আশীর্বাদ করেন। পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্র তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত” গ্রন্থে উল্লেখ আছে – কি ভাবে ঠাকুর রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে গিরিশচন্দ্রের নৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্যদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন এবং স্বামীজিকে বন্ধু হিসাবে পান। শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শ তাঁর জীবনকে পুনরায় ঈশ্বর-অনুরাগী করে তোলে। ভক্তিমূলক নাটকই তার উদাহরণ।
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের নাট্যপঞ্জীকে বিষয়বস্তু অনুসারে ছয়টি ভাগে-ভাগ করা হয়েছে
১) গল্প, উপন্যাস ও কাব্যের নাট্যরূপ
কপালকুণ্ডলা (১৮৭৩)
বিষবৃক্ষ (১৮৭৪)
দুর্গেশনন্দিনী (১৮৭৮)
মেঘনাদবধ (১৮৭৭)
হিমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১৮৭৭)
পলাশীর যুদ্ধ (১৮৭৮)
চোখের বালি (১৯০৭)
২) গীতিনাট্য
অকালবোধন (১৮৭৭)
আগমনী (১৮৭৭)
মোহিনীপ্রতিমা (১৮৮২)
স্বপ্নের ফুল (১৮৯৩)
অশ্রুধারা (১৯০১)
৩) ঐতিহাসিক নাটক
আনন্দ রহো (১৮৮১)
চণ্ড (১৮৯০)
কালাপাহাড় (১৮৯১)
ভ্রান্তি (১৯০২)
সৎনাম (১৯০৪)
সিরাজদৌল্লা (১৯০৬)
মীরকাশিম (১৯০৬)
ছত্রপতি শিবাজী (১৯০৭)
অশোক (১৯১১)
৪) পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক নাটক
রাবণবধ (১৮৮১)
অভিমন্যু বধ (১৮৮১)
লক্ষণবর্জন (১৮৮১)
রামের বনবাস (১৮৮২)
সীতাহরণ (১৮৮২)
পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস (১৮৮৩)
দক্ষযজ্ঞ (১৮৮৩)
ধ্রুবচরিত্র (১৮৮৩)
নল দময়ন্তী (১৮৮৩)
শ্রীবৎসচিন্তা (১৮৮৪)
চৈতন্যলীলা (১৮৮৪)
প্রহ্লাদ চরিত্র (১৮৮৪)
বিল্বমঙ্গল (১৮৮৮)
পাণ্ডব গৌরব (১৯০০)
নিত্যানন্দ (১৯১১)
৫) সামাজিক নাটক
প্রফুল্ল (১৮৮৯)
হারানিধি (১৮৯০)
মায়াবসান (১৮৯৭)
বলিদান (১৯০৫)
৬) প্রহসন
ভোটমঙ্গল (১৮৮২)
হীরার ফুল (১৮৮৪)
বেল্লিক বাজার (১৮৮৬)
বড়দিনের বকশিস (১৮৯৩)
সভ্যতার পাণ্ডা (১৮৮৩)
য্যায়সা কা ত্যায়সা (১৯০৬)
শাস্তি কি শান্তি (১৯০৮)
৭) ঐতিহাসিক নাটক
গিরিশচন্দ্রের খ্যাতি ছিলো তাঁর পৌরাণিক নাটকে। পুরাণ অনুশীলনের প্রতি ছিলো তাঁর মানসিক আগ্রহ। পৌরাণিক রচনার পুনরুত্থানই ছিলো তাঁর স্বপ্ন। তিনি ঐতিহাসিক নাটক শুধু জনপ্রিয়তার জন্যই রচনা করেছেন। গিরিশচন্দ্রের প্রথম সার্থক ঐতিহাসিক নাটক “চণ্ড”। এই নাটকের কাহিনি লেখক টডের রাজস্থান থেকে সংগ্রহ করেছেন। মেবার ও রাঠোরের দ্বন্দ্বের বিষয়টি এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু। বিজয়ীর প্রতিহিংসা ও প্রেম নাট্যকারের নিজস্ব সৃষ্টি। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক নাটক “সিরাজদৌল্লা” গিরিশচন্দ্রের একটি মঞ্চ সফল রচনা। গিরিশচন্দ্র এই নাটকের ভূমিকায় লিখেছেন – “আলিবর্দীর সময় হইতে সিরাজদৌল্লার শোচনীয় পরিণাম পর্যন্ত যে সকল স্বার্থ চালিত ঝঞ্ঝাপূর্ণ ঘটনা প্রবাহে বঙ্গ সিংহাসন আলোড়িত হইয়াছিল, তাহার সম্পূর্ণ চিত্র প্রদর্শন ব্যতিত “সিরাজদৌল্লা” নাটক প্রস্ফুটিত হয় না”। সিরাজদৌল্লা চরিত্রকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দান করতে গিয়ে লেখক চরিত্রকে অখণ্ড রূপ দানের প্রয়াস করেছেন। “সিরাজদৌল্লা” রচনা করিবার পূর্বে গিরিশচন্দ্র বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে বাংলার এই হতভাগ্য নবাব সন্দেহে দেশি ও বিদেশি যাবতীয় ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধান করেছিলেন”। (অজিতকুমার ঘোষ – বাংলা নাটকের ইতিহাস, কলিকাতা- ১৯৭৬, পৃঃ ২৩২) নাট্যকার সিরাজ চরিত্র যেমন বীর রূপে প্রতিভাত করেছেন, তেমনি কাল্পনিক চরিত্রেরও সংযোজন করেছেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের চোখে কলুষিত সিরাজ আমাদের দেশীয় ঐতিহাসিকদের দ্বারা দেশভক্তের মূর্ত প্রতীক রূপে চিত্রিত হয়েছিলেন এবং স্বাদেশিকতায় মূর্তীমান বিগ্রহ রূপে সিরাজ চরিত্রটি চিত্রায়িত করেছেন গিরিশচন্দ্র। রাজনৈতিক প্রজাপালক সিরাজের চরিত্র উপস্থাপনায় প্রয়াসী ছিলেন গিরিশচন্দ্র। তাই নাট্যকার সিরাজের মুখে এই সংলাপটি দিয়েছেন:
                                       ‘রাজকার্য নহে স্বেচ্ছাচার,
                                       নবাব রাজার ভৃত্য, প্রভু প্রজাগণে
                                       প্রজার মঙ্গলকার্য সতত সাধন,
                                       নবাবের উদ্দেশ্য জীবন।'
নবাবের এই নিস্পৃহ প্রজাবৎসল রূপ সাধারণ জনমানসের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিলো। রাঙা-মুখো সাহেবরা (ইংরেজ) যে জাতীর শত্রু এবং তাদেরকে আমাদের যে বর্জন করা উচিত- তা তখনকার জনমানসে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ফুটিয়ে তুলেছেন নবাব সিরাজের এই সংলাপের মাধ্যমে:
                                     ‘শত্রু জ্ঞানে ফিরিঙ্গিরে কর পরিহার;
                                      বিদেশী ফিরিঙ্গি কভু নহে আপনার,
                                      স্বার্থপর চাহে মাত্র রাজ্য অধিকার।
                                     হও সবে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত।'
মাতৃভূমিকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার জন্য সিরাজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই উক্তিতে স্পষ্ট হয়- “না মীরমদন, জন্মভূমির আশা বিলুপ্ত। যদি কখনো সুদিন হয়, যদি কখনো জন্মভূমির অনুরাগে হিন্দু মুসলমান ধর্ম বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে, যদি ঈর্ষা, বিদ্বেষ, নীচ প্রবৃত্তি দলিত করে স্বদেশবাসীর অপমানে আপনার অপমান জ্ঞান করে, যদি সাধারণ শত্রুর প্রতি একতায় খড়্গ হস্ত হয়,- দুর্দ্দম ফিরিঙ্গি দমন তখন সম্ভব; নচেৎ অভাগিনী বঙ্গমাতার পরাধীনতা অনিবার্য।“(দ্বিতীয় অঙ্ক\ষষ্ঠ দৃশ্য) নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের “সিরাজদৌল্লা” নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ায় জনমানসের মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় এবং প্রচণ্ড আলোড়ন উত্থাপিত হয়, যা ব্রিটিশ সরকারকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তাই জাতীয়তাবাদের প্রচারের জন্য ১৯১১সালের ৮ই জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার এই নাটকটির অভিনয় ও প্রচার বন্ধ করে দেয়।
 
নাট্যকার “সিরাজদৌল্লা” নাটকের অনুরূপ “মীরকাশিম” নাটকটিতে বঙ্গভঙ্গ যুগের ব্রিটিশ বিদ্বেষ, স্বদেশী গ্রহণ, সর্বতোপরি বিদেশি পরিহার, হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ভুলে একতা প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ঐতিহাসিক এই নাটকটিতে নাট্যকার এই মীরকাশিমকে জাতীয় বীর চরিত্র রূপে তুলে ধরতে প্রয়াস করেছেন ও আংশিক ভাবে সার্থক হয়েছেন এবং ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার বর্ণনা করেছেন। সিরাজ চরিত্রের তুলনায় মীরকাশিমের চারিত্রিক বলিষ্ঠতা অনেক দৃঢ় তাই জাতীয়তাবোধকে প্রস্ফুটিত করে তোলার জন্য নাট্যকার মীরকাশিম চরিত্রের বলিষ্ঠতার দিকটি চিত্রায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

১৯০৭ সালে “ছত্রপতি শিবাজী” নাটকে নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের পরিপক্ক ঐতিহাসিক মননের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। নাট্যকার এখানে সত্যচরণ শাস্ত্রীর “ছত্রপতি শিবাজী” গ্রন্থটির অনুসরণে নাটকটি রচনা করেন। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র জাতীয় ভাবধারার প্রতি যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পোষণ করতেন, তার ছায়া শিবাজী চরিত্রের ঐতিহাসিক দিকটির মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ফুটে ওঠে। তাঁর সেই আদর্শ ধর্মভাবাশ্রিত জাতীয়তার সাধনা। এই নাটকে নাট্যকার ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের জাতীয় বীরের চরিত্রগুলি সংগ্রহ করে ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের সাধনা করেছেন। গিরিশচন্দ্র স্বদেশপ্রেমের অন্ধ-ভাবাবেগকে স্বীয় প্রবল ভক্তি-ভাবের সঙ্গে একাকার করে ফেলেন। তাই জাতীয় ঐক্য বিস্মৃত হয়ে জাতীয় বীরের খোঁজ করতে গিয়ে শিবাজী চরিত্রটিকে সাম্প্রদায়িক চরিত্র রূপে তুলে ধরেছেন। তাই ইতিহাস- বর্ণিত শিবাজীর যে একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ছিলো, নাট্যকার তা বজায় রাখতে পারেন নি।                                                            

গিরিশচন্দ্র “অশোক” নাটকটিতে যেমন তাঁর ইতিহাস-নিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি দিয়েছেন তাঁর নিজস্ব কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিচয়। ঐতিহাসিক নাটক হলেও “অশোক” নাটকটিতে ধর্মীয় চিন্তা ধারার প্রাধান্যতা লক্ষ্য করা যায়। এই নাটকে অশোক চরিত্রের দুটি দিক হলো- চণ্ডাশোক ও ধর্মাশোক এবং দুটি রূপই লেখকের দ্বারা সমভাবে চিত্রায়িত। নাটকটির মুখ্য চরিত্র ঐতিহাসিক হলেও নাট্যকার ঐতিহাসিকতা সুনিপুণ ভাবে চিত্রায়িত করতে সক্ষম হন নি।  
৮) পৌরাণিক নাটক
নাট্যকার গিরিশচন্দ্র কয়েকটি গীতিকাব্য “আগমনী” ও “অকালবোধন” (১৮৭৭), “দোললীলা”, “মোহিনীপ্রতিমা” রচনা ও অভিনয়ের দ্বারা দর্শক মণ্ডলীর চিত্তাকর্ষণ করলেও পরবর্তীকালে উপযুক্ত নাট্যগুণ এবং সাহিত্য রসের অভাবের ফলে এগুলি আর মঞ্চস্থ হয় নি। উনিশ শতকের শেষ ভাগে নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের মুখ্য সাফল্য আসে তাঁর ভক্তি রসাশ্রিত পৌরাণিক নাটকের মাধ্যমে। নাট্যকার হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের জন্য আন্তরিক আবেগ প্রসূত জীবনাদর্শ ও ভক্তি রসাশ্রিত ভাবকে গ্রহন করেছিলেন তাঁর পৌরাণিক নাটকে। ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভক্তি ভাবের আতিশয্যকে অবলম্বন করে যুক্তিবাদী নাস্তিক গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকে জোয়ার এনেছিলেন। নাট্যকার তখনকার বাঙালির নিতান্ত বাস্তব জীবন, যে জীবন ধারায় প্রগতিশীলতা ও সংস্কারানুগত্য পরস্পর স্থান পেয়েছে, মুক্ত বুদ্ধির সঙ্গে ধর্মের প্রতি আনুগত্য সেই জীবনাদর্শের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর পৌরাণিক নাটকে। এই নাটকগুলির মধ্যদিয়ে প্রচার করেছেন হিন্দু ধর্মের জাতীয়তার মন্ত্র- যা তৎকালীন নব্য হিন্দুদের ধর্মীয় চেতনা ভীষণ ভাবে উদ্দীপিত করেছিল। নাট্যকার বাঙালির অন্তরের ধর্মীয় ভাবধারা অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই পৌরাণিক নাটকে সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র স্বয়ং স্বীকার করেছেন –“ জাতীয় বৃত্তি পরিচালিত ব্যতীত কবিতা বা নাটক জাতীয় হিসাবে হিতকর হয় না। ভারতবর্ষের জাতীয়তার মর্মে ধর্ম। দেশহিতৈষণার প্রভৃতি যত প্রকার কথা আছে তা হতে কেহ ভারতের মর্ম স্পর্শ করিতে পারিবে না। ভারত ধর্মপ্রাণ যাহারা লাঙ্গল ধরিয়া চৈত্রের রৌদ্রে হাল সঞ্চালন করিতেছে তাহারাও কৃষ্ণ নামে আকৃষ্ট। যদি নাটকের সার্বজনিক হওয়া প্রয়োজন হয়, তবে কৃষ্ণ নামেই হইবে। হিন্দুস্থানের মর্মে মর্মে ধর্ম। মর্মাশ্রয় করিয়া নাটক লিখিতে হইলে ধর্মাশ্রয় করিতে হইবে। এই মর্মাশ্রিত ধর্ম বিদেশীর ভাষণ তরবারি দিয়া উচ্ছেদ হয় নাই।' (গিরিশচন্দ্র রচিত পৌরাণিক নাটক ‘প্রবন্ধ’, রঙ্গালয় পত্রিকা, ৩০শে চৈত্র, ১৩০৭ )
 
গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক উৎকৃষ্ট নাটকগুলির মধ্যে ছিলো “অভিমন্যু বধ”(১৮৮১), “চৈতন্যলীলা”(১৮৮৪), “বিল্বমঙ্গল”(১৮৮৮), “জনা”(১৮৯৪), “পাণ্ডবগৌরব”(১৯০০) এক সময় বাংলা ও বাংলার বাইরে সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছে। নাট্যকারের মঞ্চ সফল নাটক “পাণ্ডব গৌরব”। নাটকটির মুখ্য বিষয়বস্তু হলো উর্বশীর শাপমোচন, যার ফলস্বরূপ পাণ্ডবদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিরোধ। স্মরণাগতকে আশ্রয় ও রক্ষা করার অপরাধে পাণ্ডবদের সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব। পরিশেষে দৈবানুগত্যে যার সমাপ্তি ঘটে। এই নিরাশ্রয়কে আশ্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ – সনাতন হিন্দু ধর্মাদর্শের পরম্পরাগত ধারা এবং হিন্দু ধর্মের পুরাতন সংস্কার যা আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। সেই সংস্কারকেই গিরিশচন্দ্র তাঁর নাটকে তুলে ধরেছেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণের বিরোধ সত্ত্বেও পাণ্ডবেরা চিরাচরিত ভক্তিধর্ম বিস্মৃত হন নি, যা তাঁদের ধর্মনীতিকেই প্রতিষ্ঠা করেছে। সাধারণ জনমনে পৌরাণিক নাটকের ভক্তিভাবকে অত্যধিক হৃদয়গ্রাহী সংলাপের মাধ্যমে কি ভাবে লোকের মর্মস্পর্শ করতে হয়, তার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন। তাই তিনি মাইকেল মধুসূদনের ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দকে কিছুটা পরিবর্তিত করে নতুন এক ছন্দের উদ্ভাবন করেন যা “গৈরিশ ছন্দ” নামে পরিচিত।

গিরিশচন্দ্রের “বিল্বমঙ্গল” নাটকটি ভক্তিমূলক নাটক গুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়, যার প্রশংসা  স্বামী বিবেকানন্দও করেছেন। “বিল্বমঙ্গল” নাটকটি ধর্মপ্রাণ বাঙালির কাছে বিশেষ চিত্তাকর্ষক হয়েছিলো। “ভক্তমালা” গ্রন্থ থেকে এই নাটকের কাহিনি গৃহীত। ধর্মতত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়েই এই নাটকটি রচিত। প্রেম ও বৈরাগ্যমূলক নাট্যরূপে চিত্রিত হয়েছে এই নাটকটি। প্রেমপুজ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণই “বিল্বমঙ্গল” নাটকের আরাধ্য দেবতা।
                                           
“জনা” নাটকটিও গিরিশচন্দ্রের উৎকৃষ্ট পৌরাণিক নাটকের মধ্যে একটি। আজ অবধি “জনা” নাটকের জনপ্রিয়তা কিছু অংশেও ক্ষুন্ন হয় নি। “জনা” নাটকে জনার মাতৃহৃদয়ের কমনীয়তা ও ক্ষাত্র রমনী সুলভ দৃঢ়তা-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অঙ্কনে তিনি বিশেষ সফলতা অর্জন করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদনের “বীরাঙ্গনা” কাব্য, জৈমিনি ভারত ও কাশীদাস বিরচিত “মহাভারত” থেকে গিরিশচন্দ্র এই নাটকের বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেছেন। পুত্রশোকাতুরা মাতৃহৃদয়ের আকুল আর্তি সত্যিই হৃদয়বিদারক। উক্তিটি হলো:                 
                                          "দূরে- দূরে- ভীষণ  প্রান্তরে-
                                          মরুভূমে- দুরন্ত  শ্মশানে
                                           হেথা  তোর  নাহি  স্থান!
                                          দুর্গম  কান্তারে,  তুষার-মাঝারে,
                                          পর্বতশিখরে  চল ।
                                          চল  পাপ  রাজ্য  ত্যাজি,
                                          পতি  তোর  পুত্রঘাতী  অরাতির  সখা ।
                                          চল  পুত্রশোকাতুরা-
                                         চল  বালুময়  বেলায়  বসিয়ে
                                          দেখিবি  বাড়বানল ।
                                          চল  যথা  আগ্নেয়  ভূধর,
                                          নিরন্তর  গভীর  হুংকারে
                                          উগারে  অনলরাশি ।
                                          চল,  যথা  বাসুকির  শ্বাসে
                                          দগ্ধ  দিকদিগন্তর ।
                                          চল  যথা  ঘোর  তমোমাঝে,
                                          খেলে  নীল  প্রলয়-অনল
                                         লকলকি  বিশ্বাগ্রাসী  জিহ্বা ।
                                         দূরে- দূরে-
                                         হেথা  তোর  নাহি স্থান,  পুত্রশোকাতুরা।' (জনা,  ৪র্থ  অঙ্ক,  ৫ম  গর্ভাঙ্ক )                                                                         
৮. সামাজিক নাটক
যে যুগে গিরিশচন্দ্র জন্মে ছিলেন, তখনকার সময়ে ধর্ম ও রাজনৈতিক চেতনায় সমাজে ও সাহিত্যে সব দিক দিয়েই প্রাচীন বিশ্বাসের প্রতি শিথিলতা দেখা দেয়। কিন্তু মনের দিক দিয়ে লেখক ছিলেন পুরাতনপন্থী। আবার বাহ্যিক প্রভাবকেও তিনি সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নি। কাজেই তিনি প্রাচীন এবং নবীনের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। লেখক গিরিশচন্দ্রের সামাজিক অভিজ্ঞতা অল্প মাত্রায়ই ছিলো, তাই উপলব্ধির মাধ্যমে ভাবাবেগপূর্ণ নাটক গড়তে গিয়ে তিনি সামাজিক নাটক রচনা করতে অক্ষম হন। ইবসেন, শেক্সপীয়রের মতো নাট্যকার গিরিশচন্দ্র অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি তাই এই শ্রেণীর নাটকে তিনি সফল হতে পারেন নি।

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের জনপ্রিয় মঞ্চ সফল  নাটক “প্রফুল্ল”। এই নাটকটি  ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়। নাটকের অভিনয় সম্বন্ধে তৎকালীন “ভারতী” পত্রিকা উচ্ছসিত প্রশংসা করে প্রকাশ করে।                 
 
একটি পারিবারিক কাহিনি অবলম্বনে নাটকটি রচিত। নাটকে যে বিবাদ চিত্রিত হয়েছে তা পারিবারিক হয়েও সামাজিক। তদুপরি নাটকটিতে সমাজের ভিন্ন স্তরের মানুষের জীবন যাত্রার পরিচিতি চিত্রিত হয়েছে। যেমন – শুঁড়িখানার চারপাশে মদোন্মত্ত মাতালদের কার্য কীর্তি, নানা ধরনের দালাল, ঘোষখোর, জুয়াচোর, পুলিশের কার্যকলাপ, ডাক্তারের শয়তানি, কুটিল লোকের কু-চক্রান্ত প্রভৃতি। নাটকটির নাম “প্রফুল্ল” হলেও মুখ্য চরিত্র হল যোগেশ। যোগেশের অবনতি, বিশৃঙ্খল ও দুর্ভাগ্যজনকপূর্ণ ঘটনা নাট্যকার সমবেদনার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। ব্যাংক ফেলের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যোগেশের মদ্যপ হয়ে যাওয়া এবং সেই সুযোগে রমেশের কু-চক্রান্তে পর পর তার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া-  এই নাটকে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র তা যথার্থ রূপে চিত্রায়িত করেছেন। এই নাটকের আদর্শ চরিত্র প্রফুল্ল, তার চরিত্রের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো সরলতা, স্নেহশীলতা ও কোমলতা। তার চরিত্রের এই পরিবর্তন গুলি এসেছে নাটকের শেষভাগে। যখন রমেশের সমস্ত কুটিল চক্রান্ত সে ধরে ফেলে। প্রফুল্লের  আত্মত্যাগের মধ্যদিয়েই নাটকটির সমাপ্তি ঘটে।
 
গিরিশচন্দ্রের একটি মিলনান্ত সামাজিক নাটক “হারানিধি” (১৮৯০)। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর স্টার থিয়েটারে নাটকটি পরিবেশিত হয়। নাটকটিতে প্রেমের জয় ঘোষিত হয়েছে। বিশ্বাসভঙ্গকারী বন্ধুর কথাই নাটকের মূল বিষয়বস্তু। নাটকে নব, কাদম্বিনী, অঘোর চরিত্রগুলি বর্ননাও নাট্যকার নিপুণভাবে করেছেন। এদের মধ্যে অঘোর চরিত্রটি উল্লেখনীয় কৌতুক রসাশ্রিত চরিত্র।
 
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের “মায়াবসান” নাটকটি সর্বপ্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর স্টার থিয়েটারে। বাঙালির পারিবারিক জীবনই ছিলো এই বিয়োগান্ত নাটকের বুনিয়াদ। কালীকিঙ্কর চরিত্রের মধ্যদিয়ে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র নাটকটিতে নিঃস্বার্থ কর্মের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। নাটকটি করুণ রসাশ্রিত হলেও সম্পূর্ণ ট্রাজেডি নয়।
 
১৯৫০ সালে সদানন্দ মিত্রের অনুরোধে বাংলার পণপ্রথার বিরুদ্ধে জনগণকে জাগ্রত করার জন্য নাট্যকার গিরিশচন্দ্র “বলিদান” নাটকটি রচনা করেন। আমাদের বাঙালি সমাজে কন্যারা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের পাত্রী আবার পিতৃগৃহে গলগ্রহ- নাট্যকার এই সামাজিক কুপ্রথা, পণপ্রথার বিরুদ্ধে “বলিদান” নাটকটিতে সংবেদনশীলতার সহিত ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটকের কিশোর চরিত্রটি কু-সংস্কারমুক্ত উন্নত চিন্তাশীল চরিত্র। কিশোরের বোন ভাবিনীর বিয়েতে কিশোরের বাবা ঘনশ্যাম প্রচুর টাকা খরচ করায়, পুত্রের বিয়েতে সেই টাকা উশুল করাতে চাইলে কিশোর বলে-  "ভাবিনীর শ্বশুররা পীড়ন করেছে বলেই আপনি আর একজনকে পীড়ন করবেন? এই দোষে সমাজ উৎসন্ন  যাচ্ছে , বড় ঘরে দেনদার হচ্ছে, গৃহস্থ ফকির হচ্ছে, বালিকা হত্যা হচ্ছে- কন্যার জন্ম ঘোর অমঙ্গল বলে গন্য হচ্ছে- এই কন্যাদায়ে দেশের সর্বনাশ হচ্ছে। বাবা আপনি আদর্শ দেখিয়ে লোককে শিক্ষা দেন যে পুত্রের বিবাহ, আসুরিক সন্তান বিক্রয় নয়।'
 
অভিষ্ট বিষয়বস্তুর গুরুত্ত্ব ও প্রচারের দিকদিয়ে নাটকটি বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক। তাই বাংলার জনপ্রিয় নাটকগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান গ্রহন করেছে এই নাটক। ১৯০৫সালে ১৯শে এপ্রিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকায় গিরিশচন্দ্রের “বলিদান” নাটকটি মিনার্ভায় অভিনীত হওয়ার পর প্রভূত প্রশংসা লাভ করেন। সামাজিক নাটকে গিরিশচন্দ্রের বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। মঞ্চ উপস্থাপনাতেও নাটকগুলি যথেষ্ট সফলতা পেয়েছে। তৎকালীন সামাজিক সমস্যাগুলির বাস্তব রূপ চিত্রায়নেও নাট্যকার ছিলেন বিদগ্ধ। তবে সামাজিক নাটকগুলিতে অতিনাটকীয়তা, অত্যধিক আদর্শনিষ্ঠতা, টাইপধর্মী চরিত্রের জন্য নাটকগুলির শিল্পমূল্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে।
 
৯) প্রহসন
নাট্যকার গিরিশচন্দ্র রঙ্গব্যঙ্গের নাটিকা অর্থাৎ প্রহসনধর্মী নাটক যেমন- “সপ্তমীতে বিসর্জন”, “বেল্লিকবাজার”, “বড়দিনের বখশিস”, “সভ্যতার পাণ্ডা”, “য্যায়সা কা ত্যায়সা” প্রভৃতি রচনা করেন এবং এই নাটকগুলি তৎকালীন যুগে বেশ জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনীত হয়। নাট্যকার এই কৌতুক রসাশ্রিত নাটক গুলি বিশেষভাবে রঙ্গমঞ্চের উপর দৃষ্টি রেখেই রচিত হয়েছিলো। নব্য-সভ্যতার নূন্যতম রুচিবোধ, চারিত্রিক অধোগতি, অসামাজিক কার্যকলাপ, উন্মার্গগামী চরিত্র নাট্যকারের প্রহসন গুলির প্রধান ভিত্তি। “সপ্তমীতে বিসর্জন” প্রহসনটি আলোচনা করতে গিয়ে অবিনাশ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন – “ইংরাজীতে যাহাকে  Extravaganza  বলে ইহা সেই প্রকৃতির। ইহা সম্বন্ধে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সামাজিক নাটক বাস্তব সংসারের ঘটনা ও চরিত্র লইয়া রচিত হয়, এইরূপ বিদ্রূপাত্মক প্রহসনের  গল্প এবং চরিত্র সম্ভব রাজ্যের প্রান্তসীমা হইতে আহৃত হইয়া থাকে-  ইহার সকলই উচ্ছৃঙ্খল।“(গিরিশচন্দ্র, পৃঃ ৩৫০)। তবে তুলনামূলক ভাবে “আবুহোসেন” গীতিনাট্যটি (প্রহসন) অনেকাংশে শ্রেয়।
 
“য্যায়সা কা ত্যায়সা”- ফ্রান্সের প্রহসন লেখক মলিয়ের রচিত ‘লাভ ইজ দি বেস্ট ডক্টর’ (১৯০৭) অনুকরণে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র “য্যায়সা কা ত্যায়সা” নাটকটি রচনা করেন। তৎকালীন কৌতুকপ্রিয় দর্শকদের রুচিবোধ অনুসারে নাট্যকার নাটকটিতে কৌতুকরস উজাড় করে দেন। বরপক্ষের অযৌক্তিক যৌতুক আবদার এবং পণপ্রথার নিষ্ঠুরতার দিকটিও তিনি এই রচনা আলোকপাত করেছেন। বিদেশী দ্রব্যের ‘বয়কট’ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো অর্থনৈতিক উন্নতি এবং স্বদেশী শিল্পের পুনরুত্থান ও জাতিকে আত্মনির্ভর ও স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য নাটকটিতে বঙ্গনারীদের কণ্ঠে গিরিশচন্দ্র স্বাদেশিক অনুভূতির সুর শুনিয়েছেন-
                                                “কাঙ্গালী বাঙ্গালীর মেয়ে       কাজ কি বিবিয়ানা বাই,
                                                বুকে পিঠে সেঁটে ধরে,          জ্যাকেট বড়ির মুখে ছাই।
                                                               এখন চলছে কসতা পেড়ে শাড়ী
                                                                  শাঁখার আদর বাড়ী বাড়ী
                                      ভেঙে কাচের বাসন, কাচের চুড়ি, ঘুচেছে কাচের বালাই।“
এই গানে যেমন স্বাদেশিক অনুভূতি রয়েছে, তেমনি রয়েছে আধুনিক বঙ্গ রমনীদের বেশ-ভূষা পরিধানের প্রতি প্রতিকূল মনোভাব মেয়ে পর হয়ে যাবে এবং তৎসঙ্গে যৌতুকেরও ভয়। আবার মেয়ে বড় হচ্ছে- সমাজে নানান কথা উঠছে, তবুও হারাধন মেয়ের বিয়ে দিতে অসম্মত। তখনকার দিনের সমাজের এই রূপ বর্নিত হয়েছে হারাধনের এই উক্তিতে-  “বেটাদের বায়না কত- দশ হাজার নগদ, বিশ হাজার গয়না, হীরে মানিক সোনা রূপোর খাট বিছানা, আবার নিজের মেয়েটি; চোর দায়ে ধরা পড়েছি- সাদি নেই দেঙ্গা। আমার মেয়ে বড় হুয়া তো কার বাবার কেয়া হুয়া ! বে’ কভি নেহি দেঙ্গা ! জাত জাঙ্গা? – জাঙ্গা জাঙ্গা ! বটে রে দেবো ! বেটারা লুচি খাবেন? আর আমার সঙ্গে গাঁট ছড়া বেঁধে নবাবের বেটা নবাব জামাই বাড়ী নিয়ে যাবেন, -আবার দান সামগ্রী দাও, টাকা দাও – সে পাত্র আমি নই, সে পাত্র আমি নই।' (প্রথম দৃশ্য)
পাত্রপক্ষের অস্বাভাবিক যৌতুক স্বরূপ কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতারা যে কন্যা সম্প্রদানে অক্ষম ছিলেন- গিরিশচন্দ্র বাঙালি সমাজের সেই অমানবিকরূপ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এই প্রহসনধর্মী নাটকটির মাধ্যমে।
 
‘শাস্তি কি শান্তি’- ১৯০৮সালে “শাস্তি কি শান্তি” নাটকটিতে নাট্যকার তৎকালীন মধ্যবিত্ত (১৯০৮) বাঙালি হিন্দু সমাজে বিধবার প্রেম বা বিবাহকে সামাজিক জীবনে যে অভিশপ্ত বলেই গণ্য করা হত – সেই দিকটিকেই নাট্যকার গিরিশচন্দ্র এই নাটকে চিত্রিত করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরাসর স্মৃতির বিধান অনুযায়ী কলিযুগে বিধবার বিবাহকে শাস্ত্র সংগত বলে যুক্তি দিয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজ বিদ্যাসাগরের এই যুক্তিকে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র তাঁর “শাস্তি কি শান্তি” নাটকে বাঙালি সমাজের সেই চিত্রটি তুলে ধরেন।
সুকুমার সেন গিরিশচন্দ্রের নাটকের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন-  
              ক) ভক্তিভাব ও পৌরাণিক আদর্শের আনুগত্য।
               খ) নাটকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শিক্ষাদান।
               গ) তাঁর নাটক সাধারণ দর্শককে তৃপ্ত করলেও নাট্যরসিকদের কাছে সেগুলির আবেদন উল্লেখযোগ্য নয়।
               ঘ) তাঁর নাটকে অবতার কল্পপুরুষ বা আদর্শ চরিত্র থাকবে- যারা নাট্যকারের উদ্দেশ্যকে পরিস্ফুট করবে।
               ঙ) ঘটনার অত্যধিক ভীড়।
               চ) কোলকাতার সাধারণ গৃহস্থঘরের ছবিই তাঁর নাটকের প্রধান উপজীব্য।
                                                                (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস- দ্বিতীয় খণ্ড- ১৩৮৬, পৃঃ- ৩৫৫-৫৬)
মৃত্যু
লেখক তথা নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারী কলকাতায় পরলোক গমন করেন।                                              
প্রবন্ধ: তনুশ্রী চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ড. দেবেশ কুমার আচার্য
৩. গিরিশচন্দ্র, অবিনাশ গঙ্গোপাধ্যায়
৪. বাংলা নাটকের ইতিহাস, অজিতকুমার ঘোষ
৫. গিরিশচন্দ্র রচিত পৌরাণিক নাটক ‘প্রবন্ধ’, রঙ্গালয় পত্রিকা, ৩০শে চৈত্র, ১৩০৭
৬. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, সুকুমার সেন
(প্রকাশিত: ২৫.০৫.২০২১)
There are no reviews yet.
0
0
0
0
0

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content