ঘাটু গান
পূর্ববাংলার ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চল, ত্রিপুরা জেলার উত্তরাঞ্চল এবং শ্রীহট্ট জেলার পশ্চিমাঞ্চলে একটি বালককে বালিকা বেশে সাজিয়ে এক শ্রেণির গান করা হয়, এই ধরনের গানকে ঘাটুগান বলে। অঞ্চলভেদে "ঘাটু' শব্দটির উচ্চারণগত ভিন্নতা লক্ষ্য করা হয়। যেমন এই শব্দটি ঘাঁটু, ঘেটু, ঘেঁটু, গেণ্টু, ঘাডু, গাড়ু, গাঁটু প্রভৃতি বলা হয়ে থাকে। যেমন নেত্রকোণা নামক অঞ্চলে এটি "গাডু' নামেই সুপরিচিত। কিন্তু বর্তমান সমাজ যেহেতু নিরক্ষরতা দূরীকরণে সার্থক হয়েছে তাই তাকে ঘাটু বলা হয়। কিন্তু সুনামগঞ্জ অঞ্চলে একে "ঘাডু' বলে।
ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ঘাটু গানের প্রচলন হয়। গবেষকদের ধারণা শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে মগ্ন কোন একজন ভক্ত রাধা সেজে শ্রীকৃষ্ণের অপেক্ষা করছিল, সেখানে অনেক ভক্ত গড়ে ওঠে। তখনই ভক্তদের মধ্য থেকে ছেলে শিশুদের রাধার সখী সাজিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে। বিরহগীত পরিবেশন হয় এবং এভাবেই ঘাটু গানের প্রচলন হয়। বর্ষাকালেই সাধারণত এই গানের প্রচলন বেশি দেখা যায়। প্রচলিত আছে, নৌকার পাটাতনের উপর ঘাটু গানের একটি জমজমাট আসর বসে। পরে এই নৌকা বিভিন্ন ঘাটে ভিড়ে গান পরিবেশিত হয়। আমরা ঘাটু গানের দুটি অংশ লক্ষ্য করতে পারি। একটি অংশে বালককে বালিকা বেশে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। আরেকটি অংশে সাধারণ জনতা এই ধরনের সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এই ধরনের গানে রাধাকৃষ্ণের বন্দনা করা হয়। কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুর শুনতে পেয়ে শ্রী রাধিকা যখন যমুনার ঘাটে গিয়ে নৌকায় উঠলেন, তখন জলের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান এবং অপলক দৃষ্টিতে রাধিকা জলের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং কখন যে তাঁর কলসী জলে ভেসে যায় তার একেবারে খেয়াল নেই। সেজন্য নদীমাতৃক স্থান বাংলাদেশই তার উপযুক্ত। একটি বিশিষ্ট উদাহরণ দেওয়া হল যা থেকে বোঝা যায় শ্রীরাধিকার মন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির শব্দে কতটুকু বিচলিত-
"আমার মনের বেদনা
সে বিনে কেউ জানে না
কালা যখন বাজায় বাঁশি
তখন আমি রান্তে বসি
বাঁশির সুরে মন উদাসী
ঘরে থাকতে পারি না
আমার মনের বেদনা
সে বিনে কেউ জানে না।'
ঘাটু গানগুলির মধ্যে আবার মালজুরা গানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো গানে আবার কবিগানের ছোঁয়াও দেখা যায়। ঘাটুগান গুলিতে মূলত প্রেম রসাত্মক গানের সমন্বয় দেখা যায়। ঘাটু গানের সাহায্য করতেন স্থানীয় বাসীন্দা, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় "মরাধার' বলা হয়। তিনি গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করতেন এবং অন্যদের এই ঘাটু গানের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর দিতে হতো। এক কথায় বলা যায় কবিগানের আদলে গড়া এই ঘাটুগান মানুষের মন আকর্ষণ করে।
ঘাটু গানের প্রচলন কবে সে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু লোকসংস্কৃতিবিদরা মনে করেন বৃহত্তর বাংলাদেশে সিলেটের আজমিরীগঞ্জের উদয় আচার্য ছিলেন ঘাটু গানের অন্যতম প্রবর্তক এবং তাঁর মাধ্যমে ঘাটু গানের প্রবর্তন হয়। তখন ঘাটু গান মূলত পূজা-পার্বণের একটি পবিত্র মাধ্যম হিসাবে গান করা হতো, কিন্তু আচার্যের মৃত্যুর আর্থিক অবস্থা উন্নতি করার জন্য গানটিকে বাণিজ্যিক করে তাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হয়। তারপর থেকে ঘাটু গানে আদিরসাত্মক প্রেম ভাবনামূলক কথাবার্তা চালু করে বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করা হয়। ফলে ঘাটুগান তার আগের ধরন ছেড়ে অন্য ধরনে চলে আসে। যার দরুন এই গান লোকমুখে অনেক প্রচার লাভ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় -
"ভাইসাব আমার জলে ভাসা
সাবান আইন্না দিলায়না
সাবান আছে ঘরে পরে তার পরোয়া কেবা করে'
অথবা
"আইও বন্ধু বইও পাশে মুখে দিয়ে পান
দেইখ্যা যাওরে ঘটুর নাচন পূর্ণিমারও চান।'
অনেকে মনে করেন "ঘাট' শব্দটি থেকে ঘাটু গানের উৎপত্তি, কারণ এই ধরনের গান পরিবেশিত হয় ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে। তাই অধিকাংশ লোক তাকে ঘাটের গানও বলে। ঘাটু গানের প্রধান হিসেবে থাকে একটি সুন্দর কিশোর, তাকেই বলা হয় ঘাটু। সে-ই মেয়েলি সাজ-পোশাক পরিধান করে গান করে এবং নাচ করে সকলের মনোরঞ্জন করে। এই ঘাটুর সঙ্গে থাকে এক দোহার সম্প্রদায় এবং ঘাটুর সঙ্গে সকলে মিলে দোহারে অংশগ্রহণ করে। ঘাটুগানটি মূলত প্রণয়মূলক গান।
ঘাটু দলের যিনি মূল গায়েন তাঁকে "সরকার' বলা হয়। গানটিতে সহকারী বাদ্যযন্ত্র হিসাবে থাকতো ঢোল, তবলা, বেহালা, সারিন্দা, মন্দিরা, বাঁশি, করতাল, এবং হারমোনিয়াম। এই গান প্রধানত ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল, কুমিল্লা জেলার উত্তরাঞ্চল, সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চলে একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু বর্তমান সমাজ যেহেতু
শিক্ষার উন্নতির শিখরে তাই এর জনপ্রিয়তা অনেকটা কমে গেছে। যেসব অঞ্চল তুলনামূলকভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় খানিকটা পিছিয়ে এবং ভৌগোলিকভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম, সেসব জায়গায় ঘাটু গানের প্রচলন এখনও দেখা যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে কৃষক শ্রেণির লোক, দিনমজুর শ্রেণির লোকেরাই ঘাটু গানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অনেকক্ষেত্রে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কর্মকর্তারাও এই ঘাটু গানের সঙ্গে জড়িত। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ "ঘেটু পুত্র কমলা' নামে ঘাটু ছেলেদের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। রক্ষণশীলতা, গতিহীনতা, শিক্ষার অভাব ও অপর্যাপ্ত বিনোদন ব্যবস্থা ছিল ঘাটুর প্রতিপালক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যের বিশিষ্ট দরবারে ঘাটু গানটি এক অভিনব স্থান দখল করে আছে এবং যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই।
প্রবন্ধ: অপরাজিতা ভট্টাচার্য
তথ্যসূত্র:
১.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
২. উইকিপিডিয়া
৩. বাংলাপিডিয়া
(প্রকাশিত ১০.০৬.২০২১)
There are no reviews yet.