চন্দ্র কুমার দে (১৮৮৯- ১৯৪৬)
চন্দ্র কুমার দে ময়মনসিংহ জেলার আইথর গ্রামে ১৮৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামকুমার দে এবং মাতার নাম তারাসুন্দরী দেবী। তাদের পূর্ব পুরুষদের নিবাস ছিল রাঘবপুর গ্রামে। তিনি অতি অল্প বয়সেই পিতা মাতা উভয়কেই হারান এবং সেই সময় থেকেই তাকে উপার্জনের জন্য কাজ করতে হয়েছিল। আর্থিক অসংগতির জন্য গতানুগতিক লেখা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। সংস্কৃত সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান লাভ ছাড়া তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেন নি।
শিক্ষা জীবন
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই তাকে গ্রামের এক মুদি দোকানে এক টাকা মাইনের চাকরি নিতে হয়। কিন্তু দোকানের খাতায় হিসাব নিকাশ এর বদলে ছড়া, কবিতা লিখে রাখায় মালিক বিরক্ত হয়ে তাকে দোকান থেকে বের করে দেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ময়মনসিংহ এর "সৌরভ' পত্রিকায় তার "মহিলা কবি চন্দ্রাবতী' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এরপর কেদার নাথ মজুমদার এর উৎসাহে ওই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। কেদার নাথ মজুমদার এর সহযোগিতাতেই গৌরীপুরের কালিপুর এস্টেটের জমিদার বিজয়কান্ত লাহিড়ীর অধীনে মাসিক আট টাকা বেতনে তহশিলদারের একটি চাকরি পান চন্দ্র কুমার দে। এ চাকরির সুযোগে চন্দ্র কুমার এর গ্রাম-গঞ্জে ঘোরার সুযোগ আরোও বেড়ে যায়। কিন্তু গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে তহশিল এর বদলে তিনি লিখে আনতে লাগলেন পল্লীর গায়েনদের গাওয়া উপাখ্যান। এ সব কারণে একদিন চন্দ্র কুমার এর এই চাকরিটিও হারাতে হয়।
কর্ম জীবন
চন্দ্র কুমার দে একজন কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু তবুও গীতিকার সংগ্রাহক হিসাবেই বাংলা গীতিকাচর্চা তথা লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দীনেশ চন্দ্র সেন এর প্রচেষ্টায় চন্দ্র কুমার দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক ৭০ টাকা বেতনে সংগ্রাহক হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি মোট ২৫ টি গীতিকা সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত গীতিকা গুলোর ভাষাগত বহুবিধ ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও এগুলো লোক সাহিত্য সংগ্রহে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়ে ছিল। দেশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি র উদ্ধার ও সংরক্ষণের মধ্যে যে দেশ প্রেম ও জাতীয়তার প্রকাশ ঘটতে পারে চন্দ্র কুমার এর একনিষ্ঠ সংগ্রহ গুলোই তার উজ্জ্বল নিদর্শন।
মৈমনসিংহ গীতিকার মূল সংগ্রাহক ছিলেন চন্দ্র কুমার দে। প্রধান আলোচকের আলোচনায় প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার বলেন "চন্দ্র কুমার দে এর জীবন ছিল কন্টকাকীর্ণ।প্রতিকূল অবস্থার মাঝেই গ্রামে গ্রামে বেরিয়ে পালা ও লোক সাহিত্য সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার পূর্ণ করেন। চন্দ্র কুমার এর এই পালা ও গীতি সংগ্রহই আজ বাংলাদেশ এর সম্পদ। যতীন সরকার আরও বলেন চন্দ্র কুমার দে এর সংগৃহীত ও রচিত চন্দ্রাবতী, মহুয়া, মলুয়া, কঙ্কাবতী এই সব পালা গানের ভাষা ও কাহিনি বাংলাদেশ এর আর কোথাও নেই। চন্দ্র কুমার এর মর্যাদায় বাংলা একাডেমি যে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে সত্যিই প্রশংসনীয়।'
সংগ্রহ
চন্দ্র কুমার দে যে সব লোক সাহিত্য সংগ্রহ করেছেন সেগুলো দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে "মৈমনসিংহ গীতিকা' (১৯২৩) এবং "পূর্ববঙ্গ গীতিকা' (১৯২৩- ১৯৩২) নামে প্রকাশ করেন। তিনি মোট পঁচিশটি গীতকা সংগ্রহ করেন, যেগুলি "পূর্ববঙ্গ গিতিকা'র বিভিন্ন খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
ময়মনসিংহ গীতিকা
১. মহুয়া
২. মলুয়া
৩. চন্দ্রাবতী
৪. কমলা
৫. দেওয়ান ভাবনা
৬. রূপবতী
৭. কঙ্ক ও লীলা
৮. কাজল রেখা
৯. দেওয়ানা মদিনা
১০. দস্যু কেনারামের পালা
পূর্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)
১১. ধোপার পাট
১২. মইষাল বন্ধু
১৩. ভেলুয়া
১৪. কমলা রানীর গান
১৫.দেওয়ান ঈশা খাঁ মসনদ আলি
১৬. ফিরজ খাঁ দেওয়ান
১৭. আয়না বিবি
১৮. শ্যাম রায়ের পালা
পূর্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড)
১৯. শিলা দেবী
পূর্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, ২য় সংখ্যা)
২০. আঁধা বন্ধু
২১. বাংলার বারোমাসি
২২. রতন ঠাকুরের পালা
২৩. পীর বাতাসী
২৪. জিরালানি
২৫. সোনারায়ের গান
২৬. ভারইয়া রাজার কাহিনী
এই পালাগুলোর অধিকাংশই ময়মনসিংহ ও সিলেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
মুত্যু
চন্দ্র কুমার দে ১৯৪৬ সালে ময়মনসিংহ এর নওমহলে বসবাসকালীন এস. কে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ময়মনসিংহ এর ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অবস্থিত কেওয়াটখালি শ্মশান ঘাটে চ্ন্দ্রকুমার দেকে দাহ করা হয়। পরিবার পরিজনরা তাঁর স্মৃতিরক্ষার জন্য সেখানে একটি ছাতার আকৃতির স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তি যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী তা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।
প্রবন্ধ: তন্ময়ী চৌধুরী
তথ্যসূত্র:
১.বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতি কোষ, বরুণ কুমার চক্রবর্তী
২. উইকি পিডিয়া
৩. বাংলা পিডিয়া
(প্রকাশিত: ২১-০৫-২০২১)
There are no reviews yet.