ছৌ নাচ
লোকসাহিত্যের আঙিনার এক বিশেষ শৈলী প্রদর্শনকারী মুখোশ নৃত্য হিসেবে প্রসিদ্ধ ছৌ নাচ। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত তথা পুরুলিয়া তথা এক আদিম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ধারা হলো ছৌ নাচ। এটি এক ধরনের মুখোশ নৃত্য। ভারতীয় দেব-দেবী, দৈত্য-রাক্ষস, নর-বানর চরিত্রগুলির অনুরূপ মুখোশ তৈরি করে তার দ্বারা সজ্জিত হয়ে এই নাচ করা হয়।এটি এক অপরূপ নৃত্যশৈলী। শুধুমাত্র মুখোশ পরিধান করেই এর শেষ নয়, শারীরিক কসরতের মধ্য দিয়ে এই নৃত্যের প্রদর্শন করা হয়। পুরুলিয়া জেলা তথা মানভূম অঞ্চলে মুখোশ পরে এই নাচ হতো। পরবর্তিতে এটি শুধুমাত্র পুরুলিয়া জেলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বা পার্শ্ববর্তী এলাকা যেমন ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, সেরাইকেল্লা প্রভৃতি স্থানেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পুরুলিয়া অঞ্চলের এই নাচটি বিশ্বের দরবারে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
ছৌ নাচটি মূলত বীর রসের নৃত্য। পুরুলিয়া জেলায় অনেক মুখোশ ব্যবহৃত হয়। এই জেলায় ছৌ নাচের অঙ্গভঙ্গি ও পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। জেলার "বারো মাসে তেরো পার্বণ'-এ লোক জমায়েত হয়ে আসর বসে। এই নৃত্যের অংশমূলে যে শিব গাজনের প্রভাব তা একপ্রকার স্বীকার্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই নৃত্য প্রদর্শনকারী নাচের তাল, ভঙ্গিমা, রসনিষ্পত্তি লক্ষ্য করে একে যুদ্ধ নৃত্য বা সৈন্যের আরামস্হল ছাউনির নৃত্য বলেন। বিশেষ করে চৈত্র গাজন বা ভগতাপরব, কালীপূজা, দুর্গাপূজা অন্যান্য গ্রামীণ দেব-দেবীর পূজা উপলক্ষে ছৌ নাচের আসর পরিলক্ষিত হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি অবলম্বন করে ছৌ নাচের একটি পালা পরিবেশিত হয়। একটি নির্দিষ্ট তাল, ছন্দ মিলিয়ে এর আসর জমে ওঠে এবং সকলেই এই পালা উপভোগ করে। পুরুলিয়া অঞ্চলের অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে, যেমন- কূর্মি, ভূমিজ, হাড়ি, বাউরি প্রভৃতি গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকেরা। পুরুলিয়া ছৌ নাচের সৌন্দর্য ও পরিপাট্য নাচটিকে একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ প্রদর্শিত হয়।
ছৌনাচে অচ্ছেদ্যভাবে কোনো গান যুক্ত নেই, তথাপি প্রত্যেকটি পালা শুরু হওয়ার আগে সেই পালার পরিচয়সূচক একটি করে গান গাওয়া হয়। একে "রঙ' বা "রঙঝুমুর' বলে। যেমন মহাভারতের "অভিমুন্য বধ' পালাটি আসরে অভিনীত হলে ঝুমুর গায়ক আসরের চারধারে ঘুরে ঘুরে গান ধরেন-
"কোথা আছহে মামা শ্রীমধুসূদন।
বিপদ সময়ে হরি দাও দরশন।।
কোথা পিতা আর্যবীর কোথা রাজা যুধিষ্ঠির।
কোথায় আছো বীর বলরাম।।' ...ইত্যাদি।
পালাটি যখন শুরু হয় তখন ধামাসায় গুমগুম শব্দ করে একটি শব্দ গড়ে ওঠে এবং সানাই ও ঢোলের মধ্যে অভিমুন্য বধের সুর উঠতে থাকবে। এইভাবে সুর অনুসরণ করে হাতে অস্ত্র ও মুখে মুখোশ পরিধান করে আসলে প্রবেশ করবে অভিমুন্য। এভাবে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি এবং পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি পালাক্রমে ছৌ নাচের মধ্য দিয়ে টুকরো টুকরোভাবে আসরে হাজির হয়। এবার কোনো জায়গায় রাজা দশরথের অন্ত্যেষ্টি থেকে আরম্ভ করে রাবণ বধ পর্যন্ত সম্পূর্ণ রামায়ণ নিয়েও সারারাত ধরে ছৌ নাচ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ছৌনাচটি মূলত পূর্ণরাত্রির নৃত্য অনুষ্ঠান। খোলা আকাশের নিচে, যাত্রা যেমনভাবে করা হয়, ঠিক তেমনভাবে গোল হয়ে, মাটির উপরে নৃত্য পরিবেশন করা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত যতদিন বর্ষা না নামে ততদিন পর্যন্ত কোনো না কোনো গ্রামে একটা না একটা আসর দেখতে পাওয়া যায়। ছৌ নাচের পোষাক হলো মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, আবার একে "ঘুটনা'ও বলা হয়ে থাকে। যদিও এখনকার সময়ে যাত্রার পোশাক ব্যবহারের চল রয়েছে। এই নাচের সরলতা, উদ্দামতা, ধীরভাব, চরিত্রানুযায়ী স্বাভাবিক মুখোশ এবং কাহিনি একে একে উচ্চাঙ্গ নৃত্য নাট্যের মর্যাদা লাভ করেছে। ছৌ নাচের আরম্ভে "গণেশ বন্দনা' হওয়ার প্রথা আছে।
ছৌ-নাচের উৎস মূলত গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে। সেখানে "কাপঝাপ' নৃত্যশৈলী প্রদর্শন করা হয়। কাপঝাপ হলো একধরনের সামাজিক নকশামূলক নাচ, যেখানে দেব চরিত্র, পশুপাখি ইত্যাদির এক অভিনব মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। ছৌ নাচ বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, ঝাড়খণ্ডের সেরাইকেল্লা, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর অঞ্চলে প্রচলন সর্বাধিক। এই ত্রিস্রোতা ধারার মধ্যে ভাগগত ও রূপগত পার্থক্য সুপ্রচুর। উড়িষ্যার ছৌনাচে মুখোশের ব্যবহার করতে দেখা যায় না। শুধুমাত্র প্রসাধন ব্যবহারের রীতি দেখা যায়। আবার সেরাইকেল্লায় পাতলা কাগজের মন্ড দিয়ে মুখোশ তৈরির ব্যবহার করা দেখা যায়। পুরুলিয়ার কাগজের মন্ড দিয়ে সুন্দর অলংকরণ মুখোশ পরিলক্ষিত হয়। এই নাচে সহকারী বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঢোল, সানাই, ধামসা প্রভৃতি। ছৌ নাচ একসময় রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রসপুষ্ট হয়েছিল। রাজার ক্ষমতার অবসানে কালের নির্মম নিয়মে এই নৃত্যধারা এসেছে লোকজীবনের মৃন্ময় আসরে। ছৌনাচ সীমান্ত বাংলার মাহাতো, কুর্মিমণ্ডাদের মধ্যে ব্যাপক অনুশীলিত এবং প্রচলিত বিষয়। বীর রসই হলো ছৌ নাচের প্রধান রস। শিকারী বা কিরাত নৃত্য ছৌনাচের মূল উপজীব্য বিষয়। নাচের মধ্যে একদিকে প্রকাশ পায় বলিষ্ট লোকজীবন বাসনার আকুতি, যার মূল উৎস হচ্ছে আদিম সমাজের মৃত্তিকাশ্রয়ী বাসনা, কামনা ও প্রকৃতি পরিবেশ।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের কিছু লক্ষণ ছৌ নাচে পরিলক্ষিত হয়। বিবর্তনের বিভিন্নস্তরে ছৌ নৃত্য আদিম সাহিত্যের নানা বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে আদিবাসী ও লোকনৃত্যের বিভিন্ন উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এই নাচের মধ্যে লুকিয়ে আছে আদিম মানুষের বিশ্বাস, ভালোবাসা ও যুদ্ধ শিকারের ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ।
ছৌনাচের উদ্ভবের সঙ্গে চৈত্রসংক্রান্তি অথবা শিবের গাজন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। পুরুলিয়ার ছৌ নাচের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায় চৈত্রসংক্রান্তির ভগতাপরব অর্থাৎ শিবপূজা উপলক্ষে কাপঝাঁপ এর মধ্যে। ছৌনাচের নামকরণ সম্পর্কে আবার অনেক মতবিরোধও আছে। অঞ্চলভেদে বা আঞ্চলিক উচ্চারণ মতে ছৌনাচের অনেক নাম দেখা যায়। অনেকে এই নাচকে "ছো', "ছ', 'ছউ', "ছাউ' ইত্যাদি নামে সম্বোধন করলেও সুপরিচিত নামটি আসলে "ছৌ'। "ছৌ' শব্দটির অর্থ "সঙ', "ছায়া' অথবা "ছাউনি'। চৈত্র পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য অঙ্গ হল সন্ন্যাসী ও ভক্তদের নানা ধরনের সাজে সজ্জিত হওয়া। ছৌনাচের পৌরাণিক ও সামাজিক সমস্ত চরিত্র হলো কাহিনীনির্ভর। সরল, স্বতঃস্ফূর্ত চলমান জীবনের বাস্তব জনস্বত্ত্বা নিয়ে ছৌ নাচ পরিপূর্ণ। ছৌ নাচের মূলরস মূলত বীররস অর্থাৎ যুদ্ধ। পুরুলিয়ার প্রায় প্রতিটি ছৌনাচের পালায় যুদ্ধ একটি অতি আবশ্যক অনুষঙ্গ এবং পালাগুলি যুদ্ধে চরম উত্তেজনার মধ্যে পরিসমাপ্তি লাভ করে।
আদিবাসী ও উপজাতীয় শিল্পীদের শারীরিক ক্ষমতা ও নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহনকারী হিসেবে ছৌনাচ প্রসিদ্ধ। অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়েও গ্রামের দরিদ্র লোকেরা এই লোকনৃত্যটিকে সযত্নে লালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। গম্ভীর সিংমুড়া পুরুলিয়া ছৌ নাচের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। ১৯৮১ সালে তিনি ছৌনাচের জন্য "পদ্মশ্রী' পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৮৩ সালে "সংগীত নাটক আকাদেমি' পুরস্কারে ভূষিত হন।
ছৌনাচে নানাধরনের গতি ও চলনভঙ্গী ফুটে উঠে। লাফ বা উলফা ছৌনাচের প্রধান আকর্ষণ। মঞ্জুরভঞ্জের ছৌনাচ তার পৌরুষদীপ্ত অঙ্গসঞ্চালন ও সামরিক ভূমিকার সঙ্গে যুক্ত করেছে এক সুরসমৃদ্ধ কাব্যময়তা। লোকসাহিত্যের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তেমনি পাঠকদের দরবারেও তার চাহিদা প্রচুর।
তথ্যসূত্র:
১) https://bn.m.wikipedia.org
২) https://www.anondobazar.com
৩) https://www.sahapedia.org
৪) বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ, বরুণকুমার চক্রবর্তী। পৃষ্টা নং- ১৮৮।
প্রবন্ধ: অপরাজিতা ভট্টাচার্য
(প্রকাশিত: ১৬.০৬.২০২১)
There are no reviews yet.