বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (২৪শে অক্টোবর, ১৮৯৪ সাল-৩০শে জুলাই,১৯৮৭ সাল)
(জন্মসাল, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)
বাংলা কথাসাহিত্যের একটি শাখা হলো লঘু রসের গল্প-কাহিনি। রবীন্দ্রনাথ লঘু রসের কথাগ্রন্থের যে মার্জিত ও পরিশীলিত রীতি বেঁধে দিয়েছেন, এ যুগে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় সেই রীতির অনুসারী হয়ে অসামান্য প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার সাক্ষর রেখে গেছেন।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন
তাঁর জন্মসন নিয়ে মতভদ রয়েছে। সংসদ বাংলা চরিতাভিধান (২য় খণ্ড) গ্রন্থে ১৮৯৪ সাল, সাহিত্য সেবক মঞ্জুসা গ্রন্থে ১৮৯৬ এবং সুকুমার সেন তাঁর "বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থে ১৮৯৯ সাল লিখেছেন। বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার পাণ্ডূল গ্রামে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল বিপিনবিহারী মুখোপাধ্যায়। তাঁরা তিনপুরুষ যাবৎ বিহারের দ্বারভাঙ্গায় বসবাস করতেন, যদিও তাঁদের আদি নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার চাতরাতে।
বিভূতিভূষণের প্রাথমিক শিক্ষারম্ভ হয় দ্বারভাঙ্গার পীতাম্বরী বিদ্যালয়ে। পরে তিনি দ্বারভাঙ্গার রাজস্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি রিপন কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন এবং পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাশ করেন।
কর্মজীবন
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করার পর তাঁর বৈচিত্রময় কর্মজীবনের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে তিনি “ইন্ডিয়ান নেশন” পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন। তারপর তিনি বিহারের দ্বারভাঙ্গার মহারাজের সচীব পদে আসীন হন। পরবর্তীকালে কয়েক বছর শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মজীবনে ১৯১৬সাল থেকে ১৯৪২সাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা এবং ধনাঢ্য পরিবারে গৃহ-শিক্ষকতা করেছিলেন। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি দার পরিগ্রহ করেন নি।
সাহিত্য জীবন
অগণিত সৃষ্টি- প্রাচুর্যে বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজে লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তাঁর লোকপ্রিয়তা অবিস্মরণীয় করে রেখেছেন। তিনিই ছিলেন প্রকৃত হিউমার বা কৌতুক রসাশ্রয়ী গল্প-কাহিনির একচ্ছত্র অধিপতি। তাঁর হাস্য রসের গল্প-কাহিনির মধ্যে যে সূক্ষ্ম বেদনার স্পর্শ অনুভূত হয়, তা বাংলার আর কোনো লেখকের গল্প-কাহিনির মধ্যে তেমন অনুভূত করা যায় না। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় কাব্য রচনায় সমাজের অসংগতিকে কৌতুক রসে ব্যঞ্জনা করে তাঁর রচনাকে এক ভিন্ন মাত্রা দেন। কিন্তু সেই ব্যঙ্গাত্মক হাসির অন্তরালে যে এক বেদনার ফল্গুধারা প্রবহমান রয়েছে, তা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজ সম্পূর্ণ অবগত আছেন। এই অকালপক্ক ও বিমর্ষ চিন্তাভারগ্রস্ত বাঙালি সমাজে সুনির্মল হাসির ঝর্ণাধারায় বাংলা সাহিত্যাকাশে মুক্তধারা প্রবাহের সূচনা করেছেন। হাস্যরসের মূল উপাদান হলো সামাজিক মানুষের আচার-আচরণ ও ব্যবহারের অসংগতি বা অসংলগ্নতা। অসংগতির তারতম্য হেতু হাস্যরস কখনো কখনো উদ্ভট রসে বা তীব্র ব্যঙ্গরসে পরিবর্তিত হয়। তবে বিভূতিভূষণের রস সৃষ্টি ছিল সাবলীল ও মার্জিত। "আমার সাহিত্যজীবন' প্রবন্ধে লেখক জানিয়েছেন,
"হাসি নিয়েই মূল কারবারের চেষ্টা করেছি, কিন্তু মাঝে মাঝে অন্তরের তাগিদেই সব কিছু উলটে গেছে। এর কারণ নিজেকে যতটা জানি, বিষণ্ণতাই আমার মর্মের গঠনে যেন মূল উপাদান।'
লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও ছোটোগল্পকার। রসাত্মক রচনায়ও তাঁর রয়েছে অসামান্য দক্ষতা। তিনি অনেক কৌতুক রসাত্মক গল্প ও রঙ্গ রসের গল্পও লিখেছেন। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাসটি হলো “নীলাঙ্গুরীয়”। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কৌতুকরসের গল্পের বই “বরযাত্রী”র ছয় বন্ধু গণশা, ঘোঁতনা, ত্রিলোচন, গোরাচাঁদ, রাজেন আর কে. গুপ্ত বাংলা রস সাহিত্যের পরিচিত চরিত্র। অল্প কথায় জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টি বা একটা সমাজকে সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরতে তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কৌতুকরসের এই পর্যায়ের বই হিসেবে বরযাত্রী সিরিজ বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সৃষ্টি। রানু সিরিজের গল্প গুলি তাঁর কৌতুকরসের আরেকটি বিখ্যাত শিল্পকর্ম। বিভূতিভূষণ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পুজো সংখ্যায় ছোটোদের জন্য লিখা “পোনুর চিঠি” ও অন্যান্য নানাবিধ গল্প যা পরিণত মনস্ক পাঠকদের বিপুল উৎসাহের সঞ্চার করেছে।
"বঙ্গশ্রী' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তাঁর প্রথম লেখকরূপে আত্মপ্রকাশ। ১৩২২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায় "প্রবাসী'তে বিভূতিভূষণের গল্প "অবিচার' তৃতীয় স্থান অধিকার করে। তার আগে ছাত্রাবস্থায় কুন্তলীন পুরস্কারের জন্য লিখেছিলেন "গল্প লেখার গল্প'। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন রানুর প্রথম ভাগ (এপ্রিল, ১৯৩৭) এবং প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস নীলাঙ্গুরীয় (১৯৪২)।
গ্রন্থ তালিকা
উপন্যাস
নীলাঙ্গু্রীয় (১৯৪২) (পরে এই উপন্যাসটি চিত্রাভিনীত হয় )
স্বর্গাদপি গরীয়সী (১ম – ২য় – ৩য় খণ্ড) (১৯৪৫)
নবসন্নাস (১৯৪৮)
কাঞ্চন-মূল্য (পরে এই উপন্যাসটি চিত্রাভিনীত হয়) (১৯৫৬)
নয়ন বৌ (১৯৫৭)
রিকসার গান (১৯৫৯)
মিলনান্তক (১৯৫৯)
পঙ্ক পল্বল (১৯৬৪)
ঊর্মি আহ্বান (১৯৬৫)
অযাচী অন্ধানে (১৯৮৮)
তোমারি ভরসা
উত্তরায়ণ
গোল গোবিন্দের কড়চা
রূপ হল অভিশাপ
কদম
গল্পসংকলন
রানুর প্রথম ভাগ (এপ্রিল, ১৯৪৪)
রানুর দ্বিতীয় ভাগ (১৩৪৫)
রানুর তৃতীয় ভাগ (১৩৪৭)
বর্ষায় (১৩৪৭)
রানুর কথামালা (১৩৪৮)
বসন্ত (১৩৪৮)
শারদীয়া (১৩৪৮)
বরযাত্রী (১৩৪৯)
চৈতালী (১৩৫০)
অতঃকিম (১৩৫০)
হৈমন্তী (১৩৫১)
কায়কল্প (১৩৫১)
দৈনন্দিন (১৩৫২)
কাতেখড়ি (১৩৫৪)
কথাচিত্র (১৩৫৫)
লঘুপাক (১৩৫৫)
রূপান্তর (১৩৫৭)
বাস্তব অবাস্তব (১৩৬১)
হাসি ও অশ্রু (১৩৬২)
মানস মিছিল (১৩৬৩)
আনন্দপট (১৩৬৪)
পরিচয় (১৩৬৮)
কন্যা সুশ্রী স্বাস্থ্যবতী (১৩৬৯)
নাটক
বিশেষ রজনী (১৩৫১)
গণশার বিয়ে (১৩৫৯)
রম্যভ্রমণধর্মী রচনা
দুয়ার হতে অদূরে
কুশী প্রাঙ্গনের চিঠি
একই পথের দুই প্রান্তে
অযাত্রার জয়যাত্রা
শিশু সাহিত্য
পোনুর চিঠি
কৈলাশের পাঠরানী
হেসে যাও (কবিতা)
দুষ্টুলক্ষীদের গল্প
কিশোর রচনাসম্ভার
কাব্যের মূলতত্ত্ব
পৃথ্বীরাজ
আত্মজীবনী
জীবন তীর্থ
সম্মাননা ও পুরস্কার
লেখক বিভূতিভষণ মুখোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান সূচক "ড.লিট' উপাধি পান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি "জগত্তারিণী' সুবর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৮সালে "আনন্দ পুরস্কার' প্রাপ্ত হন। সাহিত্য কর্ম "এবার প্রিয়ম্বদা'-এর জন্য "রবীন্দ্র পুরস্কার'(১৯৭২) লাভ করেন। সাহিত্য কর্ম "কাঞ্চন-মূল্য' রচনা করে "শরৎ-স্মৃতি পুরস্কার' (১৯৮৭) পান।
মৃত্যু
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ৩০শে জুলাই, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ৯৩ বছর বয়সে বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলায় পরলোক গমন করেন।
প্রবন্ধ: তনুশ্রী চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র:
১. উইকিপিডিয়া
২. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. সাংসদ বাংলা চরিতাভিধান
৪. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ড. দেবেশ কুমার আচার্য
(প্রকাশিত: ১৬.০৫.২০২১)