ধাঁধা
লোকসাহিত্যের একটি অন্যতম বিষয় হল ধাঁধা। প্রাচীনকাল থেকেই ধাঁধা সাধারণ জনমানুষের শিক্ষার একটি অন্যতম উপায়। ধাঁধা জনসাধারণের নিজ অভিজ্ঞতকে প্রশ্ন আকারে লিপিবদ্ধ করে। তাছাড়া ধাঁধা সাধারণ জনসাধারণের মনে জীবন ও জগৎকে জানার কৌতুহল জাগিয়ে তুলে। যে বাক্যের মধ্যে একটি মাত্র ভাব রূপকের সাহায্যে জিজ্ঞাসাকারে প্রকাশ করা হয় তাকেই আমরা ধাঁধা বলতে পারি। ধাঁধা শুধু ধন্দ লাগায় না, দ্বন্দ্বের ও সৃষ্টি করে।
সংস্কৃত "দ্বন্দ্ব' শব্দজাত "ধন্ধ' থেকে ধাঁধা শব্দের উৎপত্তি (দ্বন্দ্ব>ধন্দ>ধন্ধ>ধাঁধা)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর "বঙ্গীয় শব্দকোষ' এ ধাঁধা শব্দের অর্থ করেছেন কৌতুককর কূট প্রশ্ন বা হেয়াঁলি (Puzzle)। রাজশেখর বসু "চলন্তিকায়' ধাঁধা শব্দকে "দ্বন্দ্ব' শব্দজাত বলে অর্থ করেছেন "কৌতূহলজনক দুরূহ প্রশ্ন'। ইংরেজিতে ধাঁধাকে বলা হয় "riddle', যার উৎপত্তি অ্যংলো স্যাকসন শব্দ "Readin' থেকে। বাংলায় হেঁয়ালিও বলা হয়। মনে করা হয় যে হেঁয়ালির উৎপত্তি সংস্কৃত প্রহেলিকা থেকে হয়েছে। ভারতের পশ্চিম বাংলার নানান অঞ্চলে ধাঁধার বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে। এলোমেলো বা ছড়ানো বস্তুর ভাবনাকে সুসংবদ্ধ বাক্যের যে সংক্ষিপ্ত রূপ বা আকার ভাষায় প্রকাশ পায় তাইই ধাঁধা। ধাঁধার মূল বিষয় হল "উত্তর' ধাঁধার মধ্যরূপে প্রশ্নকর্তা গুছিয়ে যা একত্রিত করেন উত্তরদাতা কে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ধাঁধার প্রশ্ন এবং উত্তর উভয়েই একত্রিত হয়ে ধাঁধার পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে।
ড. কৃষ্ণ খাঁ ধাঁধার সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে লিখেছেন,
"খাদ্য ও নিরাপত্তা সন্ধানী আদিম মানুষের যাদু বিশ্বাস থেকে উৎপন্ন, সমাজ বিবর্তনের ধারায় কখনও বুদ্ধিবিচারক, কখনও স্মৃতি পরীক্ষকের ভূমিকায় অবত্তীর্ণ হয়ে ঐতিহ্যানুসারী লোক শিক্ষাকে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চারিত করার উদ্দেশ্যে, কৌতুকরসের আঁধারে, আপাত বিভ্রান্তিকর, চাতুর্যপূর্ণ, দুরূহ, প্রতীকধর্মী মৌখিক প্রশ্ন, যার উত্তরও লোকায়ত সমাজে ঐতিহ্যানুসারেই স্থিরীকৃত তাঁকেই বলা হয় ধাঁধা।'
লোকসাহিত্যে ধাঁধা সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। তাছাড়া নানান ধর্মগ্রন্থে ও ধাঁধার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ঋগ্বেদ, ভারতীয় পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত। ধাঁধা যে রূপ রসের সামগ্রী সেরূপ জ্ঞানের ও বিষয়। চমক বা তাক লাগানোর প্রয়াসে কখন ও কখন ও ধাঁধা রচিত হয়। তাছাড়া এর মধ্য দিয়ে উপস্থিত বুদ্ধি পরীক্ষা করা হয়। সৌন্দর্যবোধ, প্রখল বুদ্ধিদীপ্তী, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি, চিন্তার উৎকর্ষতা, মননশীলতা, কৌতুক সৃষ্টি, স্মৃতি চর্চা, প্রতীক ব্যাবহারের প্রবণতা, নির্মল আনন্দ দান ও রসবোধ প্রভূতি ধারায় বিদ্বমান। ধাঁধার মধ্যে এক আক্রমণাত্বক ভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় । তাছাড়া কোনো কোনো ধাধায় যে রূপ পুরস্কারের আভাস পাওয়া যায় সে রূপ কোনো কোনো ধাঁধায় দুর্বোধ্য শব্দ ও ব্যবহৃত হয়, যা অনাবশ্যক। ধাঁধা গদ্য ও পদ্য দুভাবেই রচিত হতে পারে। যার প্রধান গুণ সংক্ষিপ্ততা। ধাঁধার সঙ্গে ছড়া ও প্রবাদের মিল ও অমিল লক্ষ্য করা যায়।
সাধারণ প্রকৃতির নিত্য পরিচিত জিনিস থেকে শুরু করে আমাদের নিজ পরিচিত জিনিস বা বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বহু জিনিস ধাঁধার বিষয়বস্তু হয়ে থাকে ।
ধাঁধা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত :
১. লৌকিক
লোকিক ধাঁধায় বিষয়বস্তু কে সহজ কথায় সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশ করা হয়।
লৌকিক ধাঁধা কে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় :
১. নরনারী ও দেব দেবী বিষয়ক:
(ক) মানুষ ও তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ
(খ) ইতিহাস প্রসিদ্ধ পুরুষ ও নারী
(গ) পৌরাণিক চরিত্র
(ঘ) দেবদেবী
২. প্রকৃতি বিষয়ক:
(ক)উদ্ভিদ ও লতাপাতা সংক্রান্ত
(খ) আকাশ গ্রহ নক্ষত্র ও প্রকৃতি
৩. গার্হস্থ্য জীবন বিষয়ক:
(ক) আত্মীয় সম্পর্কীয় ও অনাত্মীয় অথচ কাছের মানুষ
(খ) খাদ্যবস্তু
(গ) দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র
(ঘ) আচার আচরণ অভ্যাস
(ঙ) আচার অনুষ্ঠান ক্রিয়াকর্ম
৪. পশুপাখি ও কীটপতঙ্গ বিষয়ক
৫. বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক
৬. আখ্যান বা কাহিনিমূলক
৭. গাণিতিক বা সংখ্যামূলক
৮. বিবিধ বিষয়ক
২. সাহিত্যাশ্রয়ী
লৌকিক ধাঁধায় যে বিষয় টিকে সহজ কথায় সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশ করা হয় সাহিত্যিক ধাঁধায় তারই বিচিত্র রূপ অলংকারের সাথে ব্যক্ত করা হয়। বৈদিক কাল থেকে সাহিত্যিক ধাঁধার ব্যাবহার চলে আসছ। চর্যাপদ, চণ্ডী মঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিব মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্যে গুপিচন্দ্রের গানে, গর্খো বিজয়ে, বাউলগানে, কবিগানে, বহু সাহিত্যিক ধাঁধার সন্ধান পাওয়া যায় ।
বাংলা সমাজে বিবাহ বাসর থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে, গ্রাম্য মজলিসে আমোদ প্রমোদের উপকরণ হিসেবে ও ধাঁধার প্রচলন বহুল। ধাঁধা সর্বসাধারণের কাছে সমানভাবে আনন্দের বিষয় ও কৌতূহল জনক। যেমন:
"বন থেকে বেরুল টিয়ে
সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।'
আলোচ্য ধাঁধায় একদিকে যেমন সৌন্দর্যবোধ বা রসবোধ ফুটে উঠেছে অন্যদিকে তেমনি উপস্থিত বুদ্ধি বা স্মৃতিচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। ধাঁধা যেমন শিশু জীবনের পরম সম্পদ তেমনি বয়স্ক মানুষেরও পরম সম্পদ। ধাঁধার মৌল আবেদন অতীতে যা ছিল ভবিষ্যতে ও তা থাকবে যা মানব জীবনের এক কৌতুহলজনক ও শিক্ষার বিষয়।
ধাঁধার বৈশিষ্ট্য
১. ধাঁধা কৌতুহলদ্দীপক, অর্থাৎ যা মানুষের মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে তুলে।
২. কূট বা দুরূহ কঠিন অর্থাৎ সাধারণ বুদ্ধ্যাঙ্ক দিয়ে যার সমাধান সম্ভব নয়।
৩. হেঁয়ালি Mistifying, Misleading বা Puzzling প্রভৃতি শব্দগুলি ধাঁধার রহস্যময়, কুয়াশাচ্ছন্ন, বিভ্রান্তিকর বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে।
৪. কৌতুককর ধাঁধা যেমন কৌতূহলদ্দীপক, তেমনি কৌতুককরও বটে। বরুণকুমার চক্রবর্তী ধাঁধাকে বলেছেন "কৌতুক সৃষ্টির আঁধার'।
৫. ধাঁধাতে বক্তা এবং শ্রোতা উভয়েই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, কারন প্রশ্ন ও উত্তর এই দুটি অংশের যৌথ মিলনেই ধাঁধার অস্তিত্ব পূর্ণতা লাভ করে।
তথ্যসূত্র:
১.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
২. বাংলাপিডিয়া
(প্রকাশিত: ১৮.০৬.২০২১)
প্রবন্ধ: সুপ্রিতা নাথ
There are no reviews yet.