E-Learning Info
Go to content

কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন

জন্ম পরিচয়
অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি শক্ত পদকর্তা ও কালী সাধক, রামপ্রসাদ সেন। রামপ্রসাদের জন্ম সন নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। ডঃ দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য কবির জন্মকালীন সংস্থান ধরে হিসেব করে অনুমান করেছেন তার জন্ম মাস বাংলা আশ্বিন ১১২৭। ঈশ্বর গুপ্তের মতেও আনুমানিক ইংরেজি ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দ (১১২৭ বাংলা)। কবির জন্মস্থান তৎকালীন হালিশহরের অন্তর্গত ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত কুমার ভট্ট গ্রামে যা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সুবা বাংলা। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত উত্তর চব্বিশ পরগণা। রামপ্রসাদের পিতা রামরাম সেন এবং মাতা সিদ্ধেশ্বরী দেবী। তার পিতা ছিলেন একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত।  সিদ্ধেশ্বরী দেবী ছিলেন রামরাম সেনের দ্বিতীয় পত্নী।
শৈক্ষিক জীবন:

মধ্যযুগের নিয়ম ছিল টোলে গিয়ে শিক্ষার্জন করা । সেই রীতি অনুযায়ী রামপ্রসাদ সেনের মা-বাবা তাঁকে একটি সংস্কৃত টোলেই শিক্ষালাভের জন্য প্রেরণ করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই প্রসাদ সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফরাসি ও হিন্দি ভাষার দক্ষতা অর্জন করেন। আর পিতা রামরাম সেনের ইচ্ছে ছিলো,যে তার পুত্র অর্থাৎ রামপ্রসাদও পারিবারিক চিকিৎসক বৃত্তি গ্রহণ করুক।
শিক্ষা পরবর্তী জীবন এবং বিবাহ ও তাঁর পরিবার:

ছোট থেকে রামপ্রসাদ ছিলেন ঈশ্বরানুগ্রাহী। তাই শিক্ষা শেষে তার আগ্রহ ছিল আধ্যাত্বিক জীবন যাপনে। তিনি যখন মাত্র ১৬ বছর বয়সের তখন তাঁর পিতা পরলোক গমন করেন, তাই পরিবারের দায়-দায়িত্ব এসে বর্তায় রামপ্রসাদের উপর। ১৭-১৮ বছর বয়সে জীবিকার জন্য কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ মিত্র নামে ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছারিতে মুহুরীর চাকরি নেন। সেই সময় তার বেতন ছিল মাসিক ৩০ টাকা। চাকরির পাশাপাশি গান লেখাও ছিল অব্যাহত।  কথিত আছে রামপ্রসাদ নাকি প্রায়ই হিসেবের খাতায় শ্যামাসংগীত লিখতেন।  এই কাণ্ডের জন্য অন্যান্য কর্মচারীরাও তাঁর বিরুদ্ধে মালিকের কাছে নালিশ করতেন । দুর্গাচরণ মিত্র তদারকি করে দেখতে গিয়ে রামপ্রসাদের রচনা করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি রামপ্রসাদকে কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। উপরন্তু তাকে মাসিক-ভাতার ব্যবস্থাও করে দেন।
     গ্রামে ফিরে রামপ্রসাদ তাঁর রচনায় ডুবে যান এবং কঠোরভাবে সাধনায় ব্রতী হয়ে পড়েন । তাঁর আধ্যাত্মিক-জগত ও রচনায়  মিল থাকার কারণে যেনো এক সেতু সৃষ্টি হয়, যা তাঁর আধ্যাত্মিক জগৎ ও ভাব জগতের সাথে মিলে যায়। তাই তিনি জাগতিক মায়া ভুলে তাতেই ডুবে থাকতেন। প্রসাদের এই ভাব দেখে তাঁর পরিবার ভীত হয়ে পড়ে, পাছে প্রসাদ যেনো সন্ন্যাসী না হয়ে যায় তাই রামপ্রসাদর সঙ্গে সর্বাণী নামে এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। পারিবারিক প্রথানুযায়ী বিয়ের পর নব দম্পতি তাদের কুলগুরু মাধবাচার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করে কালীমন্ত্রে। সুপ্রসিদ্ধ সাধক পন্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন বঙ্গদেশে কালী আরাধনার প্রবর্তক এবং শাক্ত তন্ত্রগ্রন্থ 'তন্ত্রসার' এর রচয়িতা। প্রসাদ কৃষ্ণানন্দ আগুন ভাই কিসের কাছে পরবর্তীতে শিষত্ব গ্রহণ করে। আগমবাগীশ প্রসাদকে তন্ত্রসাধনা ও কালী পূজার পদ্ধতির বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করে।
      বাড়ির সঙ্গে বিয়ের পরেও রামপ্রসাদের সাধনা কিন্তু অব্যাহত ছিলো। তাঁর স্ত্রী সর্বাণী তাঁকে সাধনায় কখনো বাঁধা দেন নি। উপরন্তু তাঁকে সাহায্য করতেন। রামপ্রসাদের বিবাহিত জীবন তাঁর সাধনার প্রতি কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাঁর এক পঞ্চবটির তলায় পঞ্চমুণ্ডির আসন ছিলো। এটি একটি তান্ত্রিক মতানুযায়ী সাধনার প্রথা। এই পঞ্চমুণ্ডির আসনে সাধনা করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে আদ্যাশক্তি মহামায়া ভগবতী কালিকার দর্শন পেয়েছিলেন।
      প্রসাদ তাঁর সাধন জীবনের পাশাপাশি অব্যাহত রেখেছিলেন তাঁর নিজস্ব সংগীত রচনা । নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র পর্যন্ত রামপ্রসাদের গানে মুগ্ধ ছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। কিন্তু সভায় ততটা যোগ দিতেন না। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে প্রায় ১০০ একর নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রামপ্রসাদ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে "বিদ্যাসুন্দর কাব্য' উৎসর্গ করেন।  রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদ কে "কবিরঞ্জন' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। কথিত আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অন্তিম সময়ে রামপ্রসাদ তাঁর পাশে থেকে তাঁকে কালীর নাম গান শুনিয়েছিলেন এবং কালী নামেই তার জন্ম মৃত্যু যেন মোক্ষ লাভ করেছিলো। নবাব সিরাজদ্দৌলা সহ বহু সুফি নাকি রামপ্রসাদের আধ্যাত্মিক সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়। এমনকি এমনও জানা যায় নবাবের অনুরোধে প্রসাদ তাঁর সভাতেও গিয়েছিলেন।
রচনাবলী:

              ১) কালীকীর্ত্তন
              ২) বিদ্যাসুন্দর
              ৩) কৃষ্ণকীর্ত্তন অসম্পূর্ণ খন্ড কাব্য
              ৪) শক্তিগীতি
 রামপ্রসাদ সেনই বাংলায় ভক্তিবাদী শাক্ত ধর্ম ও দেবী কালিকার লীলাকীর্তন, শ্যামাসঙ্গীতের ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনিই প্রথম শ্যামা সংগীত গভীর ভক্তি সহকারে ভগবতী কালীর লীলা কীর্তন রচনা করেন। তাঁর গানেই প্রথম আমরা শ্মশানচারিনী দেবী কালিকে স্নেহময়ী মা এমনকি ছোট মেয়ে হিসেবেও দেখি।
       প্রসাদের গানের বিশেষত্ব ছিলো তাঁর নিজস্ব দেওয়া সুর যা এখন আমরা 'রামপ্রসাদী' বা প্রসাদী সুর বলে জানি। অনেকে রামপ্রসাদের গানকেও রামপ্রসাদি গান বলে থাকে। তাঁর গানের সুরের মধ্যে তৎকালীন বাংলার ছিয়াত্তর মতান্তরের আর্থিক দুরবস্থা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রভাব সুস্পষ্ট। তাই রামপ্রসাদের জীবিতাবস্থায়ই তাঁর গানগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো। এই সুর পরবর্তীকালের প্রায় সকল সঙ্গীতকারকেই কম-বেশি প্রভাবিত করেছে; এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই সুরে অনেক  দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছেন। শ্যামাসঙ্গীত এর রামপ্রসাদের অবদান অশেষ বটে কিন্তু আগমনী ও বিজয়া পর্বের গানগুলি রচনাতেও তাঁর অবদান অস্বীকার্য। তিনি আগমনী কে কেন্দ্র করে মেনুকার মনের ভাব উমার প্রতি ব্যক্ত করে অনেকগুলি পদ রচনা করেছেন । যেমন:
  • "আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে
       গিরিরাজ অচেতনে কত না ঘুমাও হে।'
  • "কবে যাবে বলো গিরিরাজ গৌরীরে আনিতে
      ব্যাকুল হইয়েছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে।'
এরকম আরো লিখেছেন তার মধ্যে প্রসিদ্ধ গান তথা পদ:
  • "এবার আমার উমা এলে
        আর উমা পাঠাবো না
        বলে বলবে লোকে মন্দ
        কারো কথা শুনবো না।
        যদি আসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নিবার কথা কয়
        তবে মাএ ঝিয়ে করব ঝগড়া
        জামাই বলে মানবো না।'
রামপ্রসাদের বিজয়ার পদগুলি হলো:
  • "ওরে নবমী না হইও রে অবসান
       শুনেছি দারুন তুমি না রাখো সতের মান।।
শ্যামাসঙ্গীত:
রামপ্রসাদের গানেই দেখি মা কালী কে বেড়া বাঁধতে, তাঁকে সাহায্য করতে।  প্রসাদের বিখ্যাত গান
  • "মনরে কৃষিকাজ জানো না
       এমন মানব জমিন রইলো পতিত
       আবাধ করলে ফলতো সোনা।'
একবার চাকরির খাতায় হিসেব কষতে গিয়ে হঠাৎ করে কালী চিন্তায় মগ্ন হয়ে প্রসাদ লিখেছেন
  • "দে মা আমায় তবিলদারী
       আমি নেমক্হারাম নই শঙ্করী।'
রামপ্রসাদের সংসারে ছিলো অনেক টানাটানি। তাই নিয়ে তিনি অনেকগুলো পদ লিখেছেন যেমন
  • "আমি কি দুখের ডরাই
       তবে দিও দুঃখ আর কতো চাই।'
  • "তাই অভিমান করি আমি,
       আমায় করেছো মা সংসারী।'
শত দুঃখের মধ্যেও রামপ্রসাদ কালী নাম নিতে ভুলেন নি-
  • "মা তোমারে বারে বারে জানাবো আর দুঃখ কতো
       আমি ভাসিতেছি দুঃখনীরে, স্রোতেরো শেহালার মতো।'
  • "আমার অন্তরে আনন্দময়ী
       সদা করিতেছেন কেলি।
      আমি যেভাবে সেভাবে থাকি
      নামটি কভু নাহি ভুলি।'
  • "চাই না মাগো রাজা হতে
       রাজা হবার সাধ নাই মাগো
       দুবেলা যেনো পাই মা খেতে।'
  • "মায়ের এমনি বিচার বটে
       যে জন দিবানিশি দুর্গা রটে
       তার কপালে বিপদ ঘটে।'
কালীর ভাবে আধ্যাত্মিকভাবে বিভোর হয়ে অনেক গানই লিখেছেন:
  • "এমন দিন কি হবে তারা
       যবে তারা তারা  তারা
      বলে তারা বেয়ে পড়বে ধারা।'
  • "বাজবে গো মহেশের হৃদে
       আর নাচিস নে ক্ষ্যাপা মাগী।'
  • "মন তোমার এই ভ্রম গেলো না
       কালী কেমন জানতেও চাইলে না চাইলে না।'
  • "শ্মশান ভালোবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি
       শ্মশানবাসিনী  শ্যামা নাচবি বলে নিরবধি।'
রূপ বর্ণনায় না হলেও মাতৃস্বরূপ স্মরণ অকপট বর্ণনা কে রামপ্রসাদ বলেছেন
  • "মায়ের মূর্তি করাতে চাই,মনের ভ্রমে মাটি দিয়ে
       মা বেটি কি মাটির মেয়ে মিছে ঘাঁটি  মাটি নিয়ে।'
কখনো মৃত্যু চিন্তা করে রামপ্রসাদ সনাতনী মনকে বলছেন-
  • "ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়
       মিছে ভ্রম ভূমন্ডলে
      ভুলনা দক্ষিণা কালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে।'
  • "মনেরই বাসনা শ্যামা ,শোন মা স্ব-বাসনা বলি
       অন্তিম কালে জিহ্বা যেন বলতে পায় মা কালী কালী।'
শোনা যায় সাধনার সিদ্ধি পাওয়ার পর নাকি রামপ্রসাদ মায়ের দর্শন পান। তখন তিনি যে গানটি গেয়েছিলেন-
  • "জগত জননী আমার তরাও গো মা তারা
       জগৎ কে তরলে আমাকে ডুবালে
       আমি কি মা জগত ছাড়া'
রামপ্রসাদের অন্যান্য বিখ্যাত গানগুলি-
  • "ডুব দে রে মন কালী বলে
       হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।'
  • "কালী কালী বল রসনা
       করো পদ ধ্যান নামামৃত পান
        যদি হতে ত্রাণ থাকে বাসনা।'
  • "দিবা নিশি ভাবো রে মন, অন্তরে করাল বদনা
        নীল কাদম্বিনী রূপ মায়ের এলোকেশী দিগ্বসনা'
  • "একবার নাচো নাচো গো শ্যামা,নাচো তেমন করে
       একবার নাচো মা একবার নাচো মা।'
  • "হৃদয় রাস মন্দিরে,দাড়া মা ত্রিভঙ্গ হয়ে
      হয়ে বাকা দে মা দেখা, শ্রী রাধারে বামে লয়ে।।"
  • "মা আমায় ঘুরাবি কতো'
মৃত্যু:

বৃদ্ধ বয়সে রামপ্রসাদের দেখাশোনা করতেন তাঁর পুত্র রামদুলাল ও পুত্রবধূ ভগবতী। রামপ্রসাদের মৃত্যু নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। রামপ্রসাদ প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজা করতেন।  একবার সারারাত পূজা ও গানের পর সকালে কালীপ্রতিমা মাথায় করে নিয়ে বিসর্জনের পথে বের হন রামপ্রসাদ। ভক্তগণ তার পিছন পিছন বিসর্জন শোভাযাত্রায় অংশ নেন। স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত "ছুইও না ছুইও না আমার জাত গিয়েছে' গাইতে গাইতে গঙ্গার জলে প্রতিমা বিসর্জনার্থে গমন করেন রামপ্রসাদ। প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর প্রাণ বহির্গত হয়। মনে করা হয়, এটি ১৭৭৫ সালের ঘটনা।
প্রবন্ধ: সুরভী সাহা
তথ্যসূত্র:
  • বাংলাপিডিয়া
  • উইকিপিডিয়া
(প্রকাশিত: ১০.০৩.২০২৩)
There are no reviews yet.
0
0
0
0
0

Website Developed by:

DR. BISHWAJIT BHATTACHARJEE
Assistant Prof. & Former Head
Dept. of Bengali, Karimganj College
Karimganj, Assam, India, 788710

+917002548380

bishwa941984@gmail.com
Important Links:
Back to content