দীনেশ চন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯)
জন্ম
দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ ৩রা নভেম্বর মানিকগঞ্জের বগজুড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ঈশ্বর চন্দ্র সেন এবং মাতার নাম ছিল রূপলতা দেবী। ঊনবিংশ শতকের শেষ এর দিক। বাংলার সাহিত্য জগৎ তখন ও রবীন্দ্রছোঁয়া সেভাবে পায়নি এবং তখনও বঙ্গভঙ্গ নামের কোন ঘটনা ঘটেনি। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। ঢাকারই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে দীনেশচন্দ্র সেন এর জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা মানিকগঞ্জ আদালতের একজন উকিল ছিলেন।
শিক্ষা জীবন
দীনেশচন্দ্র সেন এর ছোট বেলা থেকেই কবিতা, ছন্দ, সাহিত্য এর প্রতি ছিল প্রবল উৎসাহ। সাত বছর বয়সে দেবী সরস্বতীকে নিয়ে পয়ারে লিখেছিলেন স্তব মন্ত্র। আর এই সব এর পাশাপাশি তার মন ছিল ইতিহাসে। এমন প্রেক্ষাপট নিয়েই পড়াশুনা শুরু করেন দীনেশচন্দ্র সেন। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় একদিন মনের খেয়ালে নোট বই এর সাদা পাতা উল্টাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার কি যে মনে হলো, কলম দিয়ে খসখস করে লিখে ফেললেন নিজের মনের ইচ্ছে- "বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হইব, যদি না পারি ঐতিহাসিক হইব। যদি কবি হওয়া প্রতিভায় না কুলায়, তবে ঐতিহাসিক এর পরিশ্রমলব্ধ প্রতিষ্ঠা হইতে আমায় বঞ্চিত করে কার সাধ্য?' ১৮৮২ সালে দীনেশ চন্দ্র সেন জগন্নাথ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৮৫ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ পাস করেন এবং ১৮৮৯ সালে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্ম জীবন
১৮৮৭ সালে সিলেটের হবিগঞ্জ স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তার কর্ম জীবন শুরু হয়।১৮৯০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুল এর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন কালে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করেন। ১৮৯৬ সালে দীনেশ চন্দ্র সেন এর পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথি পাঠ এর সময় তাঁর কর্ম জীবনে এবং গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন পর্বের সূচনা হয়। তিনি উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর আহ্বানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বি.এ পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের পরীক্ষক (১৯০৫), পরে রিডার পদে (১৯০৯), নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯১০ সালে তিনি মনোনীত হন কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় এর সিনেট সদস্য হিসাবে। ১৯১১ সালে তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ "History of Bengali Language and Literature' প্রকাশিত হওয়ার পর তা সবার প্রশংসা অর্জন করে।
সাহিত্য জীবন
নিজের জীবনের রাস্তাটা যেন এই নোট বই এর পাতাতেই দেখতে পেলেন দীনেশ চন্দ্র সেন। সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হয়ত হতে পারেন নি কিন্তু কবিত্ব কে তিনি কোন দিন বিসর্জন ও দেননি। তবে এ সবের বাইরে গিয়ে ও দীনেশ চন্দ্র সেন হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্য এর এক অমূল্য সম্পদ। চণ্ডীদাসের পদাবলী পাঠ করে তিনি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রতি আকর্ষিত হন। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
"অদ্য ছয় বৎসর হইল, একদিন আমার পুস্তকারাধিস্থতি জীর্ণ, গলিত পত্র, প্রেমাশ্রুর নীরব নিকেতন চণ্ডীদাসের গীতিকবিতাগুলি পড়িতে পড়িতে প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের একখানি ধারাবাহিক ইতিহাস লিখিতে ইচ্ছা জন্মে। ভিক্টোরিয়া স্কুলের সেই সময়ের অধ্যাপক পণ্ডিত চন্দ্র কুমার কাব্যতীর্থের সাগ্রহ প্রবর্তনায় এই ইচ্ছা সুদৃঢ় হয়।বৈষ্ণব কবিগণের গঠিত, কনিকঙ্কণের চণ্ডীকাব্য, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল ও অপর কয়েকখানি বটতলার ছাপা পুঁথিপত্র আমার সম্বল ছিল। আমি তাহা পড়িতাম ও কিছু কিহু নোট সংগ্রহ করিয়া রাখিতাম। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কলিকাতার "পিস এসোসিয়েশন' হইতে বঙ্গভাষার উৎপত্তি ও পরিপুষ্টি সম্বন্ধে উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লেখককে "বিদ্যাসাগর পদক' অঙ্গীকার করিয়া বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, ই সুযোগ পাইয়া তিন মাস কালমধ্যে আমি সংক্ষেপে বঙ্গভাষা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখি, উক্ত সমিতি আমার প্রবন্ধ মনোনীত করিয়া "বিদ্যাসাগর পদক' আমাকে প্রদান করেন।'১
বাংলার লোকসাহিত্য চর্চার ইতিহাসে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা গীতি চর্চার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আরেকটি নাম চন্দ্রকুমার দে অবিকৃতভাবে গীতিকা সংগ্রহ ও প্রকাশ না করলেও আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন কিন্তু অবিকৃত ভাবে লোক সাহিত্য এর উপাদান সংগ্রহের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
সাহিত্যকর্ম
- বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (১৮৯৬) দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯০১)
- তিন বন্ধু (১৯০৪)
- রামায়ণী কথা (১৯০৪)
- বেহুলা (১৯০৭)
- সতী (১৯০৭)
- ফুল্লরা (১৯০৭)
- জড় ভরত (১৯০৮)
- History of Bengali Language and Literature (1911
- সুকথা (১৯১২)
- গৃহশ্রী (১৯১৬)
- নীলমানিক (১৯১৮)
- মুক্তা চুরি (১৯২০)
- সরল বাংলা সাহিত্য (১৯২২)
- বৈদিক ভারত (১৯২২)
- ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য (১৯২২)
- গোপীচন্দ্রের গান (প্রথম খণ্ড) (১৯২২)
- Estern Bengali Ballads, Vol.I (1923)
- মৈমনসিংহ গীতিকা (১৯২৩)
- গোপীচন্দ্রের গান (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৯২৪)
- আলোকে আঁধারে (১৯২৫)
- Estern Bengali Ballads, Vol.II (1926)
- চৌকির বিড়ম্বনা (১৯২৬)
- ওপারের আলো (১৯২৭)
- Estern Bengali Ballads, Vol.III (1928)
- Estern Bengali Ballads, Vol.IV (1932)
- পৌরাণিকী (১৯৩৪)
- বৃহৎ বঙ্গ (১ম ও ২য় খণ্ড) (১৯৩৫)
- আশুতোষ স্মৃতি কথা (১৯৩৬)
- শ্যামল ও কাজল (১৯৩৬)
- পদাবলী মাধুর্য্য (১৯৩৭)
- পুরাতনী (১৯৩৯)
- বাংলার পুরনারী (১৯৩৯)
- প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৪০)
- হিন্দু সমাজ ও বৈষ্ণব ধর্ম
লোকসাহিত্য গবেষক বরুণ কুমার চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানা যায় তিনি বাংলা লোকসঙ্গীত শিক্ষাদানের একটি উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারকেও লোককাহিনি সংগ্রহে যথেষ্ঠ উৎসাহ দান করেছেন। লোকসাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ এবং সেগুলি প্রকাহ করার জন্য তিনি তৎকালীন ইংরেজ সরকারকে সম্মতি করিয়েছিলেন। তিনি চন্দ্রকুমার দে এবং আশুতোষ চৌধুরীর মত ব্যক্তিকে লোকসাহিত্য সংগ্রহে নিয়োগ করেছিলেন।
দীনেশ চন্দ্র সেন এর উপাধি
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় ড. দীনেশ চন্দ্র সেন কে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করেন। ভারত সরকার দীনেশ চন্দ্র সেন কে "রায় বাহাদুর' উপাধি তে ভূষিত করেন। ১৯২৬ সালে তার লেখা "মৈমনসিংহ গীতিকা' গ্রন্থটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালে হাওড়ায় অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন। তিনি এই সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩১ সালে দীনেশ চন্দ্র সেনকে কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় "জগৎ তারিণী' পদক প্রদান করেন। ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বাংলা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
মৃত্যু
১৯৩৯ সালের ২০ শে নভেম্বর কলকাতার বেহালায় দীনেশ চন্দ্র সেন পরলোক গমন করেন।
প্রবন্ধ: তন্ময়ী চৌধুরী
তথ্যসূত্র:
১. বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী, পৃঃ২৪৭
২. বাংলা পিডিয়া
৩. উইকি পিডিয়া
প্রকাশিত-- (১৬. ০৫. ২০২১)
There are no reviews yet.