বিনোদিনী দাসী (১৮৬৩-১৯৪১)
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের আদিপর্বের অভিনেত্রী ছিলেন বিনোদিনী। তাঁর অভিনয় জীবন খুব অল্প হলেও সেই সল্প সময়ে-ই তিনি তাঁর নাট্য প্রতিভার দ্বারা দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। তাঁর অতুলনীয় অভিনয় প্রতিভা, ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার এবং অভিনয়ের প্রতি আত্মসমর্পণ-ই তাঁকে উনবিংশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর আসন দিয়েছিল। সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় বিনোদিনীর অতুলনীয় অভিনয়ের উল্লেখ আছে।
জন্ম ও পরিবার:
বিনোদিনী আনুমানিক ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। "আমার কথা' পাঠে তাঁর বাল্য জীবন এবং পরিবার সম্পর্কে জানা যায়, বাল্যকালে তিনি, তাঁর মা ও ভাই এর সাথে মাতামহীর ১৪৫নং কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের (অধুনা বিধান সরণি) বাড়িতে বাস করতেন। তারা দরিদ্র ছিলেন বলে তাঁর ভাইকে ভালো চিকিৎসার অভাবে মরতে হয়েছিল।সাত-আট বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু স্বামীর মাসি বাল্যকালে-ই তাঁর স্বামীকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যান এবং আর আসতে দেন না তাই স্বামীর সাথে কখনই তাঁর যোগাযোগ ছিল না।
শিক্ষা জীবন:
বিনোদিনীর শিক্ষার বিষয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে বিশেষ কিছু জানা যায় না শুধুমাত্র নাট্য শিক্ষা সঙ্গীত শিক্ষা এইসব জানা যায়। বিনোদিনীর সঙ্গীত শিক্ষিকা ছিলেন গঙ্গা বাঈজি, তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেখানেই বাস করতেন গঙ্গা বাঈজি, বিনোদিনীর মাতামহী কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁকে সঙ্গীত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। বিনোদিনীর অভিনয় গুরু ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
অভিনয় জীবন:
অতি অল্প বয়সে মাত্র ১১-১২ বছর বয়সে (১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ) তিনি প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে "শত্রুসংহার' নাটকের দ্রৌপদীর ভূমিকায়। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল ন্যাশনাল, স্টার থিয়েটারের তৎকালীন যাবতীয় শ্রেষ্ঠ নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের আদিপর্বের প্রতিভাশালিনী ও সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী বিনোদিনী তাঁর খ্যাতি ও ক্ষমতার চরমসিদ্ধির লগ্নে রঙ্গালয়ে সংস্রব চিরতরে ত্যাগ করেন।তার শেষ অভিনয় "বেল্লিক বাজার নাটকে' রঙ্গিনীর ভূমিকায়। মাত্র বারো বছরের অভিনয় জীবনে প্রায় ৮০ টি নাটকে ৯০টি ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
অভিনয় প্রতিভা:
গিরিশচন্দ্র লিখেছিলেন- "গুরুগম্ভীর ভূমিকায় বিনোদিনীর যেমন দক্ষতা হালকা ভূমিকায়ও তদ্রূপ ছিল।' ঐতিহাসিক হোক, সামাজিক বা পৌরাণিক-ই হোক, বিয়োগান্তক নাটক, প্রহসন কি পঞ্চরং সবেতেই তিনি অনবদ্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। একই নাটকে একাধিক ভূমিকায় অভিনয়ের আশ্চর্যান্বিত আদর্শ সৃজন করেছিলেন। মেঘ বদল নাট্যরূপ এ তিনি। "মেঘনাদ' এর নাট্যরূপ এ তিনি একই সঙ্গে প্রমীলা, বারুণী, রতি, মহামায়া ও সীতা এই ছয়টি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অনেক সময় একই রাতে বা কাছাকাছি ব্যবধানে সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী চরিত্রে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন যেমন-কুন্দনন্দিনী (বিষবৃক্ষ),কাঞ্চন (সধবার একাদশী), চিন্তামণি (বিল্বমঙ্গল), তরঙ্গিনী (বেল্লিক বাজার), চৈতন্য (চৈতন্য লীলা) ও বিলাসিনী কারফরমা (বিবাহ-বিভ্রাট)। তার অভিনয় প্রতিভা এতটাই প্রশংসনীয় ছিল যে বিডন স্ট্রিটে স্টার থিয়েটারে "চৈতন্যলীলা'য় বিনোদিনীর অভিনয় দেখে রামকৃষ্ণদেব তাঁকে আশীর্বাদ করেন চৈতন্য হোক (২১/৯/১৮৮৪)। তাছাড়া অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিরা বিনোদিনীর অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম হল বঙ্কিমচন্দ্র, ফাদার লাফোঁ, এডুইন আর্নলড, কর্নেল অলকট প্রমুখ দেশি-বিদেশি মনীষীবৃন্দ তার অভিনয়ের ভূয়শী প্রশংসা করে গেছেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ অদ্যাবধি অনতিক্রম্য।
বেঙ্গল থিয়েটার:
বেঙ্গল থিয়েটারের অধ্যক্ষ ছিলেন স্বর্গীয় শরৎ চন্দ্র ঘোষ। বিনোদিনী "আমার কথা' এর মধ্যে লিখেছিলেন- "এই বেঙ্গল থিয়েটারের আমার কার্যের উন্নতির মূল। প্রসিদ্ধা গায়িকা বনবিহারিনী, সুকুমারী দত্ত ও এলোকেশী সেইসময় "বেঙ্গলে' অভিনেত্রী ছিলেন। বেঙ্গল থিয়েটারের অভিনয় করবার সময় "ইংলিশম্যান' "স্টেটসম্যান' ইত্যাদি কাগজে বিনোদিনীকে কেউ কেউ সায়ানোরা কেউবা ফ্লাওয়ার অফ দি নেটিভ স্টেজ বলে উল্লেখ করতেন।
ন্যাশন্যাল থিয়েটার:
বিনোদিনী বেঙ্গল থিয়েটার ত্যাগ করে কেদারনাথ চৌধুরী মহাশয়ের ন্যাশনাল থিয়েটারে কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন। সেই সময় ন্যাশনাল থিয়েটার দুর্দশা দেখা দেয়, অল্পদিনের মধ্যেই থিয়েটার নিলামে বিক্রি হয় প্রতাপচাঁদ জহরি নামক জনৈক আমার মাড়োয়ারির কাছে। এবং গিরিশচন্দ্র পুনর্বার ম্যানেজার হলেন। এই থিয়েটারের প্রথম অভিনীত হয়েছিল কবিবর সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের রচিত "হামীর'। এর নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন বিনোদিনী। মায়াতরু গীতিনাট্য ফুল হাসির ভূমিকা দেখে "রিজ এন্ড রায়তের' সম্পাদক শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় বিনোদিনীর উদ্দেশ্যে লিখেন, "বিনোদিনী was simply charming'। ক্রমে থিয়েটারের অদ্ভুত উন্নতি দেখে থিয়েটারে স্বত্বাধিকারী প্রতাপচাঁদ একদিন বলেন- "বিনোদ তিল সমাত করন্তি'। তিল সমাত অর্থ হলো যাদু। বিনোদিনী যখন শরীর সুস্থ করার কারণে ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে কাশীধাম চলে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে তার অসুস্থতা আরো বাড়লো এবং তার ফিরতে প্রায় এক মাস হয়ে গেল, ফিরে এসে তিনি জানলেন যে প্রতাপ বাবু বিনোদিনীকে ছুটির বেতন দিতে নারাজ।গিরিশ ঘোষও প্রতাপচন্দ্রের বিরোধিতা করেছিলেন এবং এর থেকেই স্টার থিয়েটার নির্মাণের সূত্রপাত হয়।
স্টার থিয়েটার:
গুর্মুখ রায় স্টার থিয়েটার নির্মাণে উদ্যোগী হলেন কিন্তু তিনি স্টার থিয়েটার নির্মাণ করে দেওয়ার বদলে বিনোদিনীকে দাবি করেন। বিনোদিনী প্রথমে রাজি না হলেও পরে সবার অনুরোধে এবং থিয়েটারের স্বার্থে তিনি নিজেকে গুর্মুখের নিকট সমর্পণ করেন।পরে থিয়েটারের বদলে গুর্মুখ বিনোদিনীকে ৫০হাজার টাকা দিতে চাইলে বিনোদিনী সে টাকা নেন না তার বদলে তিনি থিয়েটার নির্মাণের দাবি করেন। বিনোদিনীকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে নতুন থিয়েটারের নাম হবে বিনোদিনীর নামে, বি-থিয়েটার। কিন্তু সেখানেও বিনোদিনীর সাথে ছলনা করা হয় এবং এতে তার শিক্ষাগুরু গিরিশ ঘোষও সামিল ছিলেন। নতুন থিয়েটারের নাম রাখা হয় স্টার থিয়েটার।
প্রতারণা এবং অভিনয় জীবনের সমাপ্তি:
থিয়েটারের স্বার্থে বিনোদিনী ধনী যুবক গোমুখ রায়ের থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন পরিবর্তে তিনি একটি নতুন থিয়েটার চেয়েছিলেন এবং যার জন্য তিনি গুর্মুখ রায়ের রক্ষিতা হয়ে থাকতেও প্রস্তুত ছিলেন। তার সহশিল্পীরা শুধুমাত্র তাকে প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে বিনোদিনী থিয়েটার দিতে পারলে তার নামে হবে থিয়েটারের নাম বি-থিয়েটার, আনন্দ উৎসাহে থিয়েটার তৈরির জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন কিন্তু গিরিশচন্দ্র প্রমুখ এর ব্যবহার তার হৃদয়কে অত্যন্ত ব্যথিত করে। থিয়েটারটির নাম বি থিয়েটার না রেখে, রাখা হয় স্টার থিয়েটার। বিনোদিনী অভিমানে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র বাইশ তেইশ বছর বয়সে অভিনেত্রী জীবন থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন গ্রহণ করেন তারপর আর কোনদিনই অভিনয় জগতে ফিরে আসেননি।
বিনোদিনীর লেখক সত্তা:
বিনোদিনীর দাসী প্রথমেই লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন নি। তিনি অতি অল্প বয়সে তিনি প্রথমে মঞ্চে অবতরণ করেন। মাত্র বারো বছরের অভিনয় জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আত্মজীবনী লেখায় ব্রতী হন। তার আত্মজীবনীর নাম হল- "আমার কথা'। ১৩৭১বঙ্গাব্দে বিনোদিনী দাসীর আমার কথা এর একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তা নিঃশেষিত হয়ে যায়। গিরিশচন্দ্র উপযুক্ত ভবিষ্যদ্বাণী-ই করেছিলেন— "যদি বঙ্গ রঙ্গালয় স্থায়ী হয়, বিনোদিনীর এই ক্ষুদ্র জীবন আগ্রহের সহিত অন্বেষীত ও পঠিত হইবে।' তাঁর আমার কথা পাঠ করলে সমকালের নাটক ও নাট্যশালার বহু তথ্য পাই। সেকালের অভিনয়ের ধারা ও দর্শকের নাট্য রুচি বা অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাটক পরিবেশনের অবস্থা, গিরিশচন্দ্রের নাট্য প্রতিভা এবং নাট্য শিক্ষার বিষয় জানতে পারি তাছাড়া বিভিন্ন রঙ্গালয়ের উত্থান পতনের কাহিনি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারি বলা যেতে পারে সেইসময়ের সম্পূর্ণ নাট্যজগতের সামগ্রিক রূপ পাওয়া যায় তাঁর রচনায়। লেখিকা হিসেবে বিনোদিনী গদ্য ও পদ্য রচনা আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। তখনকার যুগে দাঁড়িয়ে তিনি আত্মজীবনী লিখেছিলেন যা অনন্ত কাল পর্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। মহিলা আত্মজীবনীকারদের মধ্যে একমাত্র রসসুন্দরী দাসীর "আমার জীবন' ই বিনোদিনীর "আমার কথার' সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।আত্মজীবনীর ভূমিকা মাসের শুরুতেই লিখেছিলেন-"আমার এই মর্মবেদনার আবার ভূমিকা কি?ইহা কেবল অভাগিনীর হৃদয় যার জ্বালার ছায়া।' তার আত্মজীবনীতে আমরা তার বেদনা প্রকাশ পায় তিনি আরো লিখেছিলেন- "কাহার নিকটেই বা প্রাণের বেদনা জানাইব, তাই কালি কলমে আকিঁতে চেষ্টা করিয়াছি।' এর থেকে বোঝা যায় তাঁর লেখনীর মূল ভিত্তি হচ্ছে জীবনের মর্মবেদনা। কিন্তু বেদনা কমবেশি সবার জীবনে থাকে তবে সবাই বিনোদিনীর মত সুদক্ষ লেখিকা হতে পারেন না। লেখনীতে যে তাঁর অপরিসীম ছিল তা-ই পাঠকের সামনে ফুঁটে উঠে। শুধু আত্মজীবনী নয় তার প্রতিভার প্রমাণ আছে "বাসনা', "কনক ও নলিনী' কাব্যগ্রন্থের মধ্যেও। বলাবাহুল্য যে সেকালের মহিলা কবিদের কাব্যের তুলনায় তার কোন কোন কবিতা বেশি কাব্যগুণ সম্পন্ন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বিনোদিনী কেবল অভিনেত্রী হিসেবেই বিদগ্ধ ছিলেন না লেখিকা হিসেবেও দক্ষ ছিলেন।
শেষ জীবন:
শেষ জীবনটা বিনোদিনীর খুব একটা ভালো কেটেছে বলা যায় না। খুবই অনাদরে-অবহেলায় কেটেছে শোক ও পেয়েছেন জীবনে অনেক এবং শেষ বয়সে ও এর বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটেনি। থিয়েটার ত্যাগের পর তার একমাত্র কন্যা শকুন্তলার জন্ম এবং মাত্র ১৩ বছর বয়সে তারা মৃত্যু হয় (১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ )। বিনোদিনীর আশ্রয়দাতা পুরুষ (যার সামাজিক পরিচয় পাওয়া যায় না) যার সঙ্গে তিনি ৩১ বৎসরকাল সম্পর্কিত ছিলেন তার মৃত্যুতে(১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ) বিনোদিনী সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে বিনোদিনীর যেটুকু সময় ছিল। শেষ জীবনের যেটুকু ভগবান তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন সেই সব তার থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন এবং তার জন্যে শুধু দুঃখ, বেদনা আর একাকীত্বকে অবশিষ্ট রাখলেন।
মৃত্যু:
তিনি ১৯৪১ সালে কলকাতায় বিনোদিনী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রবন্ধ: স্নিগ্ধা আচার্য
(প্রকাশিত ২৭.০৬.২০২১)