দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০–১ নভেম্বর ১৮৭৩ সাল)
বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদনের আবির্ভাবের পর দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব ঘটে। বাস্তব জীবন চিত্র সম্বলিত সমসাময়িক সামাজিক সহানুভূতি ও সর্বব্যপী সামাজিক অভিজ্ঞতা নিয়ে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের আগমন ঘটে। নাট্যকার দীনবন্ধু বাস্তব জীবনচিত্র ও তদানীন্তন সমাজ জীবনের অতি উৎকৃষ্ট আলেখ্য রচনা করে গেছেন। প্রথম জীবনে তিনি ঈশ্বরগুপ্তের শিষ্য হয়ে রঙ্গরেসের কিছু কবিতা লিখেছিলেন, পরে কিছু কাব্য কবিতাও লিখেন। তাঁর নাট্যকার হিসাবে খ্যাতি মূলত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের জন্য।
জন্ম ও পরিবার
উনবিংশ শতাব্দীর লেখক দীনবন্ধু মিত্র ১২৩৬ বঙ্গাব্দ (মতান্তরে ১২৩৮) অথবা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র মাসে নদীয়া জেলার কাঁচরা পাড়ার স্টেশনের পার্শ্ববর্তী গ্রাম চৌবেড়িয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। গ্রামটির চারদিকে নদী থাকায় নামকরণ হয় চৌবেড়িয়া। তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয় চৌবেড়িয়ায় মাতুলালয়ে, যদিও তাঁর পূর্ব পুরুষের বাসস্থান ছিল চব্বিশ পরগণা জেলার বেলেনী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। লেখকের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো গন্ধর্বনারায়ণ। কিন্তু পরবর্তী কালে ছাত্রাবস্থায় লেখক সেই নাম পরিবর্তন করে দীনবন্ধু নামটি গ্রহণ করেন।
বাল্যজীবন ও শিক্ষা
লেখক দীনবন্ধু মিত্র ছাত্রজীবনে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। দরিদ্র ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন বলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের পাঠশালায় হয়। কিন্তু পারিবারিক দারিদ্রতার কারণে পিতা কালাচাঁদ মিত্র তাঁকে জমিদারের দফতরে কাজে নিয়োগ করেন। কিন্তু শিক্ষা অর্জনের প্রতি লেখক দীনবন্ধু মিত্রের ছিলো প্রবল আগ্রহ তাই তিনি পালিয়ে কলকাতায় আসেন। সেখানে খুল্লতাত গৃহে বাসন মেজে এবং ঘরের কাজের বিনিময়ে লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে যান। সেই সময় তিনি পিতৃ প্রদত্ত নাম ত্যাগ করে দীনবন্ধু নামে জেমস লঙের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে কাটুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমানে হেয়ার স্কুল) থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্তি হন, ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে কলেজের উচ্চতর পরীক্ষায়ও বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় শ্রেণি থেকে সিনিয়র বৃত্তি পান। প্রতিটি পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখক দীনবন্ধু সর্বোচ্চ স্থানাধিকার প্রাপ্ত হন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘টিচার শিপ’ পরীক্ষায় সফলতা লাভ করেন।
কর্ম জীবন
দীনবন্ধু মিত্র ভারতীয় ডাক বিভাগের চাকুরি করতেন। কিন্তু সেই বিভাগে চাকুরি গ্রহণের পূর্বে কিছুদিনের জন্য কলকাতা হিন্দু কলেজে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৫৫ সালে ১৫০ টাকা মাইনেতে পাটনায় পোস্টমাষ্টারের পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হন। ডাক বিভাগে চাকুরিতে থাকাকালীন তাঁর পদোন্নতির সুবাদে তিনি কৃষ্ণনগর, নদীয়া, উড়িষ্যা এবং ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার শ্রীরামপুরে সুপারিন্টেণ্ড পোস্টমাষ্টার পদে আসীন হন। পরবর্তীকালে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন জায়গায় বদলী হয়েছেন এবং নানান শ্রেণির মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। লুসাই যুদ্ধের সময় ডাক বিভাগের কাজে কাছাড়ে নিযুক্তি পান। এই সময় তাঁর কর্ম তৎপরতায় সন্তুষ্ট হয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করেন। ডাক বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়েও তিনি উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তাই তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলওয়েতে পরিদর্শক পদে চাকুরি গ্রহন করেন।
পারিবারিক জীবন
লেখক দীনবন্ধু মিত্রের পারিবারিক জীবন ছিলো খুবই সুখের। তাঁর সাত পুত্র ও এক কন্যা ছিলো। তাছাড়া তাঁর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি।
সাহিত্য জীবন
লেখক দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন একাধারে বাংলা নাট্যসাহিত্যের নাট্যকার, লেখক ও কমেডি লেখক। তিনি তাঁর সাহিত্য জীবনে চেয়ে ছিলেন কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা অর্জন করতে ও ‘মাটির কাছাকাছি’র শিল্পী হতে। তৎকালীন ক্ষুব্ধ জনগণের সহিত অন্তর্লীনতা অনুভব করতেন বলেই লাঞ্ছিত জনজীবনের সহানুভূতিশীল লেখক রূপে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের সর্বাধিক পরিচিত নাটক ‘নীলদর্পণ’ রচনা করে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত হয়। নাটকটি "নীলদর্পণম নাম নাটকম’ এই বেনামীতে মুদ্রিত হয়- “নীলকর-বিষধর-দংশন-কাতর-প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ কেনচিৎ-পথিকেনাত্তি প্রণীতম।'' ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি উদ্দেশ্যমূলক নাটক। নাটকটিতে নাট্যকারের উদ্দেশ্য ছিলো –
ক) ইংরেজদের সার্থপরতা ত্যাগ
খ) নিরাশ্রয় প্রজাদের মঙ্গল
গ) বিলাতের মুখরক্ষা
নাট্যকারের তিনটি উদ্দেশ্যই সফল হয়েছিলো এই নাটকে। এই নাটকটির সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে নাট্যসাহিত্য, নাট্যমঞ্চ, স্বাদেশিকতা, নীল আন্দোলন, সমাজ দর্পণ প্রভৃতির। যেহেতু নাটকটিতে তৎকালীন বাঙালি কৃষক ও ভদ্রলোকের প্রতি নীলকর সাহেবদের পৈশাচিক অথবা অমানুষিক অত্যাচার ও শোষণ বর্ণনা করা হয়েছে, তাই নাট্যকার দীনবন্ধু ছদ্মনামের আড়ালে আত্মগোপন করেছিলেন। পরবর্তীতে মধুসূদন ‘নীলদর্পণ’ নাটকটির ইংরাজী অনুবাদ করেন এবং এর নাম হয় ‘The Indigo Planting Mirror’। কিন্তু তাতেও তাঁর নাম প্রকাশিত ছিলো না। শুধু লঙ সাহেবের নাম প্রকাশক হিসাবে ছিলো এবং যার ফলে লঙ সাহেবের জরিমানা ও জেলও হয়েছিল।
গ্রন্থটির মুখ্য বিষয় নীলচাষ এবং সেই নীলচাষকে কেন্দ্র করে নীলকরদের (ইংরেজ সাহেব) উৎপীড়ন এবং সেই উৎপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কাহিনি। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এবং মাঝামাঝি কালে ইংরেজ সাহেবরা আড়কাঠি (recruiter) পাঠিয়ে গ্রামের নিরীহ চাষীদের দিয়ে নীলচাষ করাত। পরে সেই নীল রং চড়া দামে দেশ দেশান্তরে রপ্তানি করত। সেই নীলচাষকে কেন্দ্র করে নীলকররা অনেক বেআইনি ভাবে জুলুমের দ্বারা দাদন দিয়ে কৃষকদের নীল উৎপন্ন করতে বাধ্য করত, যদি কেউ রাজি না হত তাকে তারা চরম শাস্তি দিত। নীলকর সাহেবদের চরম অত্যাচারে ধীরে ধীরে চাষীদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গতে লাগলো; যশোহর, নদীয়া ও চব্বিশ পরগণার চাষীরা একত্রিত হয়ে নীলকর সাহেবদের বিরূদ্ধে আন্দোলন শুরু করলো, দেশের নেতারা নীলচাষীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন। তাঁরা তাঁদের বক্তৃতার মাধ্যমে এবং সংবাদ পত্র গুলি তাদের লিখনীর মাধ্যমে জনমত গড়তে লাগলেন। কিন্তু সেই ব্যাপারটি বেশি দূর গড়াবার পূর্বেই ইণ্ডিগো কমিশন বসিয়ে তদন্ত করে দেখা গেল স্ত্রী সংক্রান্ত ঘটনা ব্যতিরেকে (কারণ তা প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি) বাকি সব বিষয়েই নীলকর সাহেবরা দোষী এবং ন্যায় বিচারে শাস্তিসম্মত। ইংরেজ সাহেবরাও সহজে হাল ছাড়ে নি। তারাও উকিল-ব্যারিস্টার জোগাড় করে উল্টো মামলা লড়তে প্রস্তুত হল। কিন্তু সেই রণসজ্জা হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে গেল। বিজ্ঞানের কল্যানে জার্মানিতে আবিস্কার হলো রাসায়নিক নীল যা অতি সুলভ মূল্যে বাজারে বিক্রয় হতে লাগলো। ফলস্বরূপ একদিনেই নীলকর সাহেবদের নীল ব্যবসা পাঠে উঠল।
বিষয়বস্তু পরিবেশনার দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে লেখক দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণকে তখনকার সময়ের অগ্রগণ্য সাহিত্য রচনা বলে স্বীকার করতেই হয়। তৎকালীন সময়ের নিঃস্ব প্রজাদের দুঃসহ শোষণ ও লাঞ্ছনার প্রত্যক্ষ চিত্র সহানুভূতির সঙ্গে দীনবন্ধু মিত্র এই নাটকে চিত্রিত করেছেন। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে ‘নীলদর্পণ’ নাটকটির ঐতিহাসিক ভূমিকা সর্বজন বিদিত। এজন্য বঙ্কিমচন্দ্র জানান,
""দীনবন্ধু পরের দুঃখে নিতান্ত কাতর হইতেন, “নীলদর্পণ” এই গুণের ফল। তিনি বঙ্গদেশের প্রজাগণের দুঃখ সহৃদয়তার সহিত সম্পূর্ণরূপে অনুভব করিয়াছিলেন বলিয়াই “নীল-দর্পণ” প্রণীত ও প্রচারিত হইয়াছিল। যে সকল মনুষ্য পরের দুঃখে কাতর হয়, দীনবন্ধু তাহারমধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। তাঁহার হৃদয়ের অসাধারণ গুণ এই ছিল যে, যাহার দুঃখ, সে যেরূপ কাতর হইত, দীনবন্ধু তদ্রূপ বা ততোধিক কাতর হইতেন। ইহার অপূর্ব উদাহরণ আমি প্রত্যক্ষ করিয়াছি। একদা তিনি যশোহরে আমার বাসায় অবস্থিতি করিয়াছিলেন। রাত্রে তাঁহার কোন বন্ধুর কোন উৎকট পীড়ার উপক্রম হইল। যিনি পীড়ার আশঙ্কা করিতেছিলেন, তিনি দীনবন্ধুকে জাগরিত করিলেন এবং পীড়ার আশঙ্কা জানাইলেন। শুনিয়া দীনবন্ধু মুর্ছিত হইলেন। যিনি স্বয়ং পীড়িত বলিয়া সাহায্যার্থে দীনবন্ধুকে জাগাইয়াছিলেন, তিনিই আবার দীনবন্ধুর শুশ্রূষায় নিযুক্ত হইলেন। ইহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। সেইদিনই জানিলাম যে, অন্য যাহার যে গুণ থাকুক, পরের দুঃখে দীনবন্ধুর ন্যায় কেহ কাতর হয় না। সেই গুণের ফল “নীলদর্পণ”।''
“নীলদর্পণ” নাটকে নাট্যকার দীনবন্ধু চরিত্রাঙ্কনে একই সঙ্গে সার্থক ও ব্যর্থ। ভদ্রেতর চরিত্রগুলি সংলাপের গুণে সহজ ও স্বাভাবিক এবং ভদ্র চরিত্র গুলি কৃত্রিম ও আড়ষ্ট। ভদ্রচরিত্রগুলির চিত্রনে নাট্যকারের ব্যর্থতার মুখ্য কারণ তিনি নাটকে নাটকীয় উদাসীনতা রক্ষা না করে এবং শিল্পীধর্মকে অটুট না রেখে একটি পোষিত আদর্শকে অনুসরণ করেছেন। ফলে “নীলদর্পণ” নাটকে গোলকবসু, নবীনমাধব, সৈরিন্ধ্রী, সাবিত্রী, সরলতা – এই চরিত্রগুলি নাট্যকারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল না হয়ে তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কল্পিত আদর্শ ও চিন্তাধারার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলো। তাই গোলক বসুর সহজ বিশ্বাস, নবীনমাধবের কর্তব্যবোধ ও পিতৃভক্তি, সৈরিন্ধ্রীর পাতিব্রত্য, সাবিত্রীর অপত্য স্নেহ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে প্রত্যক্ষ হলেও নাট্যশিল্পীর চেতনায় প্রাণহীন, কৃত্রিম পুত্তলিকা মাত্র।
দীনবন্ধুর শিল্পী স্বভাব সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, “তাঁহার চরিত্র প্রণয়ন প্রথা এই ছিল যে, জীবন্ত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া চিত্রকরের ন্যায় চিত্র আঁকিতেন। কোন চরিত্র পরিকল্পনায় নয়, কাহিনী কল্পনায় রূপাঙ্গিক রচনায় সর্বত্রই তিনি চিত্রকর বা ফটোগ্রাফার কিন্তু চিত্রশিল্পী নন। রসিকতা করে আর বলেছেন যে, “সামাজিক বৃক্ষে বানর দেখিলে দীনবন্ধু লেজশুদ্ধ বানর অঙ্কন করিতেন।''
প্রহসন
লেখক দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন শ্রেষ্ঠ কমেডি লেখক, মূলত প্রহসনধর্মী নাটক রচনার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা অন্যতম। তৎকালীন সময়ে সমাজের উচ্চশ্রেণির নাট্যধর্মের কৌতুক ও পরিহাস এবং নানা অসংগতির প্রতি কৌতুক রসাশ্রিত নাটক রচনার দ্বারা লেখক দীনবন্ধু বাংলা নাট্যজগতে স্পৃহনীয় আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। তখনকার সময়ের বাস্তবিক জীবনের রূপ চিত্রায়িত করতে তিনি সফল হলেও কল্পনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অসফল। সেই কারণে যেখানে রোমান্টিক নায়ক-নায়িকার চরিত্র নিয়ে প্রেমের গল্প রচেছেন, সেখানে তা অতিশয় কৃত্রিম ও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। ‘নবীন তপস্বিনী’(১৮৬০) এবং ‘কমলে কামিনী’(১৮৭৩) এই ধরনের কমেডি বা মিলনান্তক নাটক। এই প্রহসন ধর্মী নাটকগুলিতে যে পার্শ্বচরিত্রগুলি বর্ণিত হয়েছে তাতে লেখক দীনবন্ধুর সরস ও কৌতুকপ্রবন মনটি ধরা পড়েছে। নবীন তপস্বিনী নাটকটির জলধর চরিত্র শেক্সপীয়রের Merry Wives of Windsor –এর ফলস্টাফের অনুরূপ চিত্রিত হলেও চরিত্রের ব্যাক্তি বৈশিষ্ট্য ও কৌতুক রস নাট্যকারের উৎকৃষ্ট সম্পদ। প্রকৃত জীবনের দীপ্তিমান চিত্র ও তার আলো-আধারের লীলা লেখককে এমন আকর্ষিত করেছিলো যে তিনি রোমান্সের ক্ষেত্রে নাট্য রচনায় ততটা সার্থক হতে পারেন নি।
বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬)– বিয়ে পাগলা বুড়ো প্রহসন ধর্মী নাটকটিতে বিবাহ বাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের এঁচোড়ে পাঁকা ছেলেরা কি ভাবে তাকে নাস্তানাবুদ করেছিলো তারই এক কৌতুক রসের কাহিনি বর্নিত হয়েছে। ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ প্রহসনটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের অনুসরণে রচিত। এই কৌতুক রসাশ্রয়ী নাটকটি নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের পূর্ণাঙ্গ কৌতুকরসপ্রধান প্রহসন হিসাবে চমৎকারিত্ব লাভ করেছে। নাটকটির সংলাপের মধ্যে ধারালো কথার তীব্র ঝলক যেমন নেই, তেমনি কোনো গম্ভীর সামাজিক সমস্যারও সংকেত নেই। হাস্যরসের অবিরাম ধারায় প্রহসনটি নিতান্তই সাধারণ ও মধুর। প্রহসনটির মধ্যে রাজীবলোচন চরিত্রটি মধুসূদনের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রো’ প্রহসনের ভক্তপ্রসাদের মতই রসিকপ্রবন।
জামাই বারিক (১৮৭২)– দীনবন্ধু মিত্রের ‘জামাই বারিক’ কৌতুক রসাশ্রিত প্রহসনটিতে বাংলার ধনী উচ্চঘরের শ্বশুরবাড়িতে ঘর জামাই পোষে রাখার প্রথাকে হাসিঠাট্টা ও রঙ্গব্যঙ্গের মাধ্যমে বর্ননা করা হয়েছে। অনেকগুলো জামাইকে একটা ব্যারাকের মধ্যে পুরে রাখা এবং তাদের অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়ার বিষয় গুলি একটু অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক মনে হলেও প্রহসনের ক্ষেত্রে তা যথাযথ হয়েছে। পূর্বে কুলীন জামাইরা নিষ্কর্মা ও বেকার অবস্থায় নিছক গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্তে শ্বশুরের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকত বলে তারা সকলের কাছে হাসির পাত্র হয়ে থাকত। এই কুলীন জামাইদের নিদারুণ করুণ অবস্থার কথা সংবেদনশীল নাট্যকার হাস্যরসের প্রবহমান ধারার মধ্যদিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। কলহ পীড়িত দ্বিপত্নিক স্বামীর সমস্যা, সপত্নি ঈর্ষা ইত্যাদি সর্বোপরি বাঙালির ঘরোয়া ঠাট্টা ও রঙ্গরসিকতা নাট্যকার এই প্রহসনে নিপুণতার সহিত তুলে ধরেছেন। ‘জামাই বারিক’ প্রহসনটি স্ত্রীপ্রধান প্রহসন। জামাই বাবাজীবনদের মর্কট লীলা, বগী-বিন্দি দুই সতীনের হাড়াই-ডোমাই ঝগড়া, দুসতীনের জ্বালায় পদ্মলোচনের বিড়ম্বনা ইত্যাদি রসিকতা বাংলাদেশে প্রায় ক্লাসিক পর্যায়ে স্থান নিয়েছে।
লীলাবতী (১৮৬৭)– সমসাময়িক নাগরিক জীবনের হাস্য পরিহাস ও নায়ক-নায়িকার নিলন সংক্রান্ত জটীল কাহিনি অবলম্বনে ‘লীলাবতী’ প্রহসনের কাহিনিটি রচিত হয়েছে। নায়ক ললিত ও নায়িকা লীলাবতীর প্রণয় ও বিবাহ এই নাটকের মূল ঘটনা। তবে কয়েকটি চটকদার মর্কট শ্রেণির চরিত্র এই নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিশেষ ভাবে নদেরচাঁদের চরিত্র কৌতুক চরিত্র হিসাবে অতুলনীয়। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, যে রোমান্টিক ব্যাপার এবং আধুনিক নায়ক-নায়িকার প্রেম-প্রণয় সম্বন্ধে তাঁর কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছিল না, সে যুগে ঠিক এজাতীয় নায়িকাচরিত্র বাস্তবে বড়ো একটা মিলতও না। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে লীলাবতীর মতো “হিন্দু ঘরে ধেড়ে মেয়ে, কোর্টশিপের পাত্রী হইয়া, যিনি কোর্ট করিতেছেন, তাঁহাকে প্রাণমন সমর্পণ করিয়া বসিয়া আছে, এমন মেয়ে বাঙালী সমাজে ছিল না।”
সধবার একাদশী (১৮৬৬)– নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র রচিত প্রহসনধর্মী নাটকগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক “সধবার একাদশী” (১৮৬৬)। এই প্রহসনধর্মী নাটকটির মাধ্যমে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার উচ্চশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের সুরাসক্তি, লাম্পট্য, পরস্ত্রীহরণ প্রভৃতি চরিত্রহীনতার কথা চিত্রিত করেছেন। এই নাটকটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনটির অনুকরণে রচিত। মাইকেলের প্রহসনটি সঠিক প্রহসন, যার চরিত্র ও ঘটনার বিশেষ কোনো প্রকাশ নেই। কিন্তু দীনবন্ধুর “সধবার একাদশী” প্রহসনটি সম্পুর্ণরূপে নাটকের ধারায় রচিত। প্রহসনটি নাট্য রসে ভরপুর এবং চরিত্র চিত্রনের মধ্যেও দক্ষতার পরিচয় রয়েছে।
নাটকটির মুখ্য চরিত্র নিমচাঁদ দত্ত এবং এই নিমচাঁদ চরিত্র অঙ্কনের জন্য নাটকটি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। মূখ্য চরিত্র নিমচাঁদ দত্তের সুখ-দুঃখ, সুতীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, মাতলামির ঝুঁকে হাস্যকর উক্তি ও আচরণ এই প্রহসনটিতে এক অভিনব রসের সৃষ্টি করেছে। নিমচাঁদ চরিত্রটি তখনকার সময়ের একটা আদর্শ চরিত্র। এই চরিত্রের মাধ্যমে নাট্যকার চিত্রায়িত করেছেন- নিম দত্ত উচ্চশিক্ষিত ও আদর্শবাদী হয়েও নিয়ন্ত্রণের অভাবে পানাসক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সে চরিত্রহীন লম্পট নয়, অন্য কোনো কু-স্বভাবও তার চরিত্রে নেই। মদ্যপানে সে অসংযত হয়ে পড়লেও শিক্ষা ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে মাতলামির নেশায়ও সর্বক্ষণ আত্মসচেতন। নিমচাঁদের প্রলাপের মধ্যে এক গভীর কারুণ্য আছে, যাতে পাঠকের হৃদয় সমবেদনায় সিক্ত হয়। যেমন -
So sweet was ne’er so fatal, I must weep
But they are cruel tears-
প্রহসনটির মুখ্য উদ্দেশ্য সামাজিক দোষ-ত্রুটি প্রদর্শন হলেও প্রহসনটির মধ্যে ট্রাজিক রসের ফল্গুধারা পাঠকদের হৃদয় আপ্লুত করে। “সধবার একাদশী” প্রহসনটিতে চরিত্র চিত্রণগুলি অত্যন্ত স্বাভাবিক, ঘটিরাম ডেপুটি, রামমাণিক্য, কাঞ্চন, অটল, ভোলা – প্রত্যেকটি চরিত্রই জীবন্ত ও বাস্তব চরিত্ররূপে চিত্রিত।
বঙ্কিমচন্দ্র দীনবন্ধুকে “সধবার একাদশী” প্রহসনটি প্রকাশ করতে বারণ করেছিলেন, কিন্তু আমাদের পরম সৌভাগ্যের বিষয় হলো দীনবন্ধু তাঁর বন্ধুর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে “সধবার একাদশী” প্রহসনটি প্রকাশ করেন। “সধবার একাদশী” প্রকাশিত না হলে বাংলা সাহিত্যের এই উৎকৃষ্ট প্রহসন নাট্যামোদী জনগণের কাছে অজানা থেকে যেত। প্রহসন নাটকের প্রাণ হলো হাস্যরস আর উদ্দেশ্য হলো সমাজ সংশোধন। তাই দীনবন্ধু মিত্রের “সধবার একাদশী”এর অবিসংবাদিত ভাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীনবন্ধু ঈশ্বরগুপ্তের ভাবশিষ্য ছিলেন। কিশোর বয়সে ‘সংবাদ প্রভাকর’এ তিনি অনেক গদ্য-পদ্য রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে ঈশ্বরগুপ্তের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে গদ্য-পদ্য রচনার ধারাকে সুরক্ষিত করেছিলেন। তাঁর ‘সুরধুনী কাব্য’ (১৮৭১-৭৬), দ্বাদশ কবিতা (১৮৭২) নামে ‘কবিতা গুচ্ছ’ এবং ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ও ‘পোড়া মহেশ্বর’ শীর্ষক গদ্য দুটি নেহাৎ বিশেষ কোনো প্রতিভা ব্যঞ্জক হয় নাই। তবে ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এ লেখক তাঁর পরিহাসপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।লেখক দীনবন্ধু মিত্রের নাট্য স্বভাবের বৈশিষ্ট্য
১) দীনবন্ধু মিত্রের নাট্য স্বভাব সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের উপলব্ধি অনুযায়ী সর্বব্যপী সামাজিক অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সহানুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন। দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের ক্ষেত্রে এই দুইটি গুণের সমাহার সর্বব্যপী ছড়িয়ে আছে।
২) দীনবন্ধু মিত্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বাস্তববাদী লেখক।
৩) দীনবন্ধু মিত্রের নাটকগুলি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপ্রাকৃত ও নিষ্প্রাণ বলে মনে হয়েছে। তবে কিছু কিছু চরিত্র কল্পনায় এবং সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে নাট্যকার সবিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
৪) “নীলদর্পণ”এর নাট্যকার হিসাবে দীনবন্ধু মিত্রের খ্যাতি অনস্বীকার্য। বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে এখনও দীনবন্ধুর “নীলদর্পণ” এবং “সধবার একাদশী” অভিনীত হয়।
৫) বঙ্কিমচন্দ্র দীনবন্ধুর জবানীতে লিখেছিলেন- “অনেক সময়েই তাঁহাকে মূর্তিমান হাস্যরস বলিয়া মনে হইত। দেখা গিয়াছে যে, অনেকে ‘আর হাসিতে পারি না’ বলিয়া তাঁহার নিকট হইতে পলায়ন করিয়াছে।“দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসন ও নাটকগুলি স্বভাবজাত পরিহাসপটুতা বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় সাক্ষ্য। জলধর, নিমচাঁদ, কেনারাম, বিন্দুবাসিনী, বগলা, রাজীব প্রভৃতি কৌতুক রসাশ্রিত চরিত্রগুলির উপস্থাপনা সত্যিই প্রাণবন্ত। এই প্রসঙ্গে অজিতকুমার ঘোষ জানিয়েছেন, “দীনবন্ধুর হাস্যরসে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাবল্য সর্বাপেক্ষা বেশি, কিন্তু তাঁহার হাস্যরস শুধু সশব্দ ফেনিল, কলোচ্ছ্বাসে শেষ হইয়া যায় না, তাহার গভীরতর স্তরে জীবনের একটি সত্যোপলব্ধি, একটি ক্ষমাসুন্দর, মমতা-করুণ দৃষ্টি বিরাজ করে। “(বঙ্গ সাহিত্যের হাস্যরসের ধারা- ১৯৬০)
৬) সমালোচক মহলে দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্য রুচি সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠেছে। নাটকের ভাবধারা, স্থান বিশেষে স্থূলতা ও ভাষা অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট বলে কখনো মনে হতে পারে। কিন্তু শিল্পীসত্ত্বা ও বিশ্লেষণে দুর্লভ নাটকীয় নির্লিপ্ততাই প্রমাণিত হয়। তাঁর লেখা চরিত্র গুলির স্বভাবসুলভ স্থূলতা ও নিম্ন রুচির কথা ধরা পড়ে।
৭) ঈশ্বরগুপ্তের অনুকরণকারী দীনবন্ধু মিত্র বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে পরিচিত। দীনবন্ধুর শিল্পীসত্ত্বার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাঁর বস্তুচেতনা, আর এই চেতনার উৎস শিল্পীর অভিজ্ঞতাজাত। তিনি বাংলার মানুষকে নিতান্ত নিকট থেকে দেখেছেন, তাদের সংস্পর্শে এসেছেন আর তাদেরকেই তাঁর সাহিত্যে চরিত্র হিসাবে চিত্রিত করেছেন।
মৃত্যু
চাকুরি জীবনে বার বার বদলীর ফলে লেখক দীনবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় ১৮ বছর চাকুরির পর ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে অকালে পরলোক গমন করেন। তিনি আরও দীর্ঘজীবি হলে বাংলা নাট্যজগত আরও অনেক সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠত।
প্রবন্ধ: তনুশ্রী চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ড. দেবেশ কুমার আচার্য
There are no reviews yet.